কবি আল মাহমুদের সাথে এক সন্ধ্যায়
॥ সুলায়মান আল মাহমুদ ॥
শরৎ এর সেই দিনটি ছিল মেঘাচ্ছন্ন। বুকফাটা খাঁ খাঁ রৌদ্রময় সময়ের এই দিনে সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। এমনই বৃষ্টিবাদল দিনেই পর্যায়ক্রমে একে একে নবীন প্রবীন লেখক কবি সাহিত্যকদের মিলনমেলায় পরিনত হয়েছিল সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অপরূপ লীলাভুমি এক্সেলসিয়র হোটেল এন্ড রিসোর্ট সেন্টার। সবার মনে একটাই কৌতুহল আজ হাতে কলমে সাহিত্য সম্পর্কে শিক্ষা দিবেন বাংলাদেশের প্রধান কবি আল মাহমুদ। বয়সের ভারে ন্যুজ হলেও কথায় আজো তরুন ক্ষনজন্মা এই কবির কথায় যেন তারুন্যের ছাপ। সবার উৎকন্ঠার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে মঞ্চে আসেন পল্লী বাংলার কৃতি কবি। তাঁকে এক পলক দেখতে খুব ছোট্ট পরিসরের আয়োজনে শুরু হয় সাহিত্যপ্রেমীদের উপচে পড়া ভীর।
বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক এডভোকেট আব্দুল মুকিত অপির সাবলীল প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় শুরু হয় সিলেটবাসীর ঐতিহ্যের দিন কবি আল মাহমুদ সন্ধ্যার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আল মাহমুদ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অনুষ্ঠানের প্রধান আয়োজক সাঈদ চৌধুরী। আমি যখন কবিকে দেখতে মগ্ন ঠিক সেই সময় উপস্থাপক শ্রদ্ধাভাজন আব্দুল মুকিত অপি ভাই অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করার জন্য মাইকে আমার নাম ঘোষনা করলেন। তো আর কি করা আমি তেলাওয়াত করলাম। সেদিন কবি আল মাহমুদের প্রতিটি কথা ছিল সাহিত্যের জন্য একেকটি আদেশ। যারা তা মানতে পারবে তারা জীবনে সাহিত্য চর্চা থেকে বিমুখ হবেনা। দেশের এই প্রধান কবির সেদিনের কথাগুলো সবার কেমন আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল তা হয়তো বলতে পারবনা। তবে আমার মত একজন নগন্য লেখকের মনে দাগ কেটেছিল। তারপর কেটে গেছে কয়েকটি মাস লিখব লিখব করে আর লেখা হলনা। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম না আর সময়ক্ষেপন নয় কবিকে নিয়ে জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ট একটি সন্ধ্যার কথা লিখবই। তাই কিছুদিন পর হলেও লিখতে বসলাম। সময়ক্ষেপনের জন্য আমি দুঃখিত।
অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে শুরু হল বক্তৃতা পর্ব। একে একে বক্তব্য রাখেন সিলেট প্রেসকাবের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক পুণ্যভূমি সম্পাদক মুক্তাবিস-উন-নূর, এমসি কলেজের সাবেক অধ্যাপক শিল্পী আজিজুর রহমান লস্কর, দৈনিক জালালাবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আজিজুল হক মানিক, কবি মুকুল চৌধুরী, সময় টুয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র রিপোর্টার কবি নিজাম উদ্দিন সালেহ, কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সহকারী সম্পাদক গল্পকার সেলিম আউয়াল, দৈনিক জালালাবাদের নির্বাহী সম্পাদক আবদুল কাদের তাপাদার, বিশ্ববাংলা সম্পাদক কবি মুহিত চৌধুরী, প্রবাসী কবি তাদেবার রসুল বকুল প্রমুখ। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন এেেক্সলসিয়র সিলেটের চেয়ারম্যান শাহ জামাল নুরুল হুদা, ডাইরেক্টর আব্দুল লতিফ জেপী ও মার্কেটিং ডাইরেক্টর আহমদ আলী। কবি আল মাহমুদের জীবনী তুলে ধরেন লেখক এডভোকেট রফিক আহমদ চৌধুরী। গণশিল্পী মিছবাহ উদ্দিন ও তরুন কন্ঠ শিল্পী শালিন আহমদের মধু মাখা কন্ঠে গাওয়া সংগীত উপস্থিত সবাইকে দেয় আনন্দ। কবি আল মাহমুদকে নিয়ে নিবেদিত কবিতা ও কবির বই থেকে আবৃত্তি করেন কবি প্রভাষক নাজমুল আনসারী, কবি মাসুদা সিদ্দিকা রুহী, ইশরাক জাহান জেলি, শামীমা কালাম, মিনহাজুর রহমান ফয়সল, মুসা আল হাফিজ, নাঈমা চৌধুরী, জালাল আহমদ জয়, সাহাব উদ্দিন আহমদ প্রমুখ।
উৎসবে উল্লেখযোগ্য লেখক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের মধ্যে যারা অংশগ্রহণ করেন, খলীলুর রহমান কাশেমী, আব্দুল মালিক জাকা, হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, এমদাদ হোসেন চৌধুরী দিপু, জাহেদুর রহমান চৌধুরী, জিন্নুরাইন চৌধুরী, এখলাছুর রাহমান, শাহাদাত আলিম, ইছমত হানিফা চৌধুরী, ইলিয়াস উদ্দিন আহমদ, আমেনা শহীদ চৌধুরী মান্না, তাজুল ইসলাম, শাহ সুহেল আহমদ, এম রহমান ফারুক, বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল, জসীম আল ফাহিম, এমজেএইচ জামিল, উম্মে সুমাইয়া চৌধুরী নীলা, তাসলিমা খানম বীথি, শাহ মিজান ইবনে আজিজ, মাহমুদ পারভেজ, মামুন হোসেন বিলাল, রিমা বেগম পপি, জান্নাতুল শুভ্র মনি, মীম হুসাইন, মীম সুফিয়ান, মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, শাহাব উদ্দিন, কানিজ আমেনা কুদ্দুস, লুৎফুর রহমান তোফায়েল, কামরুজ্জামান হেলাল, নাসির উদ্দিন, রাফিদুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ মুজাদ্দিদ, আরিফ, আব্দুল কাদির জীবন, রাসেল আহমদ, বদরুল ইসলাম চৌধুরী, মঈন উদ্দিন, আনসার আহমদ, ফয়জুর রহমান, জহিরুল আলম, জাবির আহমদ, আজমল হোসেন প্রমুখ।
২০১৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন এর শরৎকালিন কবিতা উৎসবে সেদিন দেশের প্রধান কবি আল মাহমুদ যে কথাগুলো সিলেটের কবি সাহিত্যিকদের উৎসাহিত করেছিল তার চুম্বক অংশগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র। তিনি বলেছিলেন, যারা সাহিত্যের জন্য প্রাণ উজাড় করেছেন আমি তাদের ভালোবাসি, তাদেরকে অভিনন্দন জানাই। সাহিত্য মানুষকে উদার ও মহৎ করে। কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয় না। মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে মনুষ্যবোধ। যেখানে হীনমন্যতা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কবি-সাহিত্যিকরা মানুষের মন ও মননকে জাগিয়ে তুলেন। তিনি বলেন, ভাল সাহিত্যিক হতে হলে প্রচুর পড়ালেখা করতে হবে। লেখককে গ্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পর্কে জেনে জগতের অনেক রহস্য উদঘাটন করতে হবে। দেশে ও বিদেশে ঘুরে বেড়াবার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে গল্পের জাদুকর আল মাহমুদ যখন শব্দের জ্ঞাত অর্থের অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে কাব্যরসে সিক্ত করেন উপস্থিত শতাধিক কবি-সাহিত্যিককে। তখন এক্সেলসিয়রের প্রাকৃতিক সুষমা মন্ডিত পরিবেশে তরুন লেখক-লেখিয়েদের উপচে পড়া ভীড় হলরুম পেরিয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। তারা সকলেই ৮০ বছরের এই প্রবীন কবির কথা শুনছিলেন উন্মুখ হয়ে। কবি বললেন, বিচিত্র এই জগতকে জানতে সবার মধ্যে জ্ঞানার্জনের পিপাসা থাকতে হবে। তিনি জোর দিয়ে বললেন, পিপাসার অর্থ তৃষ্ণা নয় । আরো বেশী কিছু, যেন বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
সভাপতির বক্তব্যে উৎসবের অন্যতম আয়োজক সাঈদ চৌধুরী বলেন, আল মাহমুদের মত উঁচু মানের কবি বাংলাদেশে জন্মেছেন এটা আমাদের জন্য গর্বের আনন্দের। এত বড় মাপের লেখক সবসময় সব দেশে জন্মায়না। তার ব্যাপক সাহিত্য ভান্ডার বিভিন্ন ভাষায় বিশ্বময় ছড়িয়ে দেবার প্রত্যাশা নিয়ে লন্ডনে আল মাহমুদ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সকলের সহায়তায় ঠিকমত কাজটি করতে পারলে আল মাহমুদও বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পেতে পারেন।
দেশের প্রথিতযশা প্রধান কবি আল মাহমুদকে নিয়ে কয়েক ঘন্টার এই কবিতা উৎসব সিলেটের সাহিত্যাঙ্গনের জন্য ছিল একটা মাইলফলক। পরদিন যখন পত্রিকায় আল মাহমুদ সিলেট আসার খবর ছাপা হয় তখন অনেক কবিই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এতবগ একজন ব্যাক্তি সিলেট আসলেন অথচ সবাই জানলনা। আয়োজকগন অবশ্যই দু:খপ্রকাশ করে বলেছেন স্বল্প সময়ের প্রস্তুতি ও কবির শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনা করেই আয়োজনটি সংক্ষিপ্ত করা হয়েছিল। একদিন পর সিলেট ছেড়ে চলে যান প্রিয় কবি আল মাহমুদ। সিলেটবাসীকে দিয়ে যান সাহিত্যের অফুরন্ত ভান্ডার রক্ষা লালনের দিকনির্দেশনা। দিনটি সংঘত কারনেই অনেকের মত আমার জীবনেরও একটা স্মরনীয় ঐতিহাসিক দিন। সেদিনের মন থেকে দোয়া করেছি আল্লাহ সত্য ও সুন্দরকে তুলে ধরার জন্য প্রিয় কবিকে সুস্থ রাখ বাচিয়ে রাখ। তাঁর প্রয়োজন জাতির জন্য কখনো ফুরাবার নয়। কোন দিন না।
লেখক : কণ্ঠশিল্পী ও কলাম লেখক।
যোগাযোগ : ০১৭১১-৬৬৮৪৩৬