‘আমাকে মারতে চেয়েছিল তাই মেরে ফেলেছি’
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ স্বামীকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন লাবণী আক্তার। স্বামী তাকে মারতে চেয়েছিলেন বলে তাকে মেরে ওয়ারড্রবে ঢুকিয়ে রেখেছিলেন বলে জানা তিনি।
পুলিশের কাছে এমন কথাই বলেছেন লাবণী।
পুলিশ জানায়, বুধবার রাতে গৃহবধু লাবণী আক্তার রাজধানীর মিরপুর থানায় ফোন করে বলেছিলেন, ‘আমি স্বামীকে খুন করেছি। সালেন্ডার (সারেন্ডার) করবো। লাশ ঘরে আছে।’ তার তথ্যমতে, স্বামী সালাহ উদ্দিনের মরদেহ বাসার ওয়ারড্রবের ভেতর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এখন লাবণী পুলিশ হেফাজতে বলছেন, ‘আমাকে মারতে চেয়েছিল। তাই মেরে ফেলেছি।’ এরপর একাই মরদেহ লেপে মুড়িয়ে ওয়ারড্রবে ঢুকিয়ে রাখেন।
তবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত লাবণীর এ স্বীকারোক্তিতে সন্তুষ্ট নয় পুলিশ।
রাজধানীর কল্যাণপুরের একটি বাড়িতে স্বামীকে হত্যার পর স্ত্রীর আত্মসমর্পণের এ চাঞ্চল্যকর ঘটনা নিয়ে রহস্য দেখা দিয়েছে। পুলিশ ও নিহতের স্বজনরা বলছেন, প্রথম স্ত্রী লাবণীকে না জানিয়েই গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন সালাহ উদ্দিন মাল। দ্বিতীয় পক্ষে এক সন্তান জন্মের পর সম্প্রতি প্রথম স্ত্রী ঘটনা জেনে যান। প্রথম স্ত্রীর লাবণী ও তার স্বজনদের চাপের মুখে হয় পারিবারিক সালিশ বৈঠক। গত মঙ্গলবার ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল শুক্রবার দ্বিতীয় স্ত্রী মামুনি আক্তারকে তালাক দেবেন সালাহ উদ্দিন। ওই বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা মধ্যেই প্রথম নৃশংসভাবে খুন হন সালাহ উদ্দিন। তবে লাবণী একা এ হত্যাকাণ্ড ঘটনায়নি বলেই ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
বৃহস্পতিবার লাবণীকে দণ্ডবিধির ৫৪ ধারার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের নির্দেশে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে পুলিশ। এদিকে নিহত সালাহ উদ্দিনের ভগ্নিপতি নাজমুল হোসেন বাদী হয়ে লাবণী, তার মা, মামা, খালা, খালাতো ভাইসহ ছয় জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
পুলিশ ও স্বজনদের ধারণা, সালিশ বৈঠকের পর লাবণী ও তার সহযোগীরা মিলে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। এ ঘটনায় পুলিশ আকরাম নামে সালাউদ্দিনের এক ব্যবসায়ীক অংশীদারকে আটক করলেও অপর আসামিরা পলাতক।
মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহ উদ্দিন খান বলেন, ‘আমরা লাবণীর কাছে জানতে চাইছি- কীভাবে, কারা সালাহ উদ্দিনকে হত্যা করেছে। বুধবার রাতে থানায় ফোন করে হত্যার কথা জানানোর পর তার বক্তব্যে অনেক অমিল পাওয়া গেছে। তাই হত্যা মামলা দায়েরের আগেই ৫৪ ধারার মামলায় তাকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে। ’
নিহতের ভগ্নিপতি নাজমুল হোসেন জানান, শরীয়তপুরের নরিয়া থানার গড়িসাড় আটপাড়া গ্রামের মৃত নূরুদ্দিন মালের ছেলে সালাহ উদ্দিনের সঙ্গে লাবণীর বিয়ে হয় এক যুগ আগে। কল্যাণপুরের ২ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন তিনি। তাদের সাদিয়া (৬) ও ছোঁয়া (৪) নামে দুই মেয়ে আছে। সালাহ উদ্দিন কল্যাণপুর বাজারে মুরগীর ব্যবসা করতেন। দেড় বছর আগে তিনি গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রী মামুনি আক্তার কল্যাণপুর এলাকায়ই থাকেন। তিন মাস আগে তার একটি কন্যা সন্তান হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে প্রথম স্ত্রী লাবণী তার স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের খবর জেনে যান। এরপর প্রথম স্ত্রীর তোপের মুখে পড়েন সালাহ উদ্দিন।
গত শনিবার গ্রামের বাড়ি যান তিনি। সালাহ উদ্দিন বিষয়টি সমাধানের জন্য গত মঙ্গলবার তার মা পারভীন আক্তারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ওই দিন বিকেলে মা, মামা সিদ্দিক হাওলাদার ও ভগ্নিপতি নাজমুল হোসেনকে নিয়ে বাসায় যান তিনি। এসময় বাসায় লাবণীর মা, খালা, মামা, খালাতাতো ভাইসহ অজ্ঞাত আরও কয়েকজন ছিলেন। সেখানে পারিবারিক বৈঠকে সমাধানের কথা বলা হলেও লাবণীর স্বজনরা বারবারই সালাহ উদ্দিনকে হত্যার হুমকি দেন। এক পর্যায় সিদ্ধান্ত হয়, শুক্রবার (আজ) দ্বিতীয় স্ত্রী মামুনিকে তালাক দেবেন সালাহ উদ্দিন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে সালাহ উদ্দিনের স্বজনরা চলে যাওয়ার পর কোনো এক সময় তাকে হত্যা করা হয়। সালাহ উদ্দিনের স্বজনরা যাওয়ার পরও লাবণীর স্বজনরা ওই বাসায় ছিলেন।
মিরপুর থানার উপপরির্দশক (এসআই) রফিকুল ইসলাম জানান, মঙ্গলবার হত্যাকাণ্ডের আগে সন্ধ্যায় থানায় একটি জিডি করে আসেন লাবণী। সেখানে তিনি জানান, স্বামী সালাহ উদ্দিন মাদকাসক্ত এবং তাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে।
হত্যার পরও স্বজনদের হুমকি
সালাহ উদ্দিনের ভগ্নিপতি নাজমুল হোসেন বলেন, মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে নিজের বাসায় ফিরে তিনি সালাউদ্দিনকে ফোন করেন। এসময় সালাহ উদ্দিনের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় লাবণীর ফোনে কল করেন। তখন লাবণী জানায়, সালাহ উদ্দিন ঘুমিয়ে আছে। বুধবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে লাবণী নিজেই নাজমুলকে কল করে বলেন, সালাহ উদ্দিন তার সঙ্গে ঝগড়া করে বাসা থেকে চলে গেছে। এর কিছু সময় পর ফোন করে হুমকি দেন লাবণী, ‘আমার স্বামীকে লুকিয়ে রেখে নাটক করছেন। আজকে দিনের মধ্যে আমার স্বামীকে ফিরে না পেলে সবার বিরুদ্ধে মামলা করব।’ নাজমুল আরও বলেন, ‘বুধবার বিকেল পর্যন্ত লাবণী পাঁচ-ছয়বার ফোন করে সালাহ উদ্দিনের খোঁজ করে এবং হুমকি দেয়। সালাহ উদ্দিনকে আগেই হত্যার পর তারা হয়ত আমাদের ব্যস্ত রেখে পালানোর চেষ্টা করেছিল। সবাইতো পালিয়ে গেছে। শুধু লাবণী পালাতে পারেনি। তাই সে ধরা দিয়েছে।’
লাবণী যা বলছেন
গত বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে মিরপুর থানায় ফোন করে লাবণী বলেন, ‘আমি আমার স্বামীকে খুন করেছি। সালেন্ডার করব। লাশ ঘরে আছে।’ থানার এসআই রফিকুল ইসলাম বলেন, লাশটি ওয়ারড্রবের ডান পাশের লম্বার ড্রয়ারে লেপ ও চাদর মিয়ে মোড়ানো অবস্থায় ছিল। নিহতের পা ছিল উপরের দিকে এবং মাথা নিচে। নিহতের ডান কাঁধ ও বাম উরুতে দুটি কোপের চিহ্ন ছিল। এগুলো চাপাতির কোপ বলেই ধারণা পুলিশের। লাবণীর ভাষ্যমতে, হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে মঙ্গলবার রাত ১২টা থেকে ২টার মধ্যে। সন্ধ্যায় বৈঠকের পর তাদের মধ্যে আবার ঝগড়া হয়। সালাহ উদ্দিনের আচরণ ছিল সন্দেহজনক। পুলিশ হোফজতে লাবণী বলেন, ‘আমাকে মারতে পারে ভেবে আমিও খাটের নিচে বটি রাখছিলাম। ও (স্বামী) আমাকে গলা টিপে মারার চেষ্টা করে। তখন আমি ওই বটি দিয়া কোপ দেই।’ লাবনীর দাবি, লেপ ও চাদরে মুড়িয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চেষ্টা করে তিনি লাশ ওয়ারড্রবে ঢুকিয়েছেন। এ দৃশ্য বড় মেয়ে সাদিয়া দেখেছে। লাবণী পুলিশ কর্মকর্তাদের বলেছেন, হত্যার পর প্রথমে তিনি পালিয়ে যেতে চেয়েছেন। পরে বিবেকের ত্ড়ানায় থানায় ফোন করে আত্মসমর্পণ করেন।
বৃহগস্পতিবার মেয়ে সাদিয়া ও ছোঁয়ার কাছেও পুলিশ ঘটনাটি জানতে চায়। সাদিয়া পুলিশকে বলেছে, তার বাবা তার মাকে মারধর করেছে। এর বেশি কিছু সে দেখেনি।
মিরপুর থানার ওসি সালাহ উদ্দিন খান বলেন, ‘লাবণীর শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। তার দাবি নিয়ে সন্দেহ আছে। আলামতে মনে হচ্ছে- কয়েকজন মিলেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।’