রাজন হত্যার শেষ সাক্ষ্য গ্রহণ : আদালতে কামরুলকে হাজির করা হবে

Kamrul2সুরমা টাইমস ডেস্কঃ চাঞ্চল্যকর শিশু শেখ মোঃ সামিউল আলম রাজন (১৪) হত্যা মামলায় রোববার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) সুরঞ্জিত তালুকদার সাক্ষ্য দেবেন। এটাই এ হত্যা মামলার শেষ সাক্ষ্য গ্রহণ।
সাক্ষ্যগ্রহণকালে সৌদি-আরব থেকে ফিরিয়ে আনা মামলার প্রধান আসামী কামরুল ইসলামসহ ১১ আসামীকে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কঠোরনিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে মহানগর দায়রা জজ আদালতে হাজির করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।মহানগর পুলিশ কমিশনার মোঃ কামরুল আহসান জানান, মামলার দুই আসামী কামরুলের ভাই শামীম আহমদ ও আইসক্রিম কারখানার কর্মচারী জাকির ওরফে পাভেল ওরফে রাজুর এখানো পলাতক। তারা দেশেই আত্মগোপন করে আছেন। তাদের গ্রেফতারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।রাজন হত্যা মামলার মোট অভিযুক্ত আসামী ১৩ জন। এর মধ্যে কামরুলসহ এখন কারাগারে ১১ জন আটক রয়েছেন। পলাতক রয়েছেন কামরুলের ভাই শামীম আলম ও পাভেল নামের আরেক জন আসামী। এ মামলার মোট সাক্ষী ৩৮ জন। এর মধ্যে ইতিপূর্বে আদালত ৩৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহন সম্পূন্ন করেছেন। এর মধ্যে ২ সাক্ষী আসামীদের পক্ষে আদালতে সাক্ষ্য দেয়ায় তাদেরকে বৈরী ঘোষনা করে রাষ্ট্রপক্ষ।সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এসি (প্রসিকিউশন) আব্দুল আহাদ বলেন, কামরুলের বিরুদ্ধে আদালতের ওয়ারেন্ট ছিল। গত শুক্রবার আদালত ওয়ারেন্ট তামিল করে তাকে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন।কামরুলকে যেভাবে দেশে আনা হয়দুই দেশের মধ্যে বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকায় ইন্টারপোলের সহায়তায় কামরুলকে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে আনা হয়। ইন্টারপোলের সদস্য হিসেবে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিজেরাই রাজন হত্যার প্রধান আসামিকে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শেষ করেন। এরপর বাংলাদেশী পুলিশ সদস্যদের হাতে কামরুলকে তুলে দেয় সৌদি পুলিশের সদস্যরা। ১৩ জুলাই কামরুলকে জেদ্দায় গ্রেফতারের পর তাকে দেশে ফেরাতে সৌদি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ যোগাযোগ শুরু করে। এরপর তাকে দেশে ফেরত আনার জন্য ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়। ইন্টারপোল ২১ জুলাই কামরুলের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে। পরে কামরুল সম্পর্কে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সৌদি সরকারকে দেওয়া হয়। এভাবেই তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। গত সোমবার কামরুলকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহাবুবুল করিম, সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ রহমত উল্যাহ এবং সহকারী পুলিশ কমিশনার এএফএফ নিজাম উদ্দিন সৌদি আরবে যান। এর পর সৌদি আরবের

রিয়াদ থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে করে কামরুলকে দেশে আনা হয়। গত বৃহস্পতিবার বিমানটি দুপুর ২ টা ৫৭ মিনিটে শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিকেল ৪ টার দিকে কামরুলকে নিয়ে সড়কপথে সিলেটের উদ্দেশে রওনা দেয় সিলেট মহানগর পুলিশ।৩৫ সাক্ষীরা হচ্ছেন জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ আখতার হোসেন, মামলার প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সাময়িক বরখাস্ত হওয়া জালালাবাদ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আলমগীর হোসেন, একই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আরিফুল আমিন, সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মহাদেব বাছাড়, জালালাবাদ থানার এসআই জাকির হোসেন, মনির আহমদ, মামলার বাদি জালালাবাদ থানার এসআই (বরখাস্তকৃত) আমিনুল ইসলাম, দোয়ারাবাজার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শামীম আখঞ্জি, ছাতক থানার এএসআই সোহেল রানা, মাইক্রোবাসচালক আবদুল মান্নান, ওয়ার্কশপ মালিক সুদীপ কপালি, জালালাবাদ থানার শেখপাড়ার বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন মেম্বার, কুমারগাঁওয়ের বাসিন্দা কোরবান আলী, আবদুল করিম ও আফতাব মিয়া, পশ্চিম জাঙ্গাইলের বাসিন্দা মৃত আবদুস সাত্তারের পুত্র আনোয়ারুল হক, কুমারগাঁয়ের বাসিন্দা জাকিরের ছেলে বেলাল আহমদ, দকির গ্রামের বাসিন্দা ইসকন্দর আলীর ছেলে আবদুল হান্নান, কুমারগাঁয়ের বাসিন্দা লুৎফুর রহমান, বাবুল মিয়া, কাচা মিয়া, পূর্ব জাঙ্গাইল গ্রামের বাসিন্দা কাঁচা মিয়া ওরফে কচি, রাজনের

গ্রামের বাদেয়ালির ইশতিয়াক আহমদ রায়হান, নিজাম উদ্দিন, পার্শ্ববর্তী গ্রাম অনন্তপুরের আবদুজ জাহির মেম্বার, শেখপাড়ার পংকি মিয়া, রাজনের মা লুবনা বেগম, জিয়াউল হক, আল আমিন ও মাসুক মিয়া, রাজনের বাবা আজিজুর রহমান। অপর ৩ সাক্ষীর নাম-পরিচয় জানা যায়নি।মামলায় অভিযুক্তরা হচ্ছে জালালাবাদ থানার কুমারগাঁও এলাকার শেখপাড়া গ্রামের মৃত আব্দুল মালেকের পুত্র কামরুল ইসলাম (২৪), তার ভাই মুহিত আলম ওরফে মুহিত (৩২), শামীম আলম (২০), জাকির হোসেন পাভেল (১৮), আলী হায়দার ওরফে আলী (৩৪), চৌকিদার ময়না মিয়া ওরফে বড় ময়না (৪৫), জালালাবাদ থানার টুকেরবাজার ইউনিয়নের পূর্ব জাঙ্গাইল গ্রামের মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিনের পুত্র ভিডিওচিত্র ধারণকারী নূর আহমদ ওরফে নুর মিয়া (২০), দুলাল আহমদ (৩০), আয়াজ আলী (৪৫), তাজ উদ্দিন বাদল (২৮), ফিরোজ মিয়া (৫০), আছমত আলী (৪২) ও রুহুল আমিন (২৫)। এর মধ্যে শামীম ও পাভেল বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।যেভাবে রাজনকে হত্যা করা হয় কিশোর সামিউল আলম রাজনের বাড়ি নগরীর কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডের পাশে সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেয়ালী গ্রামে।

রাজনের বাবা শেখ আজিজুর রহমান পেশায় একজন মাইক্রোবাস চালক। তার দুই ছেলের মধ্যে রাজন বড়। অনন্তপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করা সামিউল আলম রাজন সবজি বিক্রি করত। গত ৮ জুলাই সকালে অন্যান্য শিশুদের সাথে কুমারগাঁওয়ের একটি ওয়ার্কশপে খেলাধূলা করতে যায়। সেখানে চৌকিদার ময়না মিয়া রাজনকে চোর অপবাদ দিয়ে আটক করে এবং মার্কেটের মালিক সৌদি-আরব প্রবাসী কামরুলসহ অন্য কয়েকজনকে খবর দেয়। পরে ঘাতকদের নিষ্ঠুর অত্যাচার ও নির্যাতনের সময় রাজন যখন আর্তনাদ করছিলো তখন পাষন্ডরা অট্টহাসিতে মেতেছিলো। প্রাণ ভিক্ষা চেয়েও শেষ পর্যন্ত রক্ষা পায়নি শিশু রাজন। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে রাজন পানি খেতে চেয়েছিলো। কিন্তু ঘাতকরা তাকে পানির বদলে ঘাম খেতে বলে। ঘাতকদের নিষ্ঠুর অত্যাচার, নির্মম মারপিট ও লাঠির আঘাতের কারণেই তার মৃত্যু হয়। তার শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহৃ ছিল। ঘাতকরা খুনের ঘটনা আড়াল করতে ভ্যান চুরির মিথ্যা অপবাদের কালিমা লেপন করেছিলো। ওই দিন ওয়ার্কশপে কোন ভ্যান গাড়ী ছিল না। মূলতঃ চুরি ঘটনাটি ছিল মিথ্যা, বানোয়াট। খুনের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য আসামিরা মরিয়া হয়ে উঠে। আসামি কামরুল, আলী হায়দার, মুহিত আলম তড়িঘড়ি করে একটি গাড়িতে করে রাজনের মৃতদেহ গুম করার চেষ্টাকালে গ্রামবাসী মুহিত আলম আটক হয় এবং অন্যরা পালিয়ে যায়। পরে ঘাতকরা ধারনকৃত রাজন নির্যাতনের ভিডিও ফুটেজটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করলে এ ঘটনাটি নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক তোলপাড় সুষ্টি হয়। এ ঘটনায় গাফলি করার কারনে জালালাবাদ থানার তিন পুলিশ কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত হন।সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায় এ হত্যাকান্ডের পর মহানগরীর জালালাবাদ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে মুহিত আলমসহ অজ্ঞাত ৪/৫ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। অন্যদিকে

রাজনের বাবাও হত্যাকান্ডের ঘটনায় আরেকটি এজাহার দেন। গত ১৬ আগস্ট সৌদি আরবে আটক কামরুল ইসলামসহ ১৩ আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে এ হত্যা মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর সুরঞ্জিত তালুকদার। এর আগে মুহিত আলমসহ ৮ জন এ ঘটনায় হত্যার দায় স্বীকার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি দেন। গত ২৪ আগস্ট আদালত এ মামলার চার্জশিট গ্রহণ করেন। ২৫ আগস্ট জালালাবাদ থানা পুলিশ পলাতক ৩ আসামির মালামাল ক্রোক করেন। মামলায়

২২ সেপ্টেম্বর ১৩ আসামীর বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন করেন ।ধন্যবাদ দিলেন রাজনের বাবা হত্যাকান্ডের মূল হোতা কামরুল ইসলামকে দেশে ফিরিয়ে এনে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানোর জন্য সরকার, সাংবাদিক, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানান সামিউল আলম রাজনের পিতা আজিজুর রহমান। গত শুক্রবার আদালতে এসে ধন্যবাদ জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আমি ন্যায়বিচার চাই। রাজন হত্যা মামলার প্রধান আসামি কামরুলের স্বজনরা আমাকে এখন বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।