মাথায় আঘাত ও পানিতে ডুবে শিশু জিয়াদের মৃত্যু
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ মাথায় আঘাত ও পানিতে ডুবে শিশু জিহাদের মৃত্যু হয়েছে ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. হাবিবুজ্জামান চৌধুরী এ কথা জানিয়েছেন। রোববার সকালে শিশু জিহাদের মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মৃতদেহ দাফনের জন্য গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর আগে গত শনিবার বিকেলে প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর উদ্ধার করা হয় শাহজাহানপুর রেলওয়ের কলোনিতে গভীর নলকূপে পড়ে যাওয়া শিশু জিহাদকে। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযান স্থগিত ঘোষণার কয়েক মিনিটের মাথায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা জিয়াদকে মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে, মৃত্যুর ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও রেলওয়ের প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে শনিবার রাতে শাহজাহানপুর থানায় মামলা দায়ের করেছেন নিহতের বাবা। পরিত্যক্ত নলকূপের কয়েকশ ফুট গভীর পাইপে পড়ে যাওয়ার সময় মাথায় আঘাত পেলেও পানির কারণে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শিশু জিহাদের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা।
গতকাল রোববার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চার বছর বয়সী শিশুটির লাশের ময়নাতদন্তের পর হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুজ্জামান চৌধুরী এ কথা জানান। তিনি বলেন, ছেলেটির মাথার ভেতরে ও বাইরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে পাইপে পানি ছিল। আমাদের ধারণা হয়েছে, পাইপে পড়ে যাওয়ার দুই ঘণ্টার মধ্যে পানিতে ডুবে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে শিশুটির মৃত্যু হয়েছে।হাবিবুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ কে এম শফিউজ্জামান ও প্রভাষক প্রদীপ কুমার বিশ্বাস ময়নাতদন্তে অংশ নেন।
শাহজাহানপুর থানার এস আই আবু জাফর জানান, ময়নাতদন্ত শেষে রোববার সকাল পৌনে ১০টার দিকে শিশুটির লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। জিহাদের মা খাদিজা আক্তার ও বাবা নাসির ফকির ময়নাতদন্তের সময় হাসপাতালেই অপেক্ষা করেন। শিশুটির মামা মনির হোসেন জানান, জিহাদকে তারা শরীয়তপুরের ডামুড্যায় গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই তাকে দাফন করা হবে। গত শুক্রবার বিকালে শাহজাহানপুর রেল কলোনির মাঠে পরিত্যক্ত একটি গভীর নলকূপের ১৪ ইঞ্চি ব্যাসের খোলা মুখ দিয়ে কয়েকশ ফুট গভীর পাইপে পড়ে যায় জিহাদ।
২৩ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা শনিবার বিকাল ৩টায় জানান, তারা পাইপে জিহাদের কোনো খোঁজ পাননি। কিন্তু এর দশ মিনিটের মাথায় একদল উদ্যমী স্বেচ্ছাসেবী হাতে তৈরি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ওই পাইপ থেকেই জিহাদকে তুলে আনেন।
তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক জানান, অনেক আগেই শিশুটির মৃত্যু হয়েছে।শনিবার জিহাদের লাশের সুরৎহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন শাহজাহানপুর থানার উপ পরিদর্শক আবু জাফর।তিনি বলেছিলেন, ওর মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশের চামড়া ছিলে গিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে পাইপের ভেতর অক্সিজেন না থাকায় তার মৃত্যু হয়েছে।কখন সে মারা গিয়ে থাকতে পারে এমন প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, এগুলো চিকিৎসক ভালো বলতে পারবেন।
এদিকে, শিশু জিহাদের উদ্ধার তৎপরতার মধ্যে পাইপে তার অবস্থান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে সমালোচনার মুখে পড়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। অভিযোগ ওঠেছে, ওই মন্তব্যের পরই উদ্ধার তৎপরতা শিথিল হয়ে পড়েছিল। কেউ কেউ আক্ষেপ করেছেন, মন্ত্রী দায়িত্বহীন বক্তব্য না দিলে হয়তো সব ঠিকঠাক থাকতো, জীবিত জিহাদকে পেত স্বজনরা।ঘটনাস্থল ছাড়াও ফেইসবুক ওই বক্তব্যের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অসংখ্য মানুষ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগের পাশাপাশি ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্টদের বিচারও চেয়েছেন তারা।
শুক্রবার বিকালে শাহজাহানপুর রেল কলোনির পরিত্যক্ত একটি গভীর নলকূপের পাইপে চারবছর বয়সী শিশু জিহাদ পড়ে যাওয়ার পর প্রায় ২৩ ঘণ্টা ধরে চলে রুদ্ধশ্বাস অভিযান। পাইপের ভেতরে চটের বস্তা, দড়ি, ক্যামেরা নামিয়ে চলে জিহাদকে উদ্ধারের চেষ্টা।ক্যামেরায় পাইপের ভেতরে মানবদেহের অস্তিত্ব না পাওয়ার কথা ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানোর পর শনিবার ভোররাতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল পাইপে জিহাদের অবস্থান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, আমার মনে হল, এখানে কেউ নাই। তারপরও সেখানে যে আবর্জনা আছে, তা তুলে দেখা হবে। ফায়ার সার্ভিসের ডিজি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবেন। তবে আমি নিশ্চিত, এখানে কোনো মানুষ নেই।তারও ১১ ঘণ্টা পর শনিবার দুপুরের পর পাইপে জিহাদ নেই বলে ফায়ার সার্ভিস অভিযান সমাপ্ত ঘোষণার কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েক তরুণের প্রচেষ্টায় জিহাদকে পাইপের ভেতর থেকে তুলে আনা হয়। পরে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয় হাসপাতালে।
ইমেজ প্রসেসিংয়ে পড়াশোনা থাকা এই শিক্ষক বলেন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ঘটনাস্থলে আসার পর ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা তাকে একটি মনিটরে কি যেন দেখালেন। এরপর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পাইপে শিশুটির অবস্থান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। এরপরই ফায়ার সার্ভিস উদ্ধারকাজ শিথিল করে ফেলে। উপস্থিত অনেক সাংবাদিক ঘটনাস্থল থেকে চলে যান।ফায়ার সার্ভিস বলেছে তারা পাইপে অক্সিজেন সরবরাহ করেছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সংশয় প্রকাশের পর কিছু সময়ের জন্যও যদি অক্সিজেন বন্ধ রাখা হয় তবে শিশুটির বাঁচার কথা না। একজন জনপ্রতিনিধির এ ধরনের ভূমিকা কাম্য নয়। তার সংশয় প্রকাশের পরই গোলমালটা বাঁধে। যদি এমনটি না ঘটত, তাহলে হয়ত রাতেই জিহাদকে জীবন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হত।
উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস ইনফ্রারেড ক্যামেরা ব্যবহার করলে অবশ্যই শিশুটির অবস্থান শনাক্ত করা যেত। এটি কোনো রকেট সায়েন্স না, আমাদের দেশে নিশ্চয়ই এমন ক্যামেরা আছে। তাহলে কেন তার ব্যবহার হলো না?
ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা সেখানে একটি স্পেশাল স্কোয়াড বসাতে পারত, কীভাবে কাজ করে শিশুটিকে জীবন্ত উদ্ধার করা সম্ভব সেটি নিয়ে বিভিন্ন দেশের উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে ডিভিও কনফারেন্স করতে পারত, কারো সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে পরামর্শ নিতে পারত। তাদের সেই রকম কোনো ধরনের উদ্যোগ চোখে পড়েনি।প্রশিক্ষিত একটি বাহিনীর দড়ি নিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে কাজ করায় বিস্ময় প্রকাশ করেন সাহেদুর রহমান।
অবশ্য পাইপে শিশুটির অবস্থান নিয়ে সংশয় প্রকাশের কথা স্বীকার করলেও উদ্ধার অভিযান বন্ধ করতে বলেননি বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।তিনি বলেন, শনিবার ভোররাতে ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস আমাকে ডেকে নিয়ে ক্যামেরা দেখালো, মনিটর দেখালো। জীবন্ত কিছু তখন ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছিল না।
আমি চলে যাওয়ার পরও ফায়ার সার্ভিস ঘন্টাখানেক কাজ করেছিল। তারা তখন বলেছিল ২৭০ ফুট পর্যন্ত তারা শিশুর অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছে না। পাইপটি ছিল প্রায় ৪০০ ফুট। সেখানে কিছু সলিড সাবসটেন্স থাকায় একেবারে পাইপের নিচে কি আছে তা দেখা সম্ভব হচ্ছিল না। সলিড সাবসটেন্স সরাতে কিছু অ্যাটাচমেন্ট দরকার ছিল। রোববার সকালে সেসব সরানোর ব্যবস্থা করার কথা বলে আমি চলে গিয়েছিলাম। তারপরও তো ফায়ার সার্ভিস কাজ করেছে।তাছাড়া আমি কিন্তু তাদের উদ্ধার অভিযান বন্ধ করতে বলি নাই, অভিযান চালিয়ে যেতে বলেছিলাম। তারা কাজে শিথিলতা দেখিয়েছে এমনটা হয়তো সত্য না, তারপরও আমরা বিষয়টা খতিয়ে দেখবো।
জিহাদকে উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিস কোনো ধরনের শিথিলতা দেখায়নি বলে দাবি করেছেন বাহিনীর মহাপরিচালক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খানও, যিনি ঘটনা নিয়ে হৈচৈ শুরুর আনুমানিক আট ঘণ্টা পর সেখানে গিয়েছিলেন।
তিনি দাবি করেন, শিশু জিহাদকে উদ্ধারে তার বাহিনীর আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। উদ্ধার অভিযানে কোনো শিথিলতাও ছিল না। নিজেদের যা আছে তা নিয়ে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর চেষ্টা হয়েছে।আমাদের নিজেদের উন্নত ক্যামেরা নেই। ওয়াসার সাধারণ ক্যামেরার ওপর ভরসা করতে হয়েছে। সেটিও সার্চ ভিশন ক্যামেরা না, সাধারণ কামেরা। তাছাড়া, জিহাদকে উদ্ধারে আগে পাইপের ভেতর নামানো কিছু জিনিস সেখানে রয়ে গিয়েছিল, ফলে ক্যামেরায় পুরো ভিউ পাওয়া যায়নি।নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার না করলেও শিশুটিকে উদ্ধার করা তরুণদের সাধুবাদ জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক।
জিহাদের বাবাকে নির্যাতন করা হলে ব্যবস্থা : এদিকে, জিহাদের বাবা নাসির ফকিরকে রাজধানীর শাহজাহানপুর থানায় নিয়ে নির্যাতন করা হয়নি বলে দাবি করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার। তাঁর দাবি, সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আন্তরিকভাবে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে যদি কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, তাহলে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি সভা শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্যাতন নয়, বরং তাকে আন্তরিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও একমত পোষণ করে বলেন, যদি কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে নাসিরকে আটকে রাখা হয় বা নির্যাতন করা হয়, তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক হবে। এ রকম কিছু হলে যিনি দায়ী, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।