সংখ্যালঘু নির্যাতন ১৯৫০-২০১৫
দীপংকর গৌতমঃ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক আদর্শ জনপদ হিসেবে বাংলাদেশের সুনাম ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। দিন দিন এ সুনাম থেকে সরে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সাম্প্রদায়িক চেতনা যতোই বৃদ্ধি পাচ্ছে দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ততোই আক্রান্ত হচ্ছে তার প্রতিবেশী, পরিচিত বা প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো পক্ষের দ্বারা। প্রতিদিন গণমাধ্যমে কোনো না কোনো এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এই সঙ্কটের সৃষ্টি হয় ১৯৪৭ সালে ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে।
কলকাতায় দাঙ্গা লুটপাট শুরু হয়। সরকারি হিসাবে এই হত্যার পরিমান ছিল ১০ লাখ। বেসরকারিভাবে পরিমান হয়তো আরো বেশী। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলো বিনয়,বাদল, দিনেশ, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেনদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ব্রিটিশ দেশত্যাগের আগে মোহন লাল করমচাঁদ গান্ধী, জওহর লাল নেহেরু আর জিন্নাহ সাহেবকে নিয়ে মাউন্টব্যাটেন সাহেব যে বিষবৃক্ষ রোপন করলেন তার ক্ষত আজও বহন করতে হচ্ছে।
পুরানো হিংসা থামেনি আজও। বিশেষত ১৯৫০ সালে এ দাঙ্গা নোয়াখালী ও বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লো। কারণ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি মহল দাঙ্গা ছড়িয়ে দিতে খবর রটিয়েছিল যে, কোলকাতায় একে ফজলুল হককে হিন্দুরা মেরে ফেলেছে। ফলে তীব্রভাবে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় আক্রান্ত হয় হিন্দুরা। এটা ছিল পাকিস্তান সরকারের একটা পরিকল্পনা। সে সময় ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় ৯ দিনে মেরে ফেলা হয় দশ হাজার হিন্দুকে। এ দাঙ্গা শুরু হয়েছিল ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বরিশালের মাধবপাশার জমিদার বাড়ির ২০০ জন মানুষকে হত্যা করা হয়। এ এলাকার তীব্র আক্রান্ত গ্রাম হলো লাকুটিয়া এবং কাশিপুর। তবে সে সময়ে মুলাদীর নদী লাল হয়ে গিয়েছিল মানুষের রক্তে। মেরে ফেলা হয়েছিল ২৫০০ হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষকে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল বাড়িঘর। লুটপাট করা হয়েছিল সহায়-সম্পদ। ধর্ষণের শিকার হয়েছিল অসংখ্য নারী। দখল করা হয়েছিল অনেকের জমিজমা। এরা সবাই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের।
এরপর ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও এদেশীয় লুটারদের দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি লুটপাট, দখল করে। মুক্তিযুদ্ধের পরেও এ ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত ছিল আজও তা অব্যাহত। মানুষের প্রত্যাশা ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার এসব লুটারদের বিচার করবে, হিন্দু সম্প্রদায়ের দখলকৃত জায়গা উদ্ধার ও দখলকরীদের শাস্তি দেয়া হবে। হয়নি আজও। বরং অত্যাচার নির্যাতন বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো দলই পিছিয়ে নেই। কিন্তু বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। অত্যচার দিন দিন বাড়ছে অথচ আজও কোনো নির্যাতক বা দখলদারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি।
আজ ঘটনাক্রমে দিনাজপুরের কথা উল্লেখ করা যায়। দিনাজপুরের সাংবাদিক আজাদুল হক জুয়েল তার এলাকার সাংবাদিক ও বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষজন নিয়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি সংবাদ সম্মেলন করে দাবি তুলেছেন সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধের। দাবি তুলেছেন হামলায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও বিচারের। চিরিরবন্দর ও খানসামার ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘুদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবিও তুলেন তারা। এর সূত্র ধরেই এ লেখা। লেখার বিষয় দিনাজপুরে হলেও এ ঘটনার চিত্র এখন সারাদেশে। তাই সারা দেশের শান্তিকামী মানুষকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আসলে তাদের করণীয় কি?
দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা দিনাজপুর। এ জেলায় বহু সম্প্রদায়ের বসবাস। সমতলের আদিবাসী থেকে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, সাঁওতাল, ওঁরাও, হরিজন,ঋষি, ডোমসহ সব ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মিলন মেলা এই দিনাজপুর। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিকস্থ বিভিন্ন কারণে প্রায় দেড় দশক ধরে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো দিনাজপুর জেলায়ও দলিত ও সংখ্যালঘুদের উপর নির্বিচারে হামলার অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে এখন এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। প্রতিদিন কোননা কোনো জেলায় সংখ্যালঘু নির্যাতন, তাদের মন্দির ভাঙা, জোর করে জমি দখল করা এক ধরনের নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
এখন দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে দিনাজপুর কোনো আলাদা এলাকা নয়। ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বিরল উপজেলার মঙ্গলপুর ইউনিয়নে দলিত ও সংখ্যালঘুদের উপর ব্যাপক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। অথচ আজ অবধি তার কোনো বিচার হয়নি। ওই সময় ওই ইউনিয়নের রঘুনাথপুর, শিকারপুর, সরাহার, বড়োয়া বন্ধুগাঁওসহ বিভিন্ন গ্রামে বসবাসরত সংখ্যালঘুদের উপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়ে তখন ওইসব গ্রামের অনেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আর ফিরে আসেন নাই। এরপর আবার ২০১২ সালের ৪ আগস্ট চিরিরবন্দরের বলাই বাজারে এবং এর আশেপাশের গ্রামগুলোতে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের সংঘবদ্ধ হামলার ঘটনা আবারো দিাজপুরের অসাম্প্রদায়িক চেতনার গৌরব গাঁথা কলঙ্কিত হয়। সেই হামলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকের ঘর-বাড়িতে আগুন, লুটপাট, মারধর করা হয়। জনগণের প্রত্যাশা ছিল প্রশাসনের যথাযথ উদ্যোগ এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের কার্যকর প্রচেষ্টার মাধ্যমে সেই কলঙ্কের দাগ মুছে যাবে। কিন্তু সেই সব ক্ষততো মুছেই নাই বরং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রাজনৈতিক ইস্যুকে কেন্দ্র করে শান্ত ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিনাজপুরকে আরো অশান্ত করে তোলা হয়।
২০১৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে খানসামার ভাবকী ইউনিয়নাধীন রামনগর, ফোকাসাপাড়া, মণ্ডলপাড়া, কাচিয়ানী বাজার, কালির বাজার এবং চিরিরবন্দর উপজেলার ভুষিরবন্দর ও রানীরবন্দরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, ধানের পুঁজে এবং ধান ও আঁখ ক্ষেতে হামলা চালানো হয়। হামলাকারী দুর্বৃত্তরা তাণ্ডব চালিয়ে সেই রাতে গ্রামটির ফোকাসাপাড়া নিবাসী গৌরহরি শাহর ১০০ বিঘা জমির ১৬টি ধানের পুঁজসহ বাইরের খোলানে থাকা ৫টি ঘর, নিখিল চন্দ্র রায়ের ২টি শোয়ার ঘরসহ ঘরের সমস্ত মালামাল, নিরঞ্জন রায়ের দুইটি ঘরের সমস্ত মালামাল, রামনগর-মণ্ডলপাড়া নিবাসী ফনীন্দ্রনাথ রায়ের বাড়ি ও ধানের পুঁজে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সেই রাতেই ভুষিরবন্দরে ব্যবসায়ী ও দিনাজপুর জেলা মটর পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি ভবানী শংকর আগরওয়ালার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটতরাজ চালানো হয়। তার ৭টি ট্রকে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ২টি গোডাউন ভর্তি সারসহ কোটি টাকার মালামাল লুট করা হয়।
চিরিরবন্দরের ১১নং তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সুনীল কুমার সাহার ২০ বিঘা জমির ধান আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। হামলাকারীরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে বেদম মারধরও করে। তারা ৪নং খামারপাড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ বালাপাড়া বটেরহাটে অবস্থিত গৌরহরি শাহর হাসকিং মিলের মিটার, মর্টার ও বারান্দার চালা ভেঙে ফেলে। কালীর বাজারে অবস্থিত নিরঞ্জন রায়ের ওষুধের দোকান ভেঙে তছনছ করে। এই জঘন্য ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনের দিন নির্বাচনী ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুর্বৃত্তরা সংঘবদ্ধভাবে দিনাজপুর সদর উপজেলার কর্ণাই, সাহাপাড়া, তেলিপাড়া, প্রীতমপাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা চালায়। এখানে বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমর্থক কয়েকটি মুসলিম পরিবারসহ প্রায় দেড়শত সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা ৫ জানুয়ারি নির্বাচন চলাকালে হামলা চালায় চিরিরবন্দরের অকড়াবাড়ী (খোচনা), বীরগঞ্জের লাডডাবরাসহ আরো কয়েকটি এলকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে।
সংবাদ সম্মেলনে দলিত ও সংখ্যালঘুদের ওপর সকল ধরনের হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয় এবং হামলা ও নির্যাতনের সাথে জড়িত সকল দুর্বৃত্তকে গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করা হয়। খানসামার রামনগর, চিরিরবন্দরের রানীরব্দর, ভুষিরবন্দর, অঁকড়াবাড়ীর (খোচনা) ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘুদের অবিলম্বে ক্ষতিপূরণ প্রদান, কর্ণাইয়ের সংখ্যালঘু জনগণের প্রতি পরোক্ষ হুমকিদাতাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা, বিরলের মঙ্গলপুরে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গকে গ্রেপ্তার ও বিচার এবং নবাবগঞ্জ উপজেলার ঢুডু সরেনের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারসহ ও দলিত, নৃতাত্মিক, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে ভূমিদস্যুদের হাত হতে রক্ষার দাবি জানানো হয়। তারপরও কি এসব দুর্ঘটনার নাটেরগুরুদের কোনো বিচার হবে না?
এসব ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে অপকর্মের নায়কেরা আরো দুর্ঘটনা ঘটানোর অনুপ্রেরণা পাবে। তাহলে সেটাই কি ঠিক থাকবে? তার চেয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে বলে দিলেই তো হয় যে তোমরা এ দেশ থেকে চলে যাও। এর চেয়ে ভালো সমাধান আর কী হতে পারে?
লেখক পরিচিতি
দীপংকর গৌতম। কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক। জন্ম: কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কর্মরত। বাংলাদেশের বামপন্থি রাজনীতির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত। লিখেন দেশ-বিদেশের কাগজে। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের জন্য পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার। ই-মেইল: [email protected]