পঁচিশ বছর পর মায়ের সান্নিধ্যে সিলেটের ফজলু
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ বয়সের ভারে নূয্য শরীর। হাঁটা-চলায় সাহায্য নিতে হয় অন্যের।শরীর শুকিয়ে হয়েছে হাড্ডিসার। কথা বলতেও মুখে বাধে, নয়নের জল যেন শুকিয়ে গেছে অনেক আগেই।
এ অবস্থায় ২৫ বছর পর গর্ভধারিনী মায়ের সান্নিধ্য পাচ্ছেন ফজলু মিয়া। যার জীবনের ২২টি বসন্ত কেটেছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে। প্রিয় সন্তানের জন্য কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গেছেন মা মজিরুন বেওয়া। লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ব্লাস্ট’র সহায়তায় তাকে আদালত থেকে বের করে আনা হয়।
জীবন সায়াহ্নে এসে যখন দেখা হচ্ছে, তখন ফজলুর বয়স ষাটের কোটায়। আর তার মায়ের বয়স ৮০ পেরিয়ে।
শনিবার (২৪ অক্টোবর) বিকেলে জামালপুর থেকে সিলেটে আসছেন ফজলু মিয়ার মা মজিরুন বেওয়া ও বোন হামিদা বেগম। জামালপুরের জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে তাদের সিলেটে পাঠানো হচ্ছে।
ইতোমধ্যে শুক্রবার (২৩ অক্টোবর) বিকেলে সিলেটে পৌঁছেছেন ফজলু মিয়ার ছোট মামা মফিজ উদ্দিন ও চাচা মীর ফিরোজ আহমেদ। তাদের কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে অঝরে কেঁদেছেন ফজলু। কেঁদেছেন তার দুই স্বজনও।
বর্তমানে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার তেঁতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উছমান আলীর হেফাজতে ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্সে রয়েছেন ফজলু মিয়া।
শুক্রবার মফিজ উদ্দিন বলেন, ‘ফজলু আমার চেয়ে দশ দিনের বড়। সে মারা গেছে জানতাম। তাই খোঁজাখুঁজি করিনি। গত বুধবার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তারা ফজুলর খবর জানতে পেরে তাকে নিতে এসেছেন।
এ সময় যারা তার জীবনের সোনালী দিনগুলো কেড়ে নিয়েছে তাদের বিচার দাবি করেন তিনি। এ সময় আত্মীয়দের সঙ্গে মায়ের কাছে ফিরে যাওয়ার মনোবাসনা ব্যক্ত করেন ফজলু মিয়া।
তবে আইনি ঝামেলায় তাকে এখনই বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছেনা বলে জানিয়েছেন সিলেটে ফজলুর বাল্যবন্ধু কামাল উদ্দিন রাসেল। তাকে নিতে হলে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে বলে জানান তিনি।
কামাল উদ্দিন রাসেল বলেন, লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ব্লাস্ট’র সহায়তায় তাকে আদালতের মাধ্যমে ছাড়িয়ে আনা হয়। এক সময়ের তরুন টগবগে ফজলু এখন আপন খেয়ালে চলতে পারেন না। অন্যের সাহায্য নিয়ে তাকে চলাফেরা করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, ’৯৩ সালে জনৈক পুলিশ সার্জেন্ট তাকে আটকের পর ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে চালান দেন এবং পরবর্তীতে পাগল আইনের ১৩ ধারায় আদালতে প্রসিকিউশন দেন। ২০০৪/০৫ সালে উচ্চ আদালত থেকে তাকে যথাযথ অভিভাবকের জিম্মায় পৌঁছানোর নির্দেশ দিলেও বিনা অপরাধে ২২ বছরই তাকে কাটাতে হয়েছে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে।
জামালপুর জেলার সদর উপজলার শাহবাজপুর সাউনিয়া গ্রামের মৃত বিষু মিয়ার ছেলে ফজলু মিয়া।
এদিকে শুক্রবার রাত ১২টায় জামালপুরের জেলা প্রশাসক শাহাব উদ্দিন খান তার গ্রামের বাড়িতে যান।
জেলা প্রশাসকের মোবাইল ফোনে ফজলু মিয়ার ছোট বোন হামিদা বেগম বলেন, ‘আমার ভাই বেঁচে আছেন জানতাম না। তার জন্য কাঁদতে কাঁদতে মা অন্ধ হয়ে গেছেন। মা এখন মৃত্যু শয্যায়। ভাইকে দেখার অধীর আগ্রহে আছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুক্রবার তারা সিলেট আসছেন। মা মজিরুন ছাড়াও সঙ্গে থাকছেন নানা হাসমত উল্লাহ, মামা আবদুল হালিম ও এক খালু।
জামালপুরের জেলা প্রশাসক শাহাব উদ্দিন খান শুক্রবার রাতে মোবাইল ফোনে বলেন, ফজলুর প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত করতে পরিবারের সদস্যদের ডাকা হয়েছিল। সিলেটে অবস্থানরত ফজলুর সঙ্গে তাদের মোবাইল ফোনে কথাও হয়েছে। এখন ফজলুকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
ফজলুর পরিবারের বরাত দিয়ে জেলা প্রশাসক আরও জানান, ১৯৮৪ সালে কিশোর বয়সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান ফজলু। এরপর ১৯৮৭ সালে একবার বাড়িতে ফেরেন। সর্বশেষ ১৯৯১ সালে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যান ফজলু। এরপর তার আত্মীয় স্বজনরা ফজলুর কোনো খবর পাননি।
ফজলুর স্বজনরা জানায়, তার বাবা বিষু মিয়া ৭৬ সালে মারা যান। এরপর থেকে ভিটেমাটিহীন ফজলুর মা থাকেন ভাইদের আশ্রয়ে। তার নানা মৌলভি হাসমত উল্লাহ, মামা আব্দুল হালিম, আব্দুল গনি, আব্দুর রেজ্জাক, আব্দুস ছাত্তার ও মফিজ উদ্দিন জীবিত আছেন।
৩১ বছর আগে রাগ করে বাড়ি থেকে চলে আসার পর ফজলুর আশ্রয় জুটেছিল সিলেটের দক্ষিণ সুরমার গোলাম মাওলা নামের এক ব্যক্তির কাছে। তাকে নিয়ে বছর তিনেক পর একবার সাউনিয়া গ্রাম ঘুরে যাওয়ার পর ফজলুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি কারো।
দীর্ঘ কারাবাসে তিনি মানসিক ভারসাম্য অনেকটাই হারিয়েছেন। তবে স্বজনদের চিনতে পারায় এখন স্বস্তিতে আছেন সবাই। কিন্তু দৃষ্টিহীন মজিরন একবার হাত বুলিয়ে দেখতে চান সন্তানকে। শুনতে চান মা ডাক। শনিবার মা-ছেলের মিলন হবে।