এক ডিম থেকে মসজিদ নির্মাণে অসাধ্য কৃর্তি
এসএমএ হাসনাতঃ অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি! মহতি চিন্তা করলে বা উদ্যোগ নিলে কোন প্রতিবন্ধকতাই বাঁধা মনে হয় না। মাত্র একটি ডিম (স্থানীয় ভাষায় এন্ডা) থেকেই নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় একটি মসজিদের। আজ যা বাস্তব সত্যি যে বিশাল একটি মসজিদে শত শত মুসল্লী কায়মনো বাক্যে উপাসনা করছে। ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়’ এই চিরন্তন বাক্যটি আজ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল হবিগঞ্জ জেলা থেকে প্রায় ৭৫ কিঃমিঃ দূরে নিভৃত্য পল্লীতে। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন এক মহিয়ষী নারী। স্বামীর অঢেল সম্পদ থাকলেও শুধু নিয়ত (মানত) করার কারণে একক প্রচেষ্টায় তিল তিল করে গড়ে তোলেন এই মসজিদ।
আজ থেকে ১১৩ বছর আগে জনৈক বেঙ্গির মার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নির্মিত হয়েছিল মসজিদটির। ‘ছোট ছোট বালু কণা/বিন্দু বিন্দু জল/গড়ে তুলে মাহাদেশ/ সাগর অতল’ কবিতাটির মতো করে দাঁড় করিয়েছেন মসজিদটি। ফলে তার নামে মসজিদটির নামকরণ অর্থাৎ বেঙ্গির মায়ের মসজিদ। শত বর্ষ পরেও আজ মসজিদের অভ্যন্তরে নিয়ন বাতিতে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে ‘প্রজাতপুর ও লালাপুর জামে মসজিদ/প্রতিষ্ঠাতা বেঙ্গির মা’। শুধু নিয়ন বাতি কেন এলাকাবাসীর অন্তরে যা আজো তার নাম উজ্জ্বলতর তারকা হয়ে আছেন তিনি।
হবিগঞ্জ জেলা শহর থেকে দু’বার সিএনজি পাল্টে যখন নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাতগঞ্জ বাজারে পৌছালাম তখন বেলা ১১টা। অটো রিক্সা নিয়ে আরো ৩ কিঃমিঃ ইনাতগঞ্জ-সৈয়দপুর সড়ক ছেড়ে ভিতরে বিবিয়ানা নদীর পাড়ে একটি বিশাল মসজিদ কমপ্লেক্স। নয়নাভিরাম ও আধুনিক নির্মাণ শৈলীসম্বলিত বিশাল তোরণ পেরিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলাম। দেখলাম বর্তমান সময়ের রুপান্তরিত আধুনিক মসজিদ।
বেঙ্গির মার প্রপৌত্র ও মসজিদ কমিটির সদস্য সাংবাদিক রাকিল হোসেন জানালেন মসজিদটির পুরোনো ভবন ভেঙ্গে স্থানীয় ও প্রবাসীদের সহায়তায় আজকের মসজিদ। কিন্তু ধার্মিক বেঙ্গির মা ও তার অসামান্য কৃতকর্ম আজ ইতিহাস। আর তার রেখে যাওয়া স্মৃতি দেখার জন্য প্রতিদিন শত শত মানুষ আসে বেঙ্গির এক এন্ডার (ডিম) মসজিদ দেখতে।
অজপাড়া গাঁওয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন বেঙ্গির মা। বেঙ্গির মা একটি মহৎ উদ্যোগ নিয়ে এক এন্ডা (ডিম) থেকেই গড়ে তুলেছেন একটি মসজিদ। এলাকাবাসী নাম দিয়েছেন এক এন্ডার মসজিদ। মসজিদটির নাম এখন সবার মুখে। এক এন্ডা থেকে কিভাবে এক মসজিদ সে কথা শুনলে সবাই অবাক হন।
জানা যায় ১৯০২ সালে (১৩০৭ বঙ্গাব্দ) প্রজাতপুর গ্রামের তৎকালীন সরফ উল্লার স্ত্রী বেঙ্গির মা প্রজাতপুর ও লালপুর দুটি গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদ নির্মাণের শেষে এলাকাবাসীকে জড়িত করে মসজিদটির নামকরণ করেন ‘এক এন্ডা (ডিম)র মসজিদ’। তখন মসজিদের নামকরণ নিয়ে জনতার মধ্যে প্রশ্ন জাগলে তিনি ঘটনাটি খুলে বলেন। বেঙ্গির মা এলাকাবাসীকে জানান তিনি একটি মুরগীর ডিম মসজিদের নামে মানত করে রাখেন। ঐ ডিমটি থেকে মুরগীর উঠলে দিলে তা থেকে একটি বাচ্চার জন্ম হয়। পরবর্তীতে ঐ বাচ্চাটি বড় হলে তা থেকে আরো সাতটি ডিম হয়। পরবর্তীতে ঐ সাতটি ডিম থেকে সাতটি বাচ্চার জন্ম হয়। এভাবে এক পর্যায়ে মুরগীর খামার গড়ে তুলেন। ঐ খামারের মুরগী বিক্রি করে বেঙ্গির মা টাকা জমাতে থাকেন। তৎকালীন সময়ে তিনি এক লাখ টাকা জমা করে মসজিদটি তার স্বামীর মাধ্যমে নির্মাণ করে দেন। বেঙ্গির মা ছিলেন নিঃসন্তান। ঘটনা এলাকায় জানাজানি হওয়ার পরে মসজিদটির নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। মসজিদ নির্মাণের শত বছর অতিবাহিত হলেও এখন এ কাহিনী সবার মুখে মুখে।
অনেকেই মনে করেন একটি এন্ডা (ডিম) থেকে একটি মসজিদ নির্মাণের ঘটনা ইতিহাসে এই প্রথম। তাও আবার একজন মহিলা কর্তৃক মসজিদ নির্মাণ সবাইকে অবাক করেছে। প্রজাতপুর ও লালপুর গ্রামবাসী ২০০৯ সালে মসজিদটির বর্ধিত অংশ সংস্কার করেছেন। কিন্তু বেঙ্গির মার মুল মসজিদটি এখনও বিদ্যমান রয়েছে। গত বছরে মসজিদটি নতুন করে রং করা হয়েছে।
রাকিল হোসেন বলেন আমার পুর্ব পুরুষ নিঃসন্তান সরফ উল্লার স্ত্রী বেঙ্গির মা এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। আমি আমার বাবার কাছ থেকে শুনেছি পরিদাদী (বেঙ্গির মা) একটি এন্ডা থেকেই এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। বর্তমানে এলাকাবাসী কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয় করে মসজিদের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য সংস্কার করেছেন। মসজিদের মোতাওল্লী লন্ডন প্রবাসী আব্দুল হারিছ তিনি দেশের বাহিরে থাকায় থাকায় তাকে পাওয়া যায়নি।
প্রজাতপুর গ্রামের প্রবীণ উলফর উল্লা বলেন আমাদের গ্রামের বেঙ্গির মা এমন একটি কাজ করেছেন, যা সারাজীবনেও ভোলার মত নয়। আমি বেঙ্গির মার কাছ থেকে শুনেছিলাম তিনি একটি ডিম থেকে একটি মুরগীর খামার গড়ে তুলেছিলেন। ঐ খামারের একটি টাকাও তার সংসারের কাজে ব্যয় করেন নি। সম্পূর্ণ টাকা দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। মানুষটি (বেঙ্গির মা) মরে গেলেও এখনও সবাই তার কথা আলোচনা করে। এটা বিশ্বের নজীর হয়ে থাকবে।
মসজিদটি পরিচালনায় কমিটিতে যারা রয়েছেন তারা হলেন, বেঙ্গির মার বংশধর রউপ উদ্দিন সভাপতি, লন্ডন প্রবাসী আব্দুল হারিছ মোতাওয়াল্লী, ব্যবসায়ী হেলিম উদ্দিন ক্যাশিয়ার, সদস্য রাকিল হোসেন ও শামীনুর মিয়া প্রমুখ।
লেখকঃ এসএমএ হাসনাত, বিএসএস (সম্মান), এমএসএস (সাংবাদিকতা), রাঃবিঃ/ সম্পাদক, মহাকালগড় বার্তা ও মানবাধিকার কর্মী। মোবাইল নাম্বারঃ ০১৭১০৮৭৪০০৪