তৃণমূলের বঞ্চিত নারীদের জন্য কাজ করতে চাই : কেয়া চৌধুরী
ইয়াহইয়া মারুফ : আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সিলেটে উইমেন্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির অনুষ্ঠানের নাম ছিল ‘খুলে যাক মনের জানালা’। নারী উদ্যোক্তরা খোলা মনে বলেছেন তাঁদের সমস্যা, পরামর্শ দিয়েছেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে সিলেট ও হবিগঞ্জের নারী আসনেরসাংসদ আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীও যেন ছিলেন একাত্ম। বলেছেন তিনিও। ‘আমি সিলেটের তৃণমুলের বঞ্চিত নারীদের জন্য কাজ করতে চাই। আপনারা আমাকে সহযোগিতা করবেন। তিনি বলেন, দেশের তথ্য অফিসের মাধ্যমে জানাযায় বর্তমানে প্রতিদিন শতকরা ৮৭% নারী পুরুষের চোখ ও মুখের এবং ৬৫% স্বামীর মাধ্যমে যৌন নিযার্তনের শিকার হয়। আমি সিলেটের এই সমস্ত তৃণমুলের নারীদের জন্য কাজ করতে চাই।’
অনুষ্ঠানে নানা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সাংসদ কেয়া বলেন, সিলেটে মহিলা সংস্থা ও কর্মজীবি জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য সরকারের কাছে দাবি করবেন বলেও আশ^স্থ করেন এবং সভায় এক নারী ক্রিকেটারের দাবি গ্রহন করে আগামী মাসে আন্তর্জাতিক মানের এক সেট ক্রিকেট সামগ্রী দানের প্রতিশ্রুতি দেন। কেয়া চৌধুরী আরো বলেন, সিলেটের নারীদের প্রত্যেকের আতœপ্রত্যয় থেকে যে কোন ধরনের নির্যাতন-নিপিরনের মোকাবেলা করতে হবে। নারীদের ভিতর একে অপরের প্রতি যে হিংসা আছে তা পরিহার করে একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসলেই নারী এগিয়ে আসবে।
সিলেট উইমেন্স চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রি প্রেসিডেন্ট স্বর্ণলতা রায়ের সভাপতিত্বে চলে অনুষ্ঠান। সঞ্চালনায় ছিলেন লুনা বেগম। খুলে যাক মনের জানালা’য় কথাবার্তায় খোলা হয় অনেক কথা। নারী-পুরুষ পার্থক্যের দিক থেকে না দেখে একজন নারীকে একজন মানুষ হিসাবে দেখুন। নারী উন্নয়ন নীতিমালা কার্যকর করে যথাযত ভাবে প্রয়োগ করতে হবে। নারী নির্যাতন বন্ধের জন্য আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বাজেটে নারীর জন্য বরাদ্ধ বাড়িয়ে ২শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করতে হবে, দেশের জনগনের অর্ধেকই নারী। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের নারী বান্ধব বিচারক ও পিপি নিয়োগ করতে হবে। নারীদের শিক্ষিত-সাবলম্বি করে গড়ে তুলতে হবে। বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে হবে। রাজনীতিতে নারীর অংশ গ্রহন বাড়াতে হবে। নারীকে সমাজের সর্বক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়। জন্মের পর থেকে বৈষম্যের শিকার। শিক্ষা, কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে এমনকি প্রতিদিন পেট ভরে খেতেও পারে না। দেশের ৩৬ শতাংশ নারী অপুষ্টির শিকার। ২০০৬-২০১৩ পর্যন্ত নারী-পুরুষের বৈষম্য পর্যালোচনা করে যা জানা গেছে তা হলো দশমশ্রেণীর নিচে পাঠরতা ছাত্রীর সংখ্যা ছাত্রদের থেকে ৯.৩৭ শতাংশ কম। পেশাগত যোগ্যতায় সমান হলেও উচ্চপদে স্থান হয় না। ১৬ থেকে ৩০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করার পরেও নারীরা ২৪.৯৬ শতাংশ কম বেতন পায় পুরুষের চাইতে। ৩১ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্না নারী পুরুষের চাইতে ৭৮৭৮.২৩ শতাংশ কম বেতনে উপার্জন করে। এটা হলো সংগঠিত ক্ষেত্রের কথা। অসংগঠিত ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থা আরও করুণ এবং ভয়াবহ। বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের ফলে নারীর কর্মসংস্থান অনিশ্চিত।
তারা বলেন, ২০১৩ সালের শ্রমদপ্তরের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় একজন কৃষক ২১২ টাকা মজুরি পেলে কৃষক রমণী পায় ১২৩ টাকা। বীজ রোপণ করার জন্য কৃষক যেখানে ১৮৫ টাকা পায়, কৃষক রমণী পায় ১৪৮ টাকা। ফসল তোলার ক্ষেত্রে পুরুষের মজুরি ১৭৯ টাকা, নারীদের ১৪৯ টাকা, কুপ খনন করার ক্ষেত্রে পুরুষের মজুরি ২৫৪ টাকা, নারীদের সেখানে ১৪৫ টাকা। অদক্ষ অকৃষিজীবী পুরুষের মজুরি ১৭৯ টাকা, নারীদের মজুরি ১৩৫ টাকা।
নারীর প্রতি হিংসার মাত্রা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়ার চিত্রও ওঠে আসে। দেশের প্রতিটি প্রান্ত থেকে প্রাপ্ত সংবাদ উপস্থাপন হয় অনুষ্ঠানে। প্রতি ঘণ্টায় নারীরা আক্রান্ত হচ্ছেন যৌন ও দৈহিক নিগ্রহের শিকার। ৩৮ শতাংশ নারীকে হত্যা করছে পরিচিত প্রিয়জনেরা। প্রতি তিন মিনিটে একজন নারীকে হত্যা করা হচ্ছে, প্রতি নয় মিনিটে একজন নারী নির্যাতিত হয় তার স্বামী অথবা আত্মীয় পরিজনের দ্বারা। প্রতি ২৯ মিনিটে নারী হচ্ছে ধর্ষিতা, প্রতি ৭৭ মিনিটে পণজনিত কারণে হত্যা করা হচ্ছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ২০১৩ প্রকাশিত হবার পর জানা গেছে ১৯৭১ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ৯০২ শতাংশ ধর্ষণের সংখ্যা বেড়েছে। ২০১০ সালে ধর্ষণ, শারীরিক নিগ্রহ এবং অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ২লাখ ১৩ হাজারের ওপর অর্থাৎ ৫৮৫টি ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। এই সংখ্যাটিও সঠিক নয় কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীরা পুলিশকে জানায় না। নীরবে কেঁদে জীবন অতিবাহিত করে। এ সব বিষয় থেকে নারীদের বের হতে হলে প্রয়োজন প্রত্যেক নারী তাকে সব সেক্টরে নারী হিসাবে নয় একজন মানুষ হিসাবে পরিচিত করে তুলতে হবে এবং পুরুষের কাছ থেকে সুবিদাভোগ করা থেকে বিরত থাকতে তবেই নারীরা সফলতা অর্জন করতে পারবে। ব্যতিক্রমী এই মত বিনিময় সভায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন সিলেট বিভাগীয় তথ্য অফিসের উপ-পরিচালক জুলিয়া যেসমিন মিলি, শাবির বাংলা বিভাগের সহযোগি অধ্যপক ফারজানা সিদ্দিকা, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সিলেট বিভাগীয় প্রধান সৈয়দা শীরিন আক্তার, সিলেট জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিলুফা আক্তার, সিলেট মহানগর পুলিশের এসি ফাল্গুনী পুরকাস্থ, সিলেট সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর শাহানারা বেগম, শামীমা স্বাধীন, ইটিভি ও দৈনিক সবুজ সিলেটের ফটো সাংবাদিক বিলকিস আক্তার সুমি, সিলেট মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সেক্রেটারী মারিয়া এনাম চৌধুরী, নারী অপরাজিতা উন্নত সমিতির পরিচালক জাহানারা রফিক, চারুকলা স্কুল ও বৈজ্ঞানিক জ্যোতি ভট্টাচার্য্য, নৃত্য শৈলা সিলেটের পরিচালক নীলঞ্জনা যুই, একতা টেনলার্সের পরিচালক রাহিমা জেরিন, ব্যবসায়ী রাবেয়া আক্তার রিয়া, সামছুন নাহার, বর্ণমালা নগর স্বাস্থ কেন্দ্র বাগবাড়ী সিলেটের ডা. সুস্মিতা দাস, সিলেট জেলা মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মিনা আক্তার মুক্তা প্রমুখ।