বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন : বাংলাদেশে র্যাব কি চাপে পড়েছে?
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ বাংলাদেশে গত এক দশকে র্যাব সহ বিভিন্ন বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে দু হাজারেরও বেশি মানুষ। নানা ঘটনায় বিভিন্ন সময় আলোচনায় এসেছে সংস্থাটি। তবে র্যাব সংশ্লিষ্ট ছিল এমন কোনো কাজের সমালোচনা ক্ষমতাসীন কোনো দল থেকে কখনোই শোনা যায়নি। তবে এবার সেটিই দেখা যাচ্ছে ঢাকার হাজারীবাগে সমপ্রতি রাজা নামক একজন কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠার একদিন পর স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা আরজু মিয়ার কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনার পর।
আরজু মিয়াকে হত্যা করা হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে ক্ষমতাসীন দল থেকেই তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে র্যাবের। আর এ সমালোচনায় কি কিছুটা হলেও চাপের মুখে পড়েছে পুলিশের এ বিশেষ বাহিনীটি? হাজারীবাগে আরজু মিয়ার বাসায় বসে কথা হয় তার ভাই মাসুদ রানার সাথে যিনি তার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে মামলা করেছেন আদালতে।
তিনি বলেন, যখন শুনেছি র্যাব আরজুকে আটক করেছে তখন বরং মনে শান্তি পেয়েছিলাম যে এলাকার কোন্দল থেকে যে রাজা মারা যাওয়ার ঘটনা নিয়ে হৈ চৈ হাঙ্গামা তা থেকে আরজু বেচে আছে, ভালো আছে, সুস্থ আছে। কিন্তু এভাবে মেরে ফেলবে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি।
পরে সংবাদ সম্মেলনে থানা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও আপনারা অনেক কথা বলেছেন। তো কি বলতে চেয়েছেন আপনারা? -এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুদ রানা বলেন, আরজুকে পরিকল্পিতভাবে দলেরই কোনো খারাপ লোকেরা হত্যা করেছে। আমিও তাই মনে করি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে আরজুকে হত্যা করা হয়েছে এজন্য মামলা করেছি। সঠিক তদন্ত চাই। মনের দিক থেকে সন্তুষ্ট থাকবো যে আমার ভাই যে দল করেছে তারা বিচার করতে পারে। তো দলটির নেতারা কি সেই আশ্বাস বা নিশ্চয়তা দিয়েছে আপনাকে? জবাবে মাসুদ রানা “সবাই আশ্বাস দিচ্ছে যে বিচার পাবো ও তাড়াতাড়িই পাবো। স্থানীয় সংসদ সদস্যের কথায় আমরা সন্তুষ্ট। উনি আমাদের গাইড করছেন”।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসেব অনুযায়ী আরজু মিয়ার মতো অন্তত দু হাজার মানুষ ২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে র্যাব সহ বিভিন্ন বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। কিন্তু কখনোই ক্ষমতায় থাকা দলগুলো এ নিয়ে প্রকাশ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
বরং গত বছর এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের পর এবং পরে জুলাইয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ র্যাব বিলুপ্তির দাবি জানায়। একি দাবি করেছিলেন করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও।
সরকারের মন্ত্রীদের অনেকেই এজন্যে তখন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও বিএনপি চেয়ারপারসনের তীব্র সমালোচনা করেন। এমনকি নিজ দলের কর্মীর বন্দুকযুদ্ধে নিহত বা গুম হওয়ার ঘটনাতেও আরে আগে তেমন কোন উচ্চবাচ্য করতে চাননি তারা।
কুমিল্লার কাজী আব্দুল মতিন বলছিলেন তার ছেলে কুমিল্লায় ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন এক সময়। উনিশ মাস আগে তার ছেলেকে বাড়ি থেকেই তুলে নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। নিখোঁজ সন্তানের একটি ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, দেখুন ছবিতে মন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে আমার ছেলে। মন্ত্রীর সাথে রাতভর মিটিংয়ের পর বাসায় আসার পরেই ওই ঘটনা ঘটে। পরে মন্ত্রী সহ স্থানীয় নেতারা অনেক খোঁজ করেছেন কিন্তু আমি আমার সন্তানর খোঁজ আজও পাইনি।
তবে এবার হাজারীবাগের ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। কথা বলেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্যরা, যা নিয়ে কার্যত কিছুটা চাপেই পড়েছে র্যাব। ওই এলাকার কাউন্সিলর তারিকুল ইসলাম সজিব বলছেন আরজু হত্যার সাথে জড়িতদের কোনোভাবেই ছেড়ে দেবেন না তারা।
তিনি বলেন, আরজুর শরীরের জামা কাপড়ে গুলির কোন দাগ ছিল না, শুধু শরীরে ছিলো। সে পালানোর চেষ্টা করলে গুলি লাগতো পিঠে। এছাড়া আমি তার শরীরে কুকুরের কামড়ের দাগ দেখেছি। এ ঘটনার সাথে দল বা প্রশাসনের যে-ই জড়িত থাকুক ছাড়া পাবে না। তবে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও শালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলছেন শুরু থেকেই বন্দুকযুদ্ধের বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে এখনকার মতো প্রতিক্রিয়া আসলে এতো বিপুল সংখ্যক ব্যক্তিকে বন্দুকযুদ্ধের শিকার হতে হতো না বলেই মনে করেন তিনি।
“এখন বিতর্ক হচ্ছে যেটা আগে হয়নি কখনো। এটা ভালো ইঙ্গিত। যদিও বড় খরচের মধ্য দিয়ে এটা হলো যে প্রায় ২ হাজার মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। এখন যেহেতু প্রশ্ন উঠেছে, এবং এ ধরনের প্রশ্ন বা বিতর্ক যদি ১০/১৫ বছর আগে সূচনা হতো তাহলে এতো মানুষ এর শিকার হতো না।
তিনি বলেন, আরজু মিয়ার ক্ষেত্রে পরিবার থেকে যে মামলা হয়েছে সে ধরনের মামলা আগেও হয়েছে কিন্তু সব সময়ই দেখা গেছে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাকে পদ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।
“আগেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এরা আসে সামরিক বাহিনী থেকে এবং পুলিশের হয়ে কাজ করছে। যখন অভিযোগ আসে তখন তারা যখন সামরিক বাহিনীতে চলে যায় তখন তাদের ওপর সামরিক বাহিনীর বিধি বিধান প্রযোজ্য হয়। ফলে সাধারণ আদালতে ফৌজদারি অপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া থেকে তাদের দুরে সরিয়ে নেয়া হয়। এ ধরনের প্রক্রিয়ার কারণেই এরা জবাবদিহিতার সম্মুখীন হয় না ”
আর জবাবদিহিতার কোনো সুযোগ নেই বলেই অনেকে পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে তার শেষ পরিণতি সম্পর্কেও জানতে পারেননি। হাজারীবাগের মাসুদ রানা কিংবা কুমিল্লার কাজী আব্দুল মতিন তাদের ভাই কিংবা সন্তান নিহত বা নিখোঁজ হওয়ার পর ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা কর্মী হওয়ার সুবাদে দল বা প্রশাসনের সহযোগিতা পাচ্ছেন বা পাওয়ার চেষ্টার সুযোগ পেয়েছেন।
কিন্তু সে সুযোগও পাননি ঢাকার বসুন্ধরা এলাকা থেকে ১৯ মাস আগে নিখোঁজ হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম। সরকারি নানা দপ্তরে ঘুরে হতাশ সানজিদা বলছেন এখন সরকারি দলের কর্মীরা নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটে তাদের দলের নেতারা বিচারের যে দাবি করছেন সেটি হলেও তারা খুশী হবেন।
“র্যাবের পোশাক পরা লোকজন আমার ভাই সহ কয়েকজনকে তুলে নিয়ে যায়। ঘটনাটি প্রকাশ্যেই ঘটেছে। তিনি ছাত্রদলের কর্মী ছিলেন এখানে। কাউন্সিলর নির্বাচনে আগ্রহী ছিলেন। থানা, পুলিশ, মানবাধিকার কমিশন সব জায়গায় গেছি আমরা বার বার। কিন্তু খোঁজই পেলামনা এখনো। এখন সরকারি দলের কর্মীদের হত্যার বিচার হলে নিশ্চয়ই একদিন আমরাও বিচার পাবো ”।
বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের ঘটনার পাশাপাশি সাজেদুল ইসলাম সুমনের মতো অসংখ্য মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে মূলত রাজনৈতিক সংঘাত সহিংসতার সময় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া বা গুম হওয়ার ঘটনা বেড়ে যায়। তবে র্যাব সবসময়ই বলে আসছে যে আর এসব ঘটনার অধিকাংশগুলোর ক্ষেত্রেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন র্যাবের বিরুদ্ধেই। কিন্তু সরকার ও র্যাব এগুলো সবসময়ই প্রত্যাখ্যান করে আসছে।
র্যাবের উপপরিচালক মেজর মাকসুদুল আলম বলছেন একটি শক্তিশালী তদন্ত সেল অভিযোগের তদন্ত করে এ পর্যন্ত ২ হাজারের বেশি সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।
তিনি বলেন, যে কোনো অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিশেষায়িত সেল আছে। তারা স্বচ্ছতার সাথে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। অনেকের বিরুদ্ধেই চাকুরিচ্যুতি সহ নানা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই কোনো কিছু ঘটলেই র্যাবের সমালোচনা করা হয় কিন্তু পরে দেখা যায় সে অভিযোগ সত্যি হয় না।
তবে সামপ্রতিক বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাগুলোর পর তীব্র সমালোচনা হচ্ছে এটা কি কোনো চাপ সৃষ্টি করছে র্যাবের ওপর -এমন প্রশ্নের জবাবে মি আলম বলেন, কাজ করতে গেলে সমালোচনা হবেই। কোনো গাফিলতি বা থাকলে তদন্ত পর্ষদ আছে তারা তদন্ত করে আইনগত যা করার সেটাই করা হবে। নারায়ণগঞ্জের ঘটনাতেও ব্যবস্থা নিয়েছি। তাই কোনো বাড়তি চাপ মনে করছি না।
কিন্তু র্যাব বা সরকার যা-ই বলুক, অনেকেই মনে করেন হাজারীবাগের আরজু মিয়ার নিহত হওয়ার পর সরকারি দলের নেতাদের কঠোর সমালোচনা বন্দুকযুদ্ধ সহ নানা ঘটনায় শুরু থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়া র্যাবের ওপর নৈতিক দিক থেকে হলেও একটি বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে । সূত্র: বিবিসি বাংলা।