রাজনীতি, বধির সেবা এবং তৈমুরে হাজতবাস

এখন ভালো কাজ করতে গেলেও বিপদ। ইতিবাচক কাজে উৎসাহিত করা থেকে মানুষকে বিরত রাখতে সচেষ্ট বিশ্বসমাজ? দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে? এর শেষ কোথায়? আজ ভীষণ উদ্বিগ্ন হৃদয়ে এই লেখাটি লিখছি। ১৫ সেপ্টেম্বর সন্ধায় এডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার গ্রেফতার হয়েছেন। তিনি বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক, নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। আমি যেহেতুক রাজনীতি করি না, আর হাল সময়ের রাজনীতিতে মোটেও আকৃষ্টও নই, তাই তাঁর রাজনীতির বিষয়ে লেখার আমার তেমন কোন আগ্রহও নেই। রাজনীতির বাইরে আরেক তৈমুর আছেন। যাকে আমি বেশ চিনি, জানি এবং গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি। এ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার জাতীয় বধির সংস্থার সভাপতি। ২০০১ সালে যখন সভাপতি হন তখন থেকেই এই তৈমুর আলমকে আমি মনে প্রাণে ভালোবাসী। তাঁর প্রতি এ শ্রদ্ধা এ কারনে যে, ২ যুগেরও বেশী সময় ধরে তিনি মুখ বধিরদের স্বার্থহীনভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। মানব সেবা পরম ধর্ম এই আদর্শকে আগলে রেখে তিনি দীর্ঘ সময় বধিরদের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন। আমি দেখেছি, বধিরদের মুখে হাঁসি ফুটিয়ে আনন্দ পেতে ভালো বাসেন তৈমুর। রাজনীতি, সংসার ধর্মকর্মের মতই বধিরদের সাথে নিয়মিত সময় কাটানো, তাদের জন্য কিছু করা তার এখন র”টিন মাফিক কাজেরই অংশ। পাঠকমনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আমি কি করে জানি এতোসব? রাজধানী ঢাকার জাতীয় বধির সংস্থার খুব কাছেই আমার বসবাস। প্রায় দিনই বধির সংস্থার পাশ দিয়ে প্রেসক্লাব কিংবা রিপোটার্স ইউনিটিতে সাংবাদিক বন্ধুদের সাথেআড্ডা দিতে যাই। প্রায়ই সন্ধায় একটি দৃশ্য আমার হৃদয় কাড়ে তা হলো বধিররা উঁচা, লম্বা এক লোককে ঘিরে আছে। কে সেই ব্যক্তি? জানা গেলো তৈমুর আলম খন্দকার তার নাম। ওদের সাথে মিলে মিশে হৈ হুল্লর করে কখনো ঝাল মুড়ি, কখনো ফুচকা, আবার কখনো বাদাম খান তিনি। তা অনেকেরই দৃষ্টি কাড়ে। আশে পাশের লোকজনের কাছ থেকে আরও জানতে পারি বধিরদের সাথে এ সময়টা কাটিয়ে তবেই তিনি পল্টনের অফিসে ঢোকেন।
১৫ সেপ্টেম্বর পড়ন্ত বিকালে পূর্বের ন্যায় বধিরদের নিয়ে বুট, পিয়াজু মুড়ি মাখা খেয়ে ঝালে মুখ ঝাড়তে ঝাড়তে তৈমুর আলম পল্টন অফিসে ঢোকেন। সেখানে আইন পেশার কাজ করছিলেন। যেহেতুক রাজনীতি করেন তাই ঐ সময় দলীয় লোকজনও তাকে ঘিরে ছিলো। সন্ধা ৬টার দিকে অফিসের দরজার কড়া নাড়িয়ে পোশাকী পুলিশ হুড়মুড়িয়ে তাঁর কক্ষে ঢোকে পড়ে। তৈমুর আলম এবং তার অপরাপর ভক্তরা ভেবে ছিলেন, রাজনৈতিক পাতানো মামলায় হয়তো আবারও তৈমুর গ্রেফতার হচ্ছেন। তৈমুর আলম খন্দকার জাতীয় বধির সংস্থার সভাপতি। রাজধানীর সৈয়দ নজর”ল ইসলাম সরণীতে অবস্থিত বধির ভবন। ভবনটির বেজমেন্টের দোকানের একজন ভাড়াটিয়া তৈমুরসহ অজ্ঞাত আরো ১০/১২ জনের বির”দ্ধে একটি চুরির মামলা দায়ের করেছেন। ১০ সেপ্টেম্বর নাকি ওই চুরির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় বাদি হয়ে ভাড়াটিয়া সৈয়দ র”হুল আরেফিন ১১ সেপ্টেম্বর মামলা দায়ের করেন। পল্টন থানায় দায়ের করা মামলা নং-২০। পত্রিকান্তে জানা গেলো, বধির সংস্থার সাথে মামলায় হেরে গিয়ে তৈমুরকে শায়েস্তা করতেই ্জনৈক ব্যক্তির এ মামলা। বধিররা তাতে ফুঁসে উঠে। তৈমুর আলমকে গ্রেফতার করে পল্টন থানা নিয়ে যাবার আগেই বধির ফেডারেশনের বধিররা পল্টন থানা ঘেরাও করে রাখে। পরে তৈমুরকে নিরাপত্তার অজুহাতে পল্টন থানা থেকে ডিবিতে হস্তান্তর করে পুলিশ। বধিররা থেমে নেই সরা দেশেই বিভিন্ন জায়গায় রাতে এবং ১৬ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে বিক্ষেভে ফেঁটে পরে। সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে তারা প্রেস ব্রিফিং এবং অবস্থান ধর্মঘট করেছে। বধিরদের একটাই বক্তব্য আমাদের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে তৈমুর কেন গ্রেফতার হলো? বধিররা দেশের সকল বধিরদের গ্রেফতার করে তৈমুরকে ছেড়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছে। তৈমুর আলম খন্দকারের ছোট ভাই নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের আহবায়ক ও নাসিকের ১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদের পক্রিকায় দেয়া বক্তব্যে মনে হয়, তৈমুর আলমের গ্রেফতারের বিষয়টি অনেকটা রাজনৈতিকও। বিএনপি নেতা এটিএম কামাল পত্রিকায় বলেছেন- বধির কল্যাণ সংস্থার জমি সংক্রান্ত মামলায় হেরে গিয়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তৈমুর আলমকে পুলিশ দিয়ে হয়রানির উদ্দেশে আটক করিয়েছেন। এসব বক্তব্য থেকে বুঝা যায় কয়েকটি ঘটনা, কয়েকটি সম্মিলিত শক্তিতে তৈমুর মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন। প্লটন থানার ওসি প্রথমে পক্রিকাগুলোকে বলেছেন তৈমুরকে চুরি ও অনধিকার প্রবেশ মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় পল্টন থানায় গাড়ি পোড়ানো মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। বিষয়টি পওে যে রাজনৈতিক ভাবে জড়িয়ে গেছে তা স্পস্টই বলা যায়।
আজকাল ভালো কাজ করতে গেলেও বিপদ। আবার না করেও পারা যায় না। বধিরদের সম্পদ রক্ষায় তৈমুর আলম খন্দকার আদালতে লড়েছেন। মামলায় জিতে বধিরদের সে সম্পদ রক্ষা কেেছন। তাতে বধিররা মহা খুশি। সেই খুশিতে সেদিন তারা বুট মুড়ি পিয়াজু মাখাও খেয়েছেন তৈমুরকে নিয়ে। এর কিছুক্ষন পরই তৈমুর চুরি মামলায় গ্রেফতার হন। লেখার শুর”তেই তৈমুর আলম খন্দকারে রাজনীতি নিয়ে আমি কোন মন্তব্য করবো না বলে বলেছি। তিনি ভালো রাজনীতিবিদ নন এমন বিষয় নয়। আজকাল রাজনীতির যে অবস্থা, গনতন্ত্রেও যে অবস্থা তাতে এসব বিষয়ে ঘাটাঘাটি না করাই শ্রেয় মে করি। মোদ্দা কথা হলো রাজনীতি এখন আর আমার কাছে ভালো লাগে না। এনিয়ে লিখতেও চাই না। রাজনীতির বাইরে আছে অন্য এক তৈমুর। তিনি বধিরদের অভিভাবক । বধিররাও তাকে দেবতুল্য কিছু মনে করে! তাই যদি না হয় তৈমুর গ্রেফতারের পর বধিররা ফুঁসে উঠলো কেন? ঊধিররা কেন তৈমুরকে ঘিরে তাকে? তৈমুরের রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা আসার আগেই, গ্রেফতারের সাথে সাথে পল্টন থানা ঘেরাও করে বধিররা তাকে ছেড়ে দেয়া দাবি জানায়। তাদের দাবি ‘সব বধিরদের হাজতে ভর; তৈমুরকে মুক্ত কর’। তারা পরদিনও (১৬ সেপ্টেম্বর) জাতিয় প্রেসক্লাবে গিয়ে এ দাবিতে বিক্ষেভ করেছে। বিষয়টি হৃদয়ে লাগার মতো। আমাদের বধিররা কতনা অসহায়। এদেশে বধিরদের জন্য তেমন কি করছি আমরা? সরকারও বা তাদের কতটা লালন পালন করতে পারছে? এ অবস্থায় বধিররা একজন তৈমুরকেতো তাদেও কাছে পেয়েছে? সেই তৈমুরও তাদের সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন। বধিরদের সম্পদ রক্ষা মামলায় জেতাই ছিলো তৈমুরের মস্ত অপরাধ। এই যদি হয় ভালো কাজে আগ্রহ হারাবে মানুষ। অসহায়দের পাশে থাকার কেউ আর থাকবে না। এতে সমাজের দুরবৃত্বরা, সমাজের জুলুমবাজরা বিবেক বর্জিত, গর্হিত কাজে প্রতিনিয়ত লিপ্ত থাকবে। প্রতিবাদ হবে না, আর তৈমুরেরা পাশে দাঁড়াবেনা অসহায় নিপিড়িত এসব মানুষের পাশে। তখন কি হবে সমাজটার? একথা কি সত্য নয়- ইতিবাচক কাজে উৎসাহিত করা থেকে মানুষকে বিরত রাখতে সচেষ্ট বিশ্বসমাজ? এর শেষ কোথায়?

(লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সম্পাদক- নিউজ-বাংলাদেশ ডটকম। [email protected])