হাওরখেকোদের টার্গেট এখন হাকালুকির অভয়াশ্রমগুলো
মশাহিদ আহমদ, মৌলভীবাজার: এশিয়ার সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকি এখন বলতে গেলে অরক্ষিত অবস্থায় পতিত হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের সিবিএ ইসিএ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত জুলাই মাসে। বেশ কয়েকটি অভয়াশ্রম বাস্তবায়ন হবার ফলে মাছের উৎপাদন অনেকগুণ বেড়েছে। এমতাবস্থায় হাওর তীরের রাঘব-বোয়ালদের লোলুপ দৃষ্টি এখন হাকালুকি হাওরের অভয়াশ্রমগুলোর উপর। পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়- ২০১০ সালের জুলাই মাসে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন করে পরিবেশ অধিদপ্তরের সমাজভিত্তিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন প্রকল্প (সিবিএ-ইসিএ)। প্রকল্পটিতে ১০ কোটি টাকা অর্থায়ন করছে নেদারল্যান্ডস, ইউএনডিপি ও বাংলাদেশ সরকারের কাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড। ২০১১ সালে মাঠপর্যায়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু এবং ২০১৪ সালের মার্চ থেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়ে চলতি বছর জুলাই মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে।পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র আরও জানায়- হাকালুকি হাওর ভরাট, হাওর থেকে নির্বিচারে মাছ ও জলজ উদ্ভিদ আহরণের কারণে হাওরটির জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়ে। হাওরকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পরিবেশ অধিদপ্তর বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মৎস্য অভয়াশ্রমের জন্য আগদার বিল, মাইছলার ডাক বিল, কইয়ার কোনা বিল, কন্টিনালার কর খাল, মইয়াজুরি বিল, রনচি বিল, তেকোনি বিলের দুটি অংশ, বিড়ালি খাল ও কুরিয়া বিল নামের ১০টি বিল খনন করা হয়। বর্ষা মৌসুমে অভয়াশ্রমে ঝাড়-কাঁটা, হিজল-করচের ডাল ও বাঁশ ফেলা হয়। ভূমি মন্ত্রণালয় হাকালুকি হাওরে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে মাছের উৎপাদন বাড়াতে এ বিলগুলোকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে ‘আফাল’ বা ঢেউ থেকে গ্রাম রক্ষায় প্রায় ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ১০টি সবুজবেষ্টনী তৈরি করা হয়। এসব বেষ্টনীর ওপর লাগানো হবে হিজল-করচ। কুলাউড়ার ভুকশিমইল, শশারকান্দি, বেড়কুড়ি ও ভাটি শাহপুর, জুড়ীর বেলাগাঁওয়ে দুটি, বড়লেখার হালা ও শ্রীরামপুর এবং সিলেটের গোলাপগঞ্জের কালিকৃষ্ণপুর ও রানজিওল এলাকায় এসব বেষ্টনী তৈরি হয়। এছাড়া ভুকশিমইল, বেলাগাঁও, হালা, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের ঘিলাছড়ার এলাকার যুধিষ্ঠিপুর, গোলাপগঞ্জের কাদিপুর বাজার ও শান্তির বাজার এলাকায় প্রতিবেশ সংরক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এ কেন্দ্রগুলো থেকে গ্রাম সংরক্ষণ দল (ভিসিজি) তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে এবং হাওর সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য সংরক্ষণ করা হবে। হাকালুকি হাওর এলাকায় ২৮টি ভিসিজির ৯শ ৫০ জন সদস্য রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৮৪ জনকে বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য গরু, হাঁস-মুরগি, সেলাই মেশিন প্রদান করা হয়। হাওর থেকে নির্বিচারে সম্পদ আহরণের চাপ কমানোর জন্যই এ বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা। এদিকে ২০১০ সালে ১২টি বিলকে মৎস্য অভয়াশ্রম করার পর হাকালুকি হাওরে মাছের উৎপাদন বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। চলতি বর্ষা মৌসুমে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রচুর পরিমান মাছ ধরা পড়েছে জেলেদের জালে। স্থানীয় লোকজন জানান- বর্ষা মৌসুম শেষ হলে হাওরখেকোরা ঝাঁপিয়ে পড়বে। বিলের মাছ লুট করাই হবে তাদের প্রধান টার্গেট। এ অবস্থা প্রতিহতের উদ্দোগ নেয়া না হলে, যে মহতি উদ্দেশ্যে ১০ কোটি টাকা ব্যায়ে এতকিছু করা হয়েছে এবং হচ্ছে তা কোনই সুফল বয়ে আনবেনা। হাকালুকি হাওর এলাকায় কর্মরত সরকারি-বেসরকারি সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানান- সিবিএ-ইসিএ প্রকল্পে ভিসিজি ও পাহারাদার রয়েছে। তবে, তাদের ওপর নির্ভর করলে হবে না। বর্তমানে হাওরে পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রকল্প বাস্তবায়নে দুটি বেসরকারি সংস্থা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তাদের পক্ষে হাওর সংরক্ষণ করা কঠিন। পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা বশির আহমদ জানান- প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিলো হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনা, জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এবং হাওরাঞ্চলের মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানে সহযোগিতা করা। প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজই ছিলো শেষ পর্যায়ে। কোন কোনোটি চলমান আছে। তবে প্রকল্পের মেয়াদ জুলাই মাসে শেষ হয়েছে। এমতাবস্থায় স্থানীয় প্রশাসন আন্তরিক সহযোগিতা করলে যতই অপচেষ্টা চালানো হোক না কেন, তাতে কেউ সফল হতে পারবেনা।