নবীগঞ্জের কবুতরপ্রেমী আব্দুস সামাদ এখন সফল ব্যবসায়ী
এসএমএ হাসনাতঃ আপাদমস্তক একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। নেশা তার কবুতর পালন। কিন্তু এই নেশাই পরে তার ধ্যাণ-জ্ঞান! নেশা থেকেই পেশায় পরিণত হয়েছে কবুতর পালন যার তিনি হলেন হবিগঞ্জ জেলা থেকে প্রায় ৮০ কিঃমিঃ দূরে নিভৃত পল্লী নাদামপুর গ্রামের আব্দুস সামাদ। দূর গ্রামে থেকেও কবুতর পালনের অত্যাধুনিক তথ্য, নতুন জাতের কবুতরের খবর, চিকিৎসা, কবুতর কেনা বেচার তথ্য তার হাতের মুঠোয়। হ্যাঁ, ইন্টারনেটের মাধ্যমেই মুহুর্তেই তিনি জানতে পারছেন নিত্যনতুন তথ্য। তিনি তার মুঠোপোনে দেখালেন সদ্য উদ্ভাবিত নতুন জাতের কবুতর ‘নিকভারী’। বললেন, কবুতরের কোন সমস্যা সমাধান ফেসবুক-এর মতো বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে পেয়ে থাকি। ফেসবুক-এ কম জায়গা (স্পেস), কম খরচে পালন করা যায় এমন সৌখিন পাখিটি হলো কবুতর। যার অসুখ-বিসুখও কম। ফলে এতে মারা যায়ও কম। বরঞ্চ একটি জোড়া কবুতর থেকেই বাচ্চা উৎপাদন করে কয়েক লাখ টাকা আয় করা সম্ভব বলে জানালেন আব্দুস সামাদ। আরো বলেন, অনেক কবুতরপ্রেমী মাসে ৪-৫ লাখ টাকা আয় করেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, যশোরে কিছু কবুতরপ্রেমী আছে। এরা উন্নত জাতের ও দামী দামী ও সৌখিন কবুতর পোষে।
আলাপচারিতায় জানা গেল, বাড়ীর ছাদে কিংবা আঙ্গিনায় ছোট্ট পরিসরেই কবুতর পোষা যায়। এক ঝাঁক কবুতর উড়িয়ে দিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে হাততালি দিলে দেখা যায় কবুতর ডিগবাজি খাচ্ছে। এ এক অন্যরকম সৌন্দর্য। আবার কয়েক মাইল দূরে গিয়ে কবুতর ছেড়ে দিয়ে এলেও ঠিক সময়মতো ফিরে আসে নিজ আঙ্গিনায়। কবুতরের এমন আচরণ বিমোহিত করে রাখে কবুতর পালনকারীকে। আর পায়ে চিঠি বেঁধে উড়িয়ে দেবার কথা শোনা যায় ঢের। তবে এ কথা ঠিক, কবুতর পোষার রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। এটা শৌখিনতার পরিচায়ক। তবে বর্তমান সময়ে তালে তালে কবুতর পালন শুধু শৌখিনতাই নয়, ভাল আয়ের একটি পথ। শুধু কবুতর পালন করে স্বাবলম্বী হয়েছে এমন উদাহরণ আমাদের দেশেই অনেক রয়েছে।
আব্দুস সামাদের বাড়ীর খামারটি ঘুরে দেখা গেল, কবুতরের নামগুলোও বেশ মজার এবং দেখতে খুবই সুন্দর। লোমশ কেশর এবং ছোট্ট মুখের কবুতরটির নাম জ্যাকোবিন। গলা থেকে ঘাড় পর্যন্ত পালকগুলো উল্টিয়ে এমন ভঙ্গিমায় দাড়িয়ে থাকে যেন কেউ তার মুখ দেখে না ফেলে। আবার গলায় বিশাল আকৃতির বলের মতো ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কবুতরগুলো দেখে মনে হবে পাড়ার কোন মস্তান দাঁড়িয়ে আছে। এর নাম ম্যাগপাই পোর্টার। পেখম মেলা কবুতর দেখে মনে হবে ছোট্ট সাদা ময়ুর নেচে বেড়াচ্ছে। পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের কবুতর এটি। নাম লক্ষা।
মজার বিষয় হচ্ছে, এসব কবুতর আমাদের দেশের আবহাওয়ার সাথে বেশ ভালভাবেই মানিয়ে চলতে পারে। কবুতরপ্রেমীরা এসব কবুতরকে ফেন্সি কবুতর নামেই চেনে। এদের লালন-পালন করতে খুব বেশি জায়গার প্রয়োজন পড়ে না। মজার বিষয় হচ্ছে এরা আকাশে ওড়ার প্রয়োজন বোধ করে না। খাঁচায় থাকতেই বেশি পছন্দ করে।
কবুতরের খাবার খরচ সম্পর্কে আরো জানা গেল, কবুতরের খাবার হছে গম, চাউল, কাউন, ধান, খুদ, সরিষা ইত্যাদি খায়। মুরগির জন্য তৈরি খাবারও কবুতর খায়। খাবারের সাথে পর্যাপ্ত পরিমান বিশুদ্ধ পানি দিতে হবে। ২ বাই ২ ফুট স্থানের মধ্যে দুটি কবুতর থাকতে পারে। কবুতরের বাসস্থান কুকুর, বিড়াল, বেজী ইত্যাদি প্রাণী থেকে দূরে রাখতে হবে। কবুতরের ঘরে যাতে পানি না আসে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
কবুতরের দর দাম সম্পর্কে আব্দস সামাদ এ প্রতিবেদককে জানালেন, জাত ভেদে এদের এক এক জোড়া বাচ্চার দাম ১ হাজার টাকা থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া বড় আকারের কবুতর কিং জাত বিক্রি হয় ১০ থেকে ২০ হাজার টাকায়, রিভার্স সুইং ইয়োলো পটার্স জাত বিক্রি হয় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায়, পমেরেনিয়ান জাত বিক্রি হয় ৮০ থেকে এক লাখ টাকা, ময়ুরী জাত ২ থেকে ৩ হাজার টাকায়, সিরাজী জাত ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায়, শাটিং জাত ২ হাজার টাকা জোড়া বিক্রি হচ্ছে।
এটা মানুষের নেশা, পেশা, সখ ও সময় কাটানোর অন্যতম মাধ্যম হিসাবে আজ পরিচিত। কবুতর প্রেমীদের সেই নেশা, পেশা ও ভাললাগার আর একধাপ এগিয়ে নিয়েছে সৌখিন কবুতর, এই সৌখিন কবুতর যে কত সুন্দর হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করা যাই না। আজ স্কুলের একজন ছাত্র থেকে শুরু করে অফিস আদালতে কর্মরত, সব উচ্চপদের মানুষ আজ এই কবুতর পালন কে শখ, নেশা যেটাই বলা হোক না কেন। আজ সবারই ভাললাগা ও ভালবাসার পাখিতে পরিনত হয়েছে এই কবুতর পালন। আজ সৌখিন কবুতর পালন শুধু সখ বা নেশা না। এটা অনেক বড় পেশাতেও পরিনত হয়েছে। আজকাল অনেক শিক্ষিত বেকার যুবকরা এই পেশায় নিজেদের কাজে লাগাচ্ছে।
কবুতরপ্রেমীদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন জানতে চাইলে তিনি জানান, কবুতরপ্রমীদের মধ্যে সর্ম্পকটা অনেক বড়। নিজেদের মধ্যে নিজেরা সমাদর করে ভাইয়ের মতো।
আব্দুস সামাদ কবুতরে জাত সম্পর্কে জানালেন, মাংস উৎপাদনের জন্য সিলভারকিং, হামকাচ্চা, ডাউকা, কাউরা, গোলা, গোলী, পক্কা, লক্ষা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। চিত্তবিনোদনের জন্য ময়ুুরপঙ্খী, সিরাজী, লাহোরী, ফ্যানটেইল, জেকোডিন, মুক, গিরিবাজ, টেম্পলারলোটন-এসব জাতের কবুতর রয়েছে। এছাড়াও আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য কবুতরের একটি জাত হচ্ছে ‘জালালী কবুতর’। এ নামটি হজরত শাহ্জালাল (রহ.) এর পুণ্য স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। এছাড়াও জেকোবিন, রিহভার্স সুইং ইয়োলো পটার্স, পমেরেনিয়ান, কিংসব বিভিন্ন জাতের কবুতর তিনি পোষেন।
কবুতরের অসুখ-বিসুখ কম। রোগেশোকে মারা যায়ও কম। তবে জোড়া মারা গেলে লস হয়। আবার জোড়া মিল করতে অনেক বেগ পেতে হয়। ঘটনাক্রমে হলুদ সিরাজীর জোড়া কবুতর ও ম্যাকপাইয়ের জোড়া থেকে নর মারা গেছিল।
৭ম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে কবুতর পোষার নেশাটা মাথায় চাপে। প্রায় ১৫ বছর ধরে কবুতর পালন করছি। লেখাপড়ার ক্ষতি হবে ভেবে প্রথমের দিকে পরিবার থেকে কবুতর পালনে বারণ করতো। কিন্তু আমি প্রমাণ করেছি পড়ালেখা কিংবা চাকুরী-বাকরী করেও কবুতর লালন করা যায় বলে জানালেন এই তরুণ কবুতরপ্রেমী। সিলেটে পড়ালেখা পাশাপাশি চাকুরী সবই সামলে রাখতেন অত্যন্ত দক্ষ হাতে। গ্রীণলাইন ট্রাভেলস্, কম্পিউটার সোর্সসহ দেশের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে আইটি বিভাগে কাজও করেছেন।
কবুতর সংগ্রহ করতে গিয়ে কড়াকড়ি অবরোধ, রেল দূঘর্টনাসহ বিভিন্ন ঘটনা আর অভিজ্ঞতার ঝুলিও কিন্তু সমৃদ্ধ আব্দুস সামাদের। রেল দূঘর্টনার মুখেও পতিত হন তিনি। ঢাকা থেকে এক জোড়া কবুতর সংগ্রহ করে ফেরার পথে উপবন এক্সপ্রেক্স লাইনচ্যুত হয়। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান তিনি।
স্কুলের সাবেক সহপাঠী শাহেন শাহ লিমন তার সতীর্থ সম্পর্কে বললেন, ছোট থেকেই কবুতর পালনে তার নেশার কথা জানতাম। কিন্তু সেই কবুতর পালনে আজকের এই অবস্থা আমরা কল্পনাও করিনি।
হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাতগঞ্জ ইউনিয়নের নাদামপুর গ্রামের নিবাসী মরহুম আব্দুল্লাহ মিয়া ও হাজেরা বেগমের সন্তান তিনি। চার ছেলে ও ৩ মেয়ের মধ্যে আব্দুস সামাদ সবার ছোট। এসএসসি পরীক্ষার সময় পিতা মারা যায়। সম্প্রতি সিলেটের মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ থেকে বি.এসসি (সম্মান) সম্পন্ন করেছেন।
লেখকঃ এসএমএ হাসনাত, বিএসএস (সম্মান), এমএসএস (সাংবাদিকতা), রাঃবিঃ/সম্পাদক মহাকালগড় বার্তা ও মানবাধিকার কর্মী। মোবাইল নাম্বারঃ ০১৭১০৮৭৪০০৪