গাছবাড়ীতে নৌকা বাইচ : লাখো দর্শকের পদচারণায় মুখরিত সুরমা নদীর পার
জসিম উদ্দিন, কানাইঘাট থেকেঃ এ যেন এক মেলবন্ধনের নাম। ‘হেইয়ো হেইয়ো’ আর ‘আমার নাও যে’ গাঙে ডুবে না ওরে মাঝি খবরদার…। আবহমান কাল ধরে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যে লালিত নৌকাবাইচ এখন আর আগের মতো চোখে দেখা না গেলেও একেবারে হারিয়ে যায়নি। নদীমাতৃক বাংলাদেশের এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার গাছবাড়ী বাজারে সুরমা নদীতে আয়োজন করা হয় নৌকাবাইচের।গত শনিবার সুরমা নদীতে এই নৌকা বাইচের আয়োজক ছিল ৭নং দক্ষিণ বাণীগ্রাম ও ৮নং ঝিংগাবাড়ী ইউনিয়ন । পূর্ব থেকে ঘোষিত নৌকাবাইচ অনুষ্ঠানের কথা জানা হয়ে গিয়েছিল সবার। তাই দুপুর
গড়াতে না গড়াতে জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে হাজার হাজার দর্শক ছুটতে থাকেন নৌকাবাইচ অনুষ্ঠান স্থলের দিকে। শিশু-কিশোর আর আবাল বৃদ্ধ বনিতার পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে প্রায় ৩ কিলোমিটার স্থান । তবু স্থান নেই মানুষের উপচে পড়া ভিড়ে। উচু
গাছের ডাল আর বিল্ডিংয়ের ছাদের উপর জায়গা করে নেন অনেকে। প্রতিযোগিতা শুরুর সময় দেয়া হয়েছে বিকাল তিনটা। কিন্তু দুটার মধ্যেই মানুষের তিল ধারণের জায়গা নেই। তারও আগে দুপুর বারোটার দিকে প্রতিযোগী নৌকাগুলো শাহানশাহী বেশে মাঝ-মনুতে প্রস্তুতিমূলক প্রদক্ষিণ করছিল। একেকটি নৌকায় ৩০/৩৫ জনের মতো মাঝি। এ যেন মাঝি নয় নানান রঙে রঙিন জামায় আচ্ছাদিত একেকজন হবু বর। তাদের মুখে মুখে শোভা পাচ্ছিল
ভাটির বাউল আব্দুল করিমের গান, ‘কোন্ মেস্তরী বানাইলো কেমন দেখা যায়, ঝিলমিল করে রে ময়ূর পংঙ্কি নায়…।’
প্রত্যেক মাঝির হাতে হাতে শোভা পাচ্ছিল লাল, নীল, বেগুনি রঙের বৈঠা। দর্শকদের চোখ ঘড়ির কাটার দিকে। কখন সাইরেন বাজবে আর সপাং সপাং বৈঠার আঘাতে ফালি ফালি করবে সুরমার জল।
বিজয়ের নেশায় উন্মত্ত নৌকাগুলো ছুটবে নিশানা ভেদ করতে।
দর্শকতো আর থেমে নেই; তারাও ব্যক্তিগত ছোট- বড় নৌকা নিয়ে প্রতিযোগী নৌকাগুলোর পেছন পেছন ছুটার জন্য ঘাটে প্রহর গুনছে।
অপেক্ষা করতে হলো না বেশি সময়। কখন যে কেটে গেছে অনেক সময় টেরই পাওয়া যায় নি। এরই মধ্যে ঘড়ির কাটায় সময় ঘনিয়ে এলো হাজার হাজার দর্শকের হাততালি আর সাইরেন বাজার শব্দে এক সাথে ছুটে চললো বেশ কয়েকটি নাও। মুহূর্তেই দু’পাড়ের দর্শকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চললো নাওগুলো।
শীতকালে প্রায় হাটুজল হওয়া সুরমা বর্ষায় টইটম্বুর হয়ে পড়ে। এ সুরমাই আজ হাজার হাজার দর্শককে পাশে বসিয়ে শত শত বৈঠার আঘাত পেয়ে ফুলে ফেঁপে উঠছে। সুরমার দু কুল যৌবনবতী তর্বণীর মতো উছ্লে পড়ছে বারবার। ভাটিয়ালী গানের মূর্ছনা আর দর্শকদের উৎসাহ আনন্দে একসময় সীমানা ভেদ করে একেকটি নাও।
এভাবে এক এক করে তিনটি নাও এক দুই তিন এর আসন নেয়।
ততক্ষণে সময় গড়িয়ে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে গেছে। যুদ্ধ ফেরত বিজয়ী যোদ্ধার মতো সারিবদ্ধভাবে বসেন নাওয়ের কাড়ালিসহ শত শত মাঝির দল।
এরই মধ্যে ভেসে আসে মাগরিবের সুমধুর আজান। ভেঙে যায় অপার্থিব আয়োজনের এ হাট। তবু চিত্ত বিনোদনের এ জলসা থেকে একটা আত্মতৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফেরে হাজারও দর্শকের কুন্ডলী।