আ.লীগ-জামায়াত সম্পর্ক ঐতিহাসিক : একান্ত সাক্ষাৎকারে খালেদা
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামিসহ ধর্মভিত্তিক অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের এক লম্বা ইতিহাস রয়েছে।’
আর বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোটবদ্ধতার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে আমাদের জোটবদ্ধতা মূলত নির্বাচন কেন্দ্রিক। এ জোটবদ্ধতার কোনও আদর্শিক ভিত্তি নেই।’
ভারতের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি’র সঙ্গে বিএনপি’র সম্পর্কের ক্ষেত্রে জামায়াতের সঙ্গে এই জোটবদ্ধতার ইস্যুটি কোনও বাধা হয়ে দাঁড়াবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা বলেন, ‘বিএনপি নিজেই সবসময় এর নীতিমালা ও এজেন্ডা নির্ধারণ করবে। সেক্ষেত্রে জামায়াতের কিছুই করার নেই।’
‘প্রতিবেশী দেশগুলোসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগীতার মাধ্যমে জনগনের কল্যাণের জন্য দরকারি যে কোনও কিছু করতেই আমরা প্রস্তুত আছি। আর সে আলোকেই বিজেপি’র সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অগ্রগতি সাধিত হবে।’
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সাংবাদিক জয়দ্বীপ মজুমদারের সঙ্গে শুক্রবার নিজ কার্যালয়ে এক বৈঠকে আলাপকালে এসব কথা বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বৈঠকে সম্প্রতি ভারতের ক্ষমতায় আসা বিজেপি সরকারের কাছে বিএপি’র চাওয়া-পাওয়া এবং দুইদেশের সম্পর্কের ব্যাপারে আলোচনা করা হয়।
জয়দ্বীপের সঙ্গে খালেদার সাক্ষাৎকারের সার-সংক্ষেপ প্রশ্নোত্তর আকারে সুরমা টাইমস পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হল।
জয়দ্বীপ : নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতের ক্ষমতাসীন সরকারের কাছে আপনাদের প্রত্যাশাগুলো কী?
খালেদা : পরিবর্তনের প্রত্যাশা নিয়েই ভারতের জনগন নরেন্দ্র মোদিকে ক্ষমতায় এনেছে। আর প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের নতুন সরকার ঠিক কী ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করবে তা এখনও পুরোপুরি স্থির হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। সূতরাং আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। আর বাংলাদেশ ও ভারতের অমীমাংসিত দ্বিপাক্ষিক ইস্যুগুলোর সমাধানে তার আশ্বাসের প্রতি আমাদের আস্থা আছে। এছাড়া সার্ককে আরও শক্তিশালি করার ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদির জোরারোপের পদক্ষেপও খুবই ইতিবাচক বলে মনে কারি আমি।
জয়দ্বীপ : আপনি কি মনে করেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে মোদি সরকারের নীতি কংগ্রেস সরকারের চেয়ে ভিন্নতর হবে?
খালেদা : ভারতের নতুন সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে এর সম্পর্কের উন্নয়নে ঠিক কী ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করছে তা পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে আরও বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা মোদি সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এদেশের জনগনের আশা-আকাঙ্খার অনুকুল নীতিমালাই অনুসরণ করবেন। এ ক্ষেত্রে মোদি সরকার দায়িত্বশীল আচরণ করবেন বলেও আমি বিশ্বাস করি।
আমরা আরও আশা করি, ভারত ও বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর পানি বন্টন, সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা, ভূ-সীমান্ত নিয়ে বিরোধ এবং উত্তরোত্তর বেড়ে চলা বাণিজ্য ঘাটতি প্রভৃতি ইস্যুতে নয়া দিল্লি দুই দেশের জন্যই উপকারী হবে এমন সব সমাধান খুঁজে বের করতে আন্তরিকতার সঙ্গেই কাজ করবে।
জয়দ্বীপ : আপনি বা আপনার দলের সিনিয়র নেতারা কি মোদির সঙ্গে সাক্ষাতে আগ্রহী হবেন? যদি এমনটা হয় তাহলে মোদির সঙ্গে আপনারা কোন ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করবেন এবং মোদির সঙ্গে বৈঠক থেকে আপনাদের কী প্রত্যাশা থাকবে?
খালেদা : বিজেপি’র শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনায় আমরা সবসময়ই আগ্রহী থাকবো। বাংলাদেশের জনগনের একটা বড় অংশেরই আমাদের উপর আস্থা আছে। জনগন আমাদেরকে বেশ কয়েকবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বও দিয়েছে। সূতরাং বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নের স্বার্থে বিএনপির সঙ্গে বিজেপিসহ ভারতের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়মিত যোগাযোগ ও সম্পর্ক থাকা একটি রীতিতে পরিণত হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত হওয়া উচিৎ। এর ফলে জনগনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো নিয়ে দু’পক্ষই আরও সহজে পারস্পরিক সমঝোতায় আসতে পারবে।
জয়দ্বীপ : আপনি কি মনে করেন যে, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি’র জোটবদ্ধতার বিষয়টি বিজেপি’র সঙ্গে বিএনপি’র সম্পর্কন্নোয়নের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে?
খালেদা : জামায়াতের সঙ্গে আমাদের জোটবদ্ধতা শুধুমাত্র নির্বাচন কেন্দ্রিক। জামায়াতের সঙ্গে আমাদের কোনো আদর্শিক সম্পর্ক নেই। বরং জামায়াতসহ অন্যান্য ধর্মীয় চরমপন্থীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগেরই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের এক লম্বা ইতিহাস রয়েছে।
বিএনপি নিজেই সবসময় এর রাজনৈতিক নীতিমালা নির্ধারণ করবে, অন্য কেউ নয়। ‘প্রতিবেশী দেশগুলোসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগীতার মাধ্যমে জনগনের কল্যাণের জন্য দরকারি যে কোনও কিছু করতেই আমরা প্রস্তুত আছি। আর সে আলোকেই বিজেপি’র সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অগ্রগতি সাধিত হবে।’
জয়দ্বীপ : আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশ থেকে ভারতবিরোধী জঙ্গি সংগঠনগুলোর মূলোৎপাটনে শেখ হাসিনার সরকার যথেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন?
খালেদা : শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ভারতের সঙ্গে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে বলে জানা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগন এসব চুক্তির ব্যাপ্তি ও পরিধির ব্যাপারে একদমই অসচেতন। আর সরকারও এসব চুক্তিতে কী রয়েছে তা জনগনের সামনে তুলে ধরেননি।
বিএনপি কখনোই সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ বা চরমপন্থাকে প্রশ্রয় দিবেনা। ক্ষমতায় থাকাকালে আমরা সব সন্ত্রাসবাদী, জঙ্গিবাদী ও চরমপন্থীদের উপরই খড়গহস্ত ছিলাম এবং তাদেরকে আইনের মুখোমুখি করেছিলাম। আর আমরা এ ব্যাপারেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে কাউকে ভারতবিরোধী কোনও কর্মকান্ড চালাতে দেওয়া হবেনা।
জয়দ্বীপ : তিস্তার পানিবন্টন ও ভূ-সীমান্তবিরোধ নিরসনের চুক্তি কি কোনও সমাধান এনে দিচ্ছে?
খালেদা : এ মূহুর্তে এই দু’টি মৌলিক ইস্যু সমাধানের কোনও লক্ষণ এখনও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছেনা। বাংলাদেশের অনেকেই এটাকে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্বার্থ আদায়ের নীতিমালা অনুসরনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ব্যার্থতা হিসেবেই দেখছেন।
জয়দ্বীপ : ভারতের সাথে আর কোন কোন ইস্যু সমাধানে আপনি আলোচনা করতে আগ্রহী হবেন?
খালেদা : ভারত ও বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর পানির সুষম বন্টন এবং সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার মতো ইস্যুগুলোই আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের গভীর ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে। আর এ সম্পর্ক ভৌগলিক অবস্থান দ্বারাও অনেকটা প্রভাবিত। আমি মনে করি দু’দেশের সম্পর্ক পরস্পরের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পারস্পরিক স্বার্থ ও পারস্পরিক উপকারীতার উপর ভিত্তি করেই স্থাপিত হওয়া দরকার।
আর নিরপত্তা এবং সন্ত্রাসবাদ ও গণঅসন্তোষের মতো বিষয়ের হুমকি সম্পর্কেও আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিত ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্থিতিশীল সহযোগীতা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালি করার জন্য সবচেয়ে মৌলিক ইস্যু।
জয়দ্বীপ : ভারতে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, আওয়ামী লীগই ভারতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন বিএনপি নয়…..
খালেদা : বিএনপি ভারতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন নয় এ ব্যাপারে উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানো হয়। এটা একদমই সত্য নয়। পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বিএনপি’র প্রধান সফলতা এখানেই যে, আমরা বিশ্বের সব দেশের সঙ্গেই পারস্পরিক সমঝোতাপূর্ণ ও উপকারী সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয়েছি।
ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের মূল নীতি হল, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণ। ক্ষমতায় থাকাকালে ভারতের বিভিন্ন নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে আমরা এই সংবাদ পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছি যে, জনগনের স্বার্থ সংরক্ষণ করে সব ক্ষেত্রেই আমরা আমাদের দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালি করতে সক্ষম হব। আর ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছ থেকেও এ ব্যাপারে আমি ইতিবাচক সাঁড়া পেয়েছি।