সাঈদীর আমৃত্যু কারাদণ্ড : রিভিউর সুযোগ নেই
রায় মেনে নিয়েছে ১৪দল : অসন্তুষ্ট জামাত
বিক্ষুব্ধ গণজাগরণ কর্মীদের ওপর পুলিশের হামলা
সুরমা টাইমস রিপোর্টঃ একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে করা আপিলের রায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এ রায় ঘোষণা করা হয়। বুধবার সকালে প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১০, ১৬, ১৯ নম্বর অভিযোগে জামায়াতের এই নায়েবে আমিরকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। আর ৮ নম্বর অভিযোগে ১২ বছর এবং ৭ নম্বরে ১০ বছর কারাদণ্ডের আদেশ দেয় আপিল বিভাগ। এর মধ্যে ৮ ও ১০ নম্বর অভিযোগে ইব্রাহিম কুট্টি ও বিসাবালীকে হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে আগুন দেয়ার দুটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একাত্তরের রাজাকার সাঈদীর ফাঁসির রায় দিয়েছিল।
তবে এ রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করার ঘোষণা দিয়েছে আসামিপক্ষ। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল এডভোকেট মাহবুবে আলম বলেছেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদনের কোনো সুযোগ নেই।
পরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আংশিক আবেদন মঞ্জুর করেছে। আদালতের রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ সন্তুষ্ট নয়। তিনি বলেন, আমার প্রত্যাশা ছিল আমরা সর্বোচ্চ সাজা পাবো কিন্তু তা হয়নি। আর আমরা যে সব সময় প্রত্যাশিত রায় পাবো তা তো নয়। অনেক সময় প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির মিল থাকে না।
সরকারের সর্বোচ্চ এই আইন কর্মকর্তা বলেন, তবে ঠিক কেন ফাঁসির পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হলো তা পূর্ণাঙ্গ রায় বের হওয়ার পরই বলা যাবে। তবে এ রায়ে আমার খারাপ লাখছে। এ রায়ের পর রিভিউ করার আর কোনো সুযোগ নেই এবং এটা আমি আগেও বলেছি এখনো বলছি। তিনি বলেন সাঈদীর সাজা এখন থেকেই কার্যকর হবে। তিনি বলেন, এই রায়ের বৈশিষ্ট্য হলো তাকে আমৃত্যু জেলে থাকতে হবে। এই রায়ে একটি জিনিসি প্রমাণিত হলো যে সাঈদী একজন ধর্ষণকারী, ধর্মান্তরকারী।
সাজা কমানোর রায় আসায় তাৎক্ষণিকভাবে আদালতের বাইরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল ও শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।শাহবাগে শ্লোগান ওঠে – ‘আঁতাতের এই রায় মানি না, প্রহসনের এই রায় মানি না’।
রায়ের পর ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, “আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাইনি। হাতে পেলে বুঝতে পারব কোন কোন জায়গায় আরো তথ্য প্রমাণ প্রয়োজন ছিল।”
তিনি বলেন, “সর্বোচ্চ শাস্তি আমাদের প্রত্যাশিত ছিল। তবে আমরা আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।”
সাঈদীর আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, “আমরা এ রায়ের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। খালাস আশা করেছিলাম।”
এই জামায়াত নেতার ছেলে মাসুদ সাঈদী রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “ফাঁসি কমে আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছে। তারপরও আমরা বলব যে ন্যায়বিচার পাইনি। আমাদের প্রত্যাশা ছিল নির্দোষ প্রমাণ হয়ে বেকসুর খালাস পাব। আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর রিভিউ আবেদন করব।”
এই রায়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের মধ্যে দ্বিতীয় আসামির মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলো। এর আগে তার দলেরই নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার আপিল নিষ্পত্তির পর গত বছরের ডিসেম্বর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রথম অভিযুক্ত ব্যক্তি হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাঈদীর বিচার শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের ৩ অক্টোবর, রায় হয় ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি।
রায়ের বিরুদ্ধে সাঈদী আপিল করলে শুনানি শেষে গত ১৬ এপ্রিল তা রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখে আপিল বিভাগ। তার পাঁচ মাস পর এই রায় এলো।
মঙ্গলবার রায়ের দিনক্ষণ ঘোষণার পর থেকেই সারা দেশে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। রাজধানীসহ সারা দেশে আদালত, সরকারি দপ্তর, পেট্রোল পাম্পসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনায় মঙ্গলবার থেকেই নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়।
এ মামলায় উভয়পক্ষের শুনানি শেষে গত ১৬ এপ্রিল যে কোনো দিন রায় ঘোষণা করা হবে মর্মে সাঈদীর মামলাটি সিএভিতে রাখেন আপিল বিভাগ। দীর্ঘ ৮ মাসে ৪৯ কার্যদিবস এ মামলার ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিতদের করা আপিলের মধ্যে সাঈদীর মামলাটি দ্বিতীয় হিসেবে রায় ঘোষণা করা হল।
এদিকে যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের দেয়া রায় প্রত্যাখ্যান করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। রায় ঘোষণার পর বুধবার সকালে বিক্ষোভ মিছিল করে গণজাগরণ মঞ্চের একাংশ। মিছিলে প্রায় ৫০ জন কর্মী অংশ নেন। মিছিলে নেতৃত্ব দেন মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার। এসময় মঞ্চের নেতাকর্মীরা শাহবাগ মোড়ে রাস্তায় বসে পড়ে। প্রায় আধা ঘন্টা অবস্থানের পর কিছু বিক্ষুব্ধ কর্মী গাড়ি ভাঙচুরের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। তাৎক্ষনিকভাবে জলকামান ও টিয়ারশেল ব্যবহার করে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এর আগে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, জামায়াত-শিবিরকে পুনর্বাসন করতেই এই রায় দেয়া হয়েছে। রায় গ্রহণযোগ্য নয়। জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করেই এই রায় দেয়া হয়েছে। রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সারাদেশের মানুষকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান তিনি। কামাল পাশার নেতৃত্বাধীন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা শাহবাগে গাড়ি ভাঙচুর করেছে বলে ডা. ইমরান অভিযোগ করেন।