ঈদুল আযহা ও কুরবানীর মাসাইল
ওলীউর রহমান: আগামী ৬ অক্টোবর পবিত্র ঈদুল আযহা। আজ থেকে চৌদ্দশত চৌত্রিশ বছর আগে হিজরী দ্বিতীয় বর্ষ থেকে মুসলিম জাহানে পালিত হয়ে আসছে ঈদুল আযহা। এ দিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সকল পেশার সর্বস্তরের মুসলমানগণ সম্মিলিতভাবে ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করা এবং যাদের সামর্থ রয়েছে তারা পশু কুরবানী করা। প্রতিটি ধর্মের মধ্যেই বছরে নির্দিষ্ট কিছু দিন রয়েছে যেগুলোতে তারা আনন্দ উদযাপন করে। ইসলাম ধর্মের মধ্যে ও দুটি দিন নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে আনন্দ ও খুশি করার জন্য। এদিন দুটি হল আরবী জিলহজ্ব মাসের ১০ম তারিখ ঈদুল আযহা এবং শাওয়াল মাসের ১লা তারিখ ঈদুল ফিত্র। তবে অন্যান্য ধর্মের মত শুধু আনন্দ উৎসব উপভোগের জন্য ইসলাম এ দিন গুলোকে নির্ধারিত করেনি বরং এতে রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং বিভিন্ন প্রকার ইবাদত।
ইসলাম পূর্ব যুগে আরব সমাজের লোকেরা বছরে দুটি দিনে বিশেষভাবে আনন্দ উল্লাস ও খেলাধুলা করত। নবী সা. যখন হিজরত করে মদীনায় গেলেন তখন দেখতে পেলেন যে, মদীনাবাসী সেই জাহেলী যুগের প্রথা অনুযায়ী আনন্দ উল্লাস এবং খেলাধুলা করে এ দুটি দিন কাটাচ্ছে। রাসূল সা. বললেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দিন দুটির পরিবর্তে আরও উত্তম দুটি দিন নির্ধারিত করে দিয়েছেন তন্মধ্যে একটি হল ঈদুল ফিতর আর অপরটি হল ঈদুল আযহা।-আবুদাউদ, মিশকাত
ইসলামপূর্ব যুগে মদীনাবাসী যে দুটি দিনে আনন্দ উৎসব পালন করত সেগুলো ছিল সৌর বর্ষের প্রথম দিন এবং হেমন্ত কালের প্রথম দিন। এ দিন দুটিতে ভূ-মন্ডল এবং নভোমন্ডলের কোথাও ঠান্ডা ও গরম উভয়ের মধ্য কোনটিই থাকেনা। এজন্য জাহেলী সমাজে এদিনগুলো আনন্দ উৎসবের জন্য নির্দিষ্ট ছিল।-মিশকাত
ইসলাম আনন্দ বিমুখ নয়। আবার লাগামহীন আনন্দ উল্লাসের ও সুযোগ নেই ইসলামে। তাই দুই ঈদের আনন্দ খুশী ও ইসলামের নির্ধারিত সীমারেখার আওতাধীন এবং সম্পূর্ণ ঈবাদত কেন্দ্রিক। তাই এই ইবাদত কেন্দ্রীক খুশী করার মানসেই দুই ঈদের দিন গোসল করা, উত্তম কাপড় পরিধান করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা এবং মার্জিত পোশাকে সাজ-সজ্জা করার প্রতি তাগিদ করা হয়েছে।
ঈদুল আযহার দিনে সাধারণত তিনটি কাজ ওয়াজিব। ১.আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ জামাতের সহিত দু’রাকআত ঈদের নামাজ আদায় করা। ২. সামর্থবানরা কুরবানী করা। ৩. প্রতি ফরয নামাযের পর একবার তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা। এছাড়া আরও কয়েকটি কাজ রয়েছে যেগুলো অত্যাবশ্যকীয় নয় তবে মুস্তাহাব বা ছওয়াবের কাজ। যেমন-১. ঈদের নামাজের পূর্বে গোসল করা। ২. ৗের কার্য ও মিসওয়াক করা । তবে দাড়ি মুন্ডানো ছওয়াবের কাজ নয় বরং একাজ যেকোন সময় হারাম। ৩. উত্তম পোষাক পরিধান করা। ৪. সুগন্ধি (আতর) ব্যবহারকরা। ৫. কিছু না খেয়েই ঈদগাহে যাওয়া এবং কুরবানীর গোশত থেকে কিছু খাওয়া। ৬. অধীক পরিমানে তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা। ৭. পায়ে হেটে ঈদগাহে যাওয়া। ৮. ঈদগাহে এক পথে যাওয়া অন্য পথে আসা, উচ্চস্বরে তাকবীর বলা ইত্যাদি।-বুখারী,তিরমিযী, ইবনেমাজাহ, মাদারিজ, তিবরানী
জিলহজ্ব মাসের ৯তারিখ ফজরের নামাজের পর থেকে শুরু করে ১৩ তারিখ আসরের নামাজ পর্যন্ত মোট ৫দিন প্রত্যেক ফরয নামাজের পর একবার তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা পুরুষ মহিলা উভয়ের উপর ওয়জিব। তাকবীরে তাশরীক হল ”আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’’ ইবরাহীম আ. কর্তৃক স্বীয় সন্তান ঈসমাইল আ. কে কুরবানীর ঘটনা থেকে তাকবীরে তাশরীকের উৎপত্তি।
ইদুল আযহার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল কুরবানী। এ কুরবানী হযরত ইবরাহীম আ. এর সুন্নত। হযরত ইবরাহীম আ. আল্লাহর নির্দেশে স্বীয় সন্তান হযরত ইসমাইল আ. কে নিজ হাতে কুরবানী করার জন্য নিয়ে যান। কিন্তু অবশেষে আল্লাহর হুকুমেই ইসমাইলের পরিবর্র্তে একটি স্বর্গীয জন্তু কুরবানী করা হয়। আমাদের আজকের কুরবানী হচ্ছে মুসলিম মিল্লাতের আদি পিতা ইবরাহীম আ. এর সেই কুরবানীর অনুকরণ। রাসূল সা. বলেছেন, কুরবানীর দিন কুরবানী ব্যতীত আল্লাহর কাছে অধীক প্রিয় আর কোন জিনিস নেই। অন্যত্র রাসূল সা. বলেছেন, কুরবানীর জন্তুর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই আল্লাহ পাকের নিকট তা কবুল হয়ে যায়। অত এব, তোমরা আনন্দের সাথে কুরবানী কর। রাসূল সা. আরও বলেন, কুরবানীর পশুর যতটা পশম থাকে প্রত্যেক পশমের পরিবর্তে এক একটি নেকী লেখা হয়। (তিরমিজীশরীফ) কুরবানীর আবশ্যকতা সর্ম্পকে রাসূল সা. বলেন, যে ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না সে যেন আমার ঈদগাহের নিকটেও যায়না। যাদের উপর যাকাত বা সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। অর্থাৎ যার নিকট সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য অথবা এর সমতুল্যের সম্পদ তার জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণাদির অতিরিক্ত হবে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব।-হেদায়া-১
জিলহজ্ব মাসের ১০তারিখ অর্থাৎ ঈদুল আযহার দিন থেকে ১২ জিলহজের সুর্যাস্ত পর্যন্ত কুরবানীর সময়। যেদিন ইচ্ছা কুরবানী করা যাবে। তবে ঈদের দিন কুরবানী করা উত্তম। ঈদের নামাজের পূর্বে কুরবানী করা ঠিক নয়।-হেদায়া-১
গরু, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, এবং মহিষ, উট এই ছয় প্রকার প্রাণী ব্যতীত অন্য কোন প্রাণী দ্বারা কুরবানী হবেনা। (আলমগিরী) অন্ধ প্রাণী এবং যে প্রাণীর জন্মগতভাবে কান নেই এবং যে প্রাণীর শিং মূল সহ ভেঙ্গে গেছে এরূপ জন্তু দিয়ে কুরবানী হবেনা। কুরবানীর পশুর মধ্যে গরু ও মহিষের পূর্ণ ২বছর, ভেড়া, বকরী ও দুম্বার পূর্ণ একবছর এবং উটের পূর্ণ ৫বছর বয়স হতে হবে। এর কম বয়স হলে কুরবানী হবেনা। যে পশুর একটিও দাঁত নেই সে পশু দ্বারা ও কুরবানী যায়েজ হবেনা। কুরবানীর পশু নিজ হাতে যবেহ করা উত্তম। তবে এর নিয়ম কানুন যদি জানা না থাকে তবে অন্যকে দিয়ে ও যবেহ করা যাবে। নিজে কুরবানী করার সময় সামনে থাকা ভাল।
গরু, মহিষ ও উট এই তিন প্রকার পশুর মধ্যে যৌথ ভাবে কুরবানী করা যায়। তবে এক পশুর মধ্যে সাত নামের বেশি হবেনা। যৌথ কুরবানীর েেত্র সকলের নিয়ত পরিশুদ্ধ থাকতে হবে। এক জনের নিয়তে ত্র“টি থাকলে সকলের কুরবানী নষ্ট হয়ে যাবে। যৌথ কুরবানীতে গোশত পাল্লাদিয়ে মেপে সমান ভাবে ভাগ করতে হবে।-আলমগিরী-৬
কুরবানীর গোশত তিন ভাগে ভাগ করে একভাগ নিজের জন্য রাখা একভাগ আত্মীয় স্বজনের জন্য একভাগ গরীব মিসকিনদের জন্য দান করা মুসতাহাব। কুরবানীর পশু যদি হারিয়ে যায় এবং অন্য একটি পশু ক্রয় করার পর আবার প্রথম পশুটি মিলে যায় এমতাবস্থায় ক্রেতা যদি গরীব হয় তাহলে দুটি পশুই তাকে কুরবানী করতে হবে। আর যদি ক্রেতা মালদার হয় তাহলে একটি পশু কুরবানী করলেই চলবে।
কুরবানীর চামড়া নিজের কোন কাজে ব্যবহার করা যায়। যেমন- জায়নামাজ তৈরী করা ইত্যাদি। আর না হয় এর মূল্য গরীব মিসকীনদের দান করতে হবে। মাদরাসা সমূহের লিল্লাহ বোর্ডিং এ ও কুরবানীর চাড়া দান করা যায়। তবে কুরবানীর চামড়ার টাকা দিয়ে শিক কর্মচারীদের বেতন দেয়া যাবেনা বা মাদরাসার নির্মান কাজে ও এটাকা ব্যয় করা যাবে না। কুরবানীর চামড়া দ্বারা পারিশ্রমিক দেওয়া যাবেনা। যারা গোশত তৈরী করে তাদেরকে মজুরী হিসাবে চামড়া বা গোশত দেওয়া যাবেনা। মজুরী দেওয়ার পর তাকে আলাদা ভাবে চামড়া বা গোশত দেওয়া ভিন্ন কথা। কুরবানীর গোশত বিক্রি করা যায়না। কুরবানীর সাথে মানুষের আত্মার সর্ম্পক, নিয়তের পরিশুদ্ধতা ই হচ্ছে কুরবানী কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত।
ঈদুল আযহা মুসলিম মিল্লাতের সার্বজনীন আনন্দ উৎসব এবং কুরবানীর দিন। এদিন আমাদের স্বরণ করিয়ে দেয় মিল্লাতের আদি পিতা ইবরাহীম আ. এর সেই নজিরবিহীন কুরবানীকে। মুসলমানরা একে অপরের ভাই, গোটা মুসলিম মিল্লাত এক দেহ সদৃশ্য এ অনুভূতিকে জাগ্রত করে ঈদুল আযহা। ঈদুল আযহায় পশু কুরবানী করা হয়। এ কুরবানী হল এ কথারই স্বীকৃতি যে, আমরা আমাদের পশু কুরবানী করছি যদি প্রয়োজন হয় তাহলে আমাদের জীবনকেও আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী করে দিতে কুন্ঠাবোধ করব না। ঈদের দিন সকল মুসলমান সমবেত হয় ঈদগাহে, সবাই দাড়িয়ে যায় একই কাতারে, একই ইমামের পিছনে। এতে আমীর ফকির, ধনী-গরীবের কোন ভেদা-ভেদ থাকেনা। মনে হয় যেন সত্যিই আমরা একই পরিবার একই উম্মাহের সদস্য। তাই পারস্পরিক সকল বিবাদ বিদ্ধেষ ভুলে গিয়ে সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করা, একের দুঃখে অন্যরা এগিয়ে আসা সর্বোপরি মুসলিম সমাজে একটি শক্তিশালী ঐক্য ও সংহতি গড়ে তুলা হল ঈদুল আযহার শিা ও দাবি।
ওলীউর রহমান, কলাম লেখক, প্রাবন্ধিক, পেশ ইমাম ও খতীব পূর্বভাটপাড়া জামে মসজিদ, ইসলামপুর, মেজরটিলা, সিলেট। মোবাইলঃ ০১৭১৪-৬০৮৭২৬