অশ্লীলতা আর সহস্রাধিক জুয়ার আসরে জমজমাট শেরপুরে মাছের মেলা
শিপন আহমদ, ওসমানীনগরঃ “গাছে ফল ধরেছে/লোকের নজর পড়েছে/হায়রে কাঁচা এ ফল ওরা বুঝি পাঁকতে দেবে না/আমি বেড়া দিয়েছি /বাগান আগলে রেখেছি/ পোলাপানরা শান্তিতে আর থাকতে দেবে না।’ এমন উত্তেজক গানের শুরুতেই ১৮-১৯ বছরের এক তরুণী সস্তা মেকাপে মঞ্চে এসে নাচ শুরু করলেন। গানের এক মিনিট অতিবাহিত হবার পরই মঞ্চে নাচরত তরুণীটি শরিরীরে পোষাক একে একে খুলতে শুরু করে। গানের ৩ মিনিটের মাথায় তার শরিরের সমস্ত পোশাক খুলে একেবারে উলঙ্গ নাচ করেন। গানের শেষে ওই তরুণী উলঙ্গ অবস্থায় মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলো দর্শকদের চিৎকার “আবারো তাদের ওই নাচ চাই”। শুরু হলো দ্বিতীয় গান। আবারও একই দৃশ্য। দৃশ্যগুলো গত সেমাবার রাতে শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলার পুতুল নাচের প্যান্ডেলের ভেতরের।
এ দৃশ্য শুধু একদিনের নয়, গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথম থেকে এলাকার প্রভাবাশালী আ’লীগ নেতা অলিউর রহমান ওরফে দালাল অলির নেতৃত্বে শেরপুরে বিজয় মেলার নামে এ ধরনের বেসামাল অশ্লিলতা-গান, জুয়া চলেছে। সেই সঙ্গে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকেই র্যাফেল ড্র, হাউজি বাম্পারসহ চলে লাখ লাখ টাকার রমরমা জুয়ার আসর। বাড়ছে মাদকের ছড়াছড়ি। উঠতি বয়সী কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী আর হাজার হাজার যুবকের আড্ডায় জমে ওঠা গভীর রাত পর্যন্ত শেরপুর এলাকার মাছের মেলা ও বিজয় মেলা প্রাঙ্গন এখন শুধুই অশ্লীলতার আগ্রাসন।
জানা যায়, জুয়া, অশ্লিলতা, মাদকের ছড়াছড়ির আর অসামাজিক কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে গত সোমবার রাতে থেকে চলছে সিলেটের শেরপুরের ঐতিহ্যবাহি মাছের মেলা। প্রাচীনকাল থেকে বড় বড় মাছ কেনা বেচার জন্য এ মেলা প্রসিদ্ধতা লাভ করে আসলেও গত কয়েক বছর থেকে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা অলিউর রহমান অলি ইজারাদার হওয়ায় জুয়া, অশ্লিল নিত্য ও বিভিন্ন অসামাজিকতার মেলায় পরিণত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা।
জাতীয় সংসদের সাবেক চীপ হুইপ আবদুস শহীদের অনুসারী এ নেতা এলাকার অসামাজিকতার হোতা। বড় অংকের টাকার বিনিময়ে মৌলভীবাজার পুলিশ প্রশাসনের বড় কর্তাদের হাত করে স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্পের কর্মরতদের অসামাজিক কার্যকলাপের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রেখে জুয়া, চলছে এ মেলায় । এলাকার সচেতন মহল অনেক সময় প্রতিবাদ মুখি হয়ে উঠলেও শেরপুর পুলিশ ক্যাম্পের এসআই জামির হোসেন জিয়াকে দিয়ে প্রতিবাদকারী ব্যাক্তিকে মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে এসব অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে স্থানীদের অভিযোগ।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এলাকার বেশ কয়েকজন জানান, শুধু মেলায় অসামাজিকতা নয় শেরপুর এলাকায় যত অসামাজিকতা হয়ে থাকে সবই অলির নেতৃত্ব ঘটে। জনগনের নিরাপত্তার দায়িত্বে শেরপুরে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হলেও উক্ত ক্যাম্পের অলিখিত অফিসার হয়ে উঠেছেন আওয়ামীলীগ নেতা অলি। প্রতি বছরের মতো এবারও সিলেট-মৌলভীবাজার-হবিগঞ্জ জেলার মিলনস্থল কুশিয়ারা নদীর উত্তর তীর শেরপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের পৌষ সংক্রান্তিকে সামনে রেখে গত সোমবার থেকে ৩দিনব্যাপি মাছের মেলা শুরু হয়েছে। কিন্তু নামে মাছে মেলা হলেও কাজে জুয়া আর পুতুল নাচের নামে তরুণীদের দিয়ে অশ্লীল নৃত্যর মেলা বসিয়েছেন অলি ও শেরপুরস্থ শ্যামলী কাউন্ডারের জাহাঙ্গির। অশ্লিল নৃত্যর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে টিনশেড দিয়ে তৈরী প্রায় অর্ধ শতাধিক নাচের ঘর। এসব ঘরে উঠতি বয়সের মেয়েদের নিয়ে উলঙ্গনৃত্য পরিবেশন সহ নাচ গানের পর শেষ রাতে এসব মেয়েদের মাধ্যমে চলে অসামাজিকতা।
জুয়ার জন্য খোলামেলাভাবে বসেছে সহস্রাধিক হাজার আসর। পাশাপাশি মদ, গাজা, হেরোইন ও ফেনসিডিল এর বিশেষ ব্যবস্থা। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনে এমন অসামাজিকতা চললেও প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করছে।
অন্যদিকে মেলাস্থল থেকে ৫০ গজের ভিতর রয়েছে পুলিশ ক্যাম্প। এলাকাবাসীর অভিযোগ পুলিশ এসব অপকর্মের পাহাড়াদার হিসেবে কাজ করছে। এমনটি না হলে এসব অপকর্ম কেন বন্ধ হচ্ছে না এমন প্রশ্ন এলাকাবাসীর। প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে গত দুই বছর ধরে মাছের মেলায় আয়োজকদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন যাত্রাদলকে পুতুল নাচের অনুমতি দিয়ে থাকেন ইজারাদাররা। আর এসব যাত্রাদল মেয়েদের উলঙ্গনৃত্য দেখিয়ে এবং জুয়া খেলা থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেন ইজারাদাররা।
তাদের এ অশ্লীল নৃত্য প্রদর্শনির টিকিটের অধিকাংশই উঠতি বয়সের তরুণদের হাতে দেখা যায়। টিকিটের মূল্যে ১০০ থেকে ৫০ টাকা ধরা হয়েছে। পুতুল নাচের প্রতিটি প্যান্ডেল থেকে মেলা কমিটি অগ্রিম ৬০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। প্রতিটি জুয়ার আসর থেকে ২০ হাজার টাকা করে অগ্রিম নেয়া হয়েছে।
মেলায় আসা সিলেটের আবুল কালাম জানান, মেলায় এসেছিলাম একটি মাছ কেনার জন্য। কিন্তু এখানে এসে যা দেখলাম সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
একাধিক পুতুল নাচের দলের প্রধানের সাথে আলাপ করে জানা যায়, প্রতিটি পুতুল নাচের পেন্ডেল থেকে অগ্রিম ৬০ হাজার টাকা করে নিয়ে গেছেন ইজারাদার দলের অলিউর রহমান ও জাহাঙ্গির আলম। প্রতিটি জুয়ার আসরের মালিকদের কাছ থেকে অগ্রিম নিয়েছেন ২০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে মেলাকে কেন্দ্র করে আয়োজকরা প্রায় কোটি টাকা আয় হবে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেরপুরের একজন ব্যাবসায়ী জানান, প্রশাসনের সহযোগীতায় ইজারাদাররা যেমন খুশি তেমন করে এ মেলায় অশ্লিলতা সহ অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে ইজারাদার দলের প্রধান অলিউর রহমান অলি বলেন, অশ্লিলতার ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। মেলা পরিচালনা কারী (লেসির) সাথে যোগাযোগ করেন বলেই অপরপ্রান্ত থেকে মোবাইলের লাইন কেটে দেন।
মেলা পরিচালনাকারি দলের সভাপতি (লেসি) আশরাফ আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলেন তিনি বলেন, মেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এর মধ্যে নিত্যও আছে। তবে অশ্লিল নিত্য প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এগুলো আমাদের নয়। তবে মেলায় অশ্লিলতা কারা করছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা প্যান্ডেল সাব লিজ দিয়ে দেই। তারা করে থাকতে পারে। বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, শুধু মাছের মেলায় নয় শেরপুরে দীর্ঘদিন ধরে বিজয় মেলার নামেও অশ্লিল নৃত্য চালিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালি চক্র। এসব অসামাজিকতা বন্ধ করার জন্য আমি প্রশাসনের প্রতি সুপারিশ করেও কোন কাজ হয়নি। আমি উক্ত অসমাজিক কার্যকলাপের নিন্দা জ্ঞাপন করছি।
এ প্রসঙ্গে মৌলভীবাজার মডেল থানার অফিসার ইনচার্য আব্দুল ছালেকের মোবাইল ফোনে কল দেয়া হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
মৌলভীবাজার জেলার পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমদ বলেন, মেলা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। এখনই বিষয়টি খোজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।