সৎমায়ের নৃশংসতা : বিপাকে পুলিশ
ছয় বছরের ফুটফুটে শিশু মাইমুনা। এক বছর বয়সে মাকে হারানোর পর দাদিই ছিল তার কাছে সব। বাবা থাকলেও সৎমায়ের সংসারে পান থেকে চুন খসলেই মারধর ছিল তার ‘প্রাপ্য’। তবু সেই সৎমায়ের ‘ভয়’ কাটাতে বৃহস্পতিবার রাতে তার সঙ্গে ঘুমাতে গিয়েছিল মাইমুনা। কিন্তু সদা চঞ্চল বাচ্চা মেয়েটি আর ঘুম থেকে জেগে দাদির কাছে যেতে পারেনি। শুক্রবার সকালে তার হাত ভাঙা, ঘাড় মটকানো লাশ মিলেছে তাদেরই বাসার গোসলখানার পানির ড্রামে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ মাইমুনার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ মাইমুনার সৎমা সুমাইয়া ইসলাম শারমীনকে গ্রেফতার করেছে। নিষ্ঠুর ওই ঘটনার খবর শুনে শত শত মানুষ ভিড় করেন ধলপুরের ওই বাসায়। মা হারানো শিশুর এমন হত্যাকাণ্ডে অনেকে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। স্বজনরা জানান, মাইমুনা স্থানীয় আয়শা সিদ্দিকা মহিলা মাদ্রাসায় প্রথম শ্রেণীতে পড়ত। প্রায় পাঁচ বছর আগে তার মা রুনা আক্তারের মৃত্যু হয়। সেই ঘটনাটিও রহস্যজনক ছিল বলে দাবি করেন স্বজনরা। মা-মেয়ে দু’জনের মৃত্যুতেই শিশুটির বাবার সংশ্লিষ্টতা আছে বলে তাদের দাবি। পুলিশ বলেছে, শিশু মাইমুনার নামে সাত লাখ টাকার একটি ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপট (এফডিআর) রয়েছে। এটাও তার মৃত্যুর অন্যতম কারণ হতে পারে। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি অবনী শংকর কর জানান, স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে খবর পেয়ে ধলপুরের খালিকুজ্জামান গলির ৯৪/১১ নম্বর বাড়ির (হাসনাহেনা) চারতলার বাথরুমের ড্রাম থেকে লাশটি উদ্ধার করা হয়। পরে লাশের ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়। ওসি বলেন, মাইমুনার বয়স যখন এক বছর, তখন তার মা রুনা আক্তার পারিবারিক কলহের কারণে আত্মহত্যা করেন। তবে রুনার মৃত্যু নিয়েও রহস্য আছে। মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই মাইমুনা তার দাদি ফুলমতি বেগমের আদর স্নেহে বেড়ে ওঠে। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর দুই বছরের মাথায় শারমীনকে বিয়ে করেন ওয়াসার সায়েদাবাদ প্ল্যান্টের স্টোর কিপার আবদুর রাজ্জাক। মাইমুনার দাদি সত্তরোর্ধ্ব ফুলজাহান বেগম জানান, দুই রুমের ওই বাসায় মাইমুনা প্রতিদিন তার সঙ্গে ঘুমাত। বৃহস্পতিবার সকালে তার ছেলে আবদুর রাজ্জাক মাদারীপুরে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ায় শারমীন মাইমুনাকে তার সঙ্গে ঘুমাতে বলে। ফুলজাহান বেগম বলেন, বৌমা আমাকে জানায়, একা ঘুমাতে ভয় লাগে, আজ রাতে মাইমুনাকে নিয়ে ঘুমাব। আমি প্রথমে আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত বৌমার কথা ফেলতে পারিনি। পরে সৎমায়ের ঘরে ঘুমাতে যায় মাইমুনা। ফুলজাহান বেগম বলেন, ভোরবেলায় বাথরুমের সামনে মাইমুনার স্যান্ডেল পড়ে থাকতে দেখি। পরে বাথরুমে গিয়ে ড্রামের ভেতর উপুড় অবস্থায় লাশ দেখে চিৎকার করে উঠি। প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। পরে খবর পেয়ে পুলিশ সকালে মাইমুনার লাশ উদ্ধার করে। তিনি অভিযোগ করেন, সৎমা শারমীন ?প্রায়ই মাইমুনাকে মারধর করত। ছোটখাটো কোনো ঘটনা নিয়ে চিৎকার করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলত। তার চোখের সামনে এসব ঘটলেও তিনি জোরালো প্রতিবাদ করতে সাহস করতেন না। তিনি বলেন, সম্প্রতি মাইমুনার নামে সাত লাখ টাকার একটি এফডিআর করে দিয়েছিল তার বাবা আবদুর রাজ্জাক। ওই এফডিআরের নমিনি ছিলেন মাইমুনার নানি ফাতেমা বেগম। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় মাইমুনার জন্য। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দেয় শারমীন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই মাইমুনাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। মাইমুনার মামা ফজলু মুন্সী ও মামী পারভীন আক্তার বলেন, এর আগে মাইমুনার মা রুনা আক্তার যে আত্মহত্যা করেছিল বলে চালিয়ে দেয়া হয় সেটি ছিল রহস্যজনক। পাঁচ বছর আগে মারা যাওয়ার সময় রুনা সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তখন রাজ্জাক দাবি করেন, গলায় ফাঁস দিয়ে রুনা আত্মহত্যা করেছে। এদিকে রুনার ঘটনায় রাজ্জাককে বেশ কিছুদিন জেলও খাটতে হয়। পরে রুনার স্বজনদের সঙ্গে বৈঠকের পর সাত লাখ টাকায় বিষয়টির নিষ্পত্তি করেন। ওই টাকা মাইমুনার নামে ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপট (এফডিআর) করে রাখা হয়। আর এর নমিনি করা হয় মাইমুনার নানি ফাতেমা বেগমকে। স্বজনদের ধারণা, ব্যাংকে রাখা টাকা হাতিয়ে নিতেই শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে। তারা জানান, রুনার দুই ভাই সাদেকুল মুন্সী ও আতিকুল মুন্সী ইতালি প্রবাসী। বিয়ের পর রাজ্জাককেও ইতালিতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। না নিয়ে যাওয়ায় রুনাকে ক্ষোভে তিনি মেরে ফেলে আত্মহত্যার নাটক সাজান। যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ বলেছে, মাইমুনাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে এ খুনের পেছনে তার সৎমা জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। মাইমুনাকে হত্যার সময় চরম নিষ্ঠুর ছিল খুনি। শিশুটিকে হত্যার পর লাশ গুমের জন্য বাথরুমে পানির ড্রামে উপুড় করে ভরে রাখা হয়। মাইমুনার লাশ এমনভাবে ড্রামে ঢোকানো হয় এতে তার বাম হাত ভেঙে গেছে। এছাড়া মাইমুনার পায়ে কামড়েরও দাগ রয়েছে। পুলিশের ধারণা, শিশুটিকে কামড় দিয়ে ও নির্যাতনের ফলে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ কারণে সৎমা তাকে হত্যা করে লাশ গায়েব করতে বাথরুমে লুকিয়ে রাখেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদে গত রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সৎমা শারমীন হত্যার কথা স্বীকার করেনি। শিশু মাইমুনা আক্তার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া সৎ মা সুমাইয়া ইসলাম শারমিনকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তবে শনিবার রাত পর্যন্ত শারমিন এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেননি। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি এলোমেলো কথা বলছেন। তিনি প্রথমে দাবি করছেন, শাশুড়ির চিৎকারে ঘুম থেকে উঠেই বাথরুমে মাইমুনার মৃতদেহ দেখেন। তবে শনিবারের জিজ্ঞাসাবাদে অনেকটাই নিরব ছিলেন শারমিন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন তদন্তকারীরাও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেড় মাস আগে অস্ত্রপচারের মাধ্যমে দ্বিতীয় সন্তান প্রসব করেন শারমিন। তিনি এখনো পুরোপুরি সুস্থ্য নন। এ কারণে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গেই শারমিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হচ্ছে। এদিকে মাইমুনাকে হত্যা করার পর তার বাবা আব্দুর রাজ্জাকের জীবনে যেন নেমে এসেছে আমাবশ্যার অন্ধকার। সন্তান হত্যার কষ্টের সঙ্গে যোগ হয়েছে অভিযুক্ত স্ত্রীর প্রতি অবিশ্বাস ও ঘৃণা। একই সঙ্গে শারমিনেরে ঔরসজাত দুই শিশু সন্তান নিয়েও বিপাকে পড়েছে রাজ্জাকের পরিবার। যাত্রাবাড়ীর থানার ওসি অবনি শংকর কর বলেন, ‘সব আলামত বলছে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সৎ মা-ই জড়িত। যদিও সে স্বীকার করছে না। তবে আমরা চেষ্টা করছি, আশা করি স্বীকার করবে।’ জানা গেছে, যাত্রাবাড়ী থানায় শুক্রবার রাতে মাইমুনার বাবা রাজ্জাক বাদী হয়ে যে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন সেখানে সন্দেহভাজন হিসেবে শারমিনের নাম উল্লেখ করেছেন তিনি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মনিমুল হক চৌধুরী বলেন, ‘শনিবার মহানগর হাকিম আদালতে আসামিকে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করি। আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। আলামতে আমরা অনেকটাই নিশ্চিত যে বাসার মধ্যে কেউ মাইমুনাকে বাথরুমের ভেতর বা বাইরে নির্যাতন করে হত্যা করেছে।’ দুই বছরের মেয়ে মাইশা ইসলাম লামিয়াকে কোলে নিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন রাজ্জাক। স্বজনরা তাকে সান্তনা দিচ্ছেন। রাজ্জাক বলেন, ‘এখন আমার কী হবে? এই বাচ্চাগুলার কী হবে? শারমিন ক্যামনে এই কাজ করলো, আমি বুঝি না। ওতো বলছিল নিজের সন্তানের মতোই দেখে মাইমুনারে। আমারে কেন এতো কষ্ট দিল? এইটুকু বাচ্চারে সে কেন মারলো? আমারতো বিশ্বাস হয় না…।’ মাইমুনার দাদি ফুলমতি বলেন, ‘সামান্য কারণেও শারমিন সবার সামনেই মাইমুনাকে মারধর করতো। এ কারণে আমি সব সময় মা হারা সন্তানটিকে আগলে রাখতাম। তবে সবার অগচরে সৎ মা তাকে হত্যা করতে পারে এমনটি কেউ ধারণাই করতে পারেনি।’ এখন পর্যন্ত স্বজনরা কেউ হত্যার পেছনে প্রতিহিংসা ছাড়া কোনো কারণ খুঁজে পাননি। হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মমিনুল হক চৌধুরী বলেন, ‘শারমিন অগোছালো কথাবার্ত বলছেন। আগে বলেছেন- তিনি কিছুই জানেন না। ঘুম থেকে উঠে লাশ দেখেছেন। আবার বলছেন- বাথরুমে পড়ে মারা গেছে মাইমুনা। এখন কিছুই বলছেন না।’ থানার ওসি অবনি শংকর কর বলেন, ‘দেড় মাস আগে সিজারে দ্বিতীয় সন্তান হয়েছে শারমিনের। তার ঘা এখনো পুরোপুরি সারেনি। তাই তাকে জিজ্ঞাবাদ করাটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তিনি স্বাভাবিক আছে বলেই মনে হচ্ছে। আশা করছি মুখ খুলবেন।’ প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার সকালে ধলপুর সূতীখাল পাড়ের খালেকুজ্জামান গলির ভাড়া বাসা থেকে স্থানীয় হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) মাহিলা মাদরাসার শিশু শ্রেণীর ছাত্রী মাইমুনার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধারের সময় শিশুটির মাথা ছিল ড্রামের ভেতরে। হাত-পায়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন। এ ঘটনায় তার সৎ মা শারমিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বিস্তারিত…» সৎ মা নিরব, বিপাকে পুলিশ