মানবতাবিরোধী অপরাধে আজহারুলের ফাঁসির দণ্ডাদেশ
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
তার বিরুদ্ধে আনিত ছয়টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩টি অর্থাৎ ২, ৩ এবং ৪ নম্বর অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড, অপর ২টি অভিযোগে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৫ নম্বর অভিযোগে ২৫ বছর এবং ৬ নম্বর অভিযোগে ৫ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে ১ নম্বর অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোরুল হক।
বেলা ১১টা ১৮ মিনিটে এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলার রায় পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। ১৫৮ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়া হয়। রায়ের প্রথম অংশ পাঠ করেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক। দ্বিতীয় অংশ পাঠ করেন বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন এবং সর্বশেষে রায়ের মূল অংশ পাঠ করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।
শুরুতে সংক্ষিপ্ত সূচনা বক্তব্য দেন তিনি।
তিনি বলেন, আজ এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলার রায় ঘোষণা হবে। রায়ের বিরুদ্ধে কোনো সহিংস কর্মসূচি আমরা আশা করি না। আবার বিশেষ রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে বিচারকদের ওপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করাও উচিত না।
এর আগে রায় ঘোষণা উপলক্ষে সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কঠোর নিরাপত্তায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে পুরাতন হাইকোর্ট এলাকায় স্থাপিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। এরপর ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় রাখা হয় তাকে। পরে সেখান থেকে ১০টা ৫০ মিনিটে তাকে আসামির কাঠগড়ায় তোলা হয়।
আসামি আজহারুল ইসলামের পড়নে ছিল টিয়া রঙের পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা। পাঞ্জাবির ওপর পরেছেন অ্যাশ কালারের একটি স্যুয়েটার। চোখে চশমা ও পায়ে ছিল খয়েরি রঙের সু (জুতা)। কাঠগড়ায় তাকে বেশ স্বাভাবিক দেখা গেছে।
সাক্ষ্য, জেরা ও উভয়পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়েছিল। অপেক্ষমাণ রাখার ১০৩ দিন পর এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।
এটি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ১৫তম রায়। একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল- ১ এবং ২ বেঞ্চ এর আগে ১৪টি মামলার রায় দিয়েছেন।
এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৬টি অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন :
অভিযোগ-১ : ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভাসানী (ন্যাপ) নেতা ও রংপুর শহরের বিশিষ্ট আয়কর আইনজীবী এওয়াই মাহফুজ আলীসহ ১১ জনকে অপহরণ, আটক, শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এরপর তাদের ৩ এপ্রিল রংপুর শহরের দখিগঞ্জ শ্মশানে নিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ-২ : ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল আজহারের নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ধাপপাড়ায় ১৫ জন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে গুলি করে হত্যা, গণহত্যা, বাড়িঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেন।
অভিযোগ-৩ : ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল রংপুরের বদরগঞ্জের ঝাড়–য়ারবিল এলাকায় লুণ্ঠন ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং গণহত্যা চালিয়ে ১ হাজার ২শ’রও বেশি নিরীহ মানুষকে হত্যা করেন।
অভিযোগ-৪ : ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কারমাইকেল কলেজের চারজন অধ্যাপক ও এক অধ্যাপকের স্ত্রীকে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে অপহরণ করে দমদম ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেন।
অভিযোগ-৫ : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে রংপুর শহর ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন বয়সের নারীদের ধরে এনে টাউন হলে আটক রেখে ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতন করেন। একই সঙ্গে নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিদের অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যার উদ্দেশ্যে গুরুতর জখম, হত্যা ও গণহত্যা চালানো হয়।
অভিযোগ-৬ : ১৯৭১ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রংপুর শহরের গুপ্তপাড়ায় এক ব্যক্তিকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। ১ ডিসেম্বর রংপুর শহরের বেতপট্টি থেকে একজনকে অপহরণ করে রংপুর কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে নিয়ে আটক রেখে নির্যাতন ও হত্যার উদ্দেশ্যে গুরুতর জখম করেন।
এরআগে আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিলে তদন্ত কাজ শুরু করেন তদন্ত কর্মকর্তা এস এম ইদ্রিস আলী। তদন্ত চলাকালে ট্রাইব্যুনাল-১ এর নির্দেশে ২০১২ সালের ২২ আগস্ট মগবাজারের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সেই থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ২০১৩ সালের ৪ জুলাই তদন্ত শেষ করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে অভিযোগ দাখিল করে। এরপর প্রসিকিউটর ১৮ জুলাই ট্রাইব্যুনালে আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন। ৪টি ভলিউমে ৩০০ পৃষ্ঠায় দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগে আজহারুলের বিরুদ্ধে ৬টি অভিযোগ আনা হয়। ওই বছরের ১২ নভেম্বর আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। ২৬ ডিসেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। আজহারুলের বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষে প্রসিকিউশনের ১৯ জন সাক্ষী তাদের জবানবন্দি পেশ করেছেন। তাদের মধ্যে সপ্তম সাক্ষী আমিনুল ইসলামকে বৈরী ঘোষণা করেছে প্রসিকিউশন। আসামির পক্ষে একমাত্র সাফাই সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি পেশ করেন আনোয়ারুল হক।
১৮ আগস্ট থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত এবং সর্বশেষ ১৮ সেপ্টেম্বর আসামির বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষ এবং ২৭ আগস্ট থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আসামিপক্ষ।
উভয়পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ১৮ সেপ্টেম্বর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখার আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। অপেক্ষমান এই আজ রায় ঘোষণা করা হয়।