৪৩ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সন্তানের কবরের সন্ধান পেলেন মা
হাবিব সরোয়ার আজাদ,সুনামগঞ্জ থেকে: ৭১ সালে মহান মুক্তিযদ্ধে ‘শহীদ’ হওয়ার ৪৩ বছর পর সুনামগঞ্জের ডলুরা সীমান্তে নিজের সন্তানের কবরের সন্ধান পেয়েছেন শহীদ মাতা বেলেজান্নেছা (৯৫)। রাজবাড়ী থেকে নিজের অন্য সন্তানসহ পরিবারের ৯ সদস্যকে নিয়ে সন্তানের কবর জিয়ারতের জন্য বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে গতকাল শুক্রবার সুনামগঞ্জের ডলুরা শহীদ মিনারে পৌছে সন্তানের কবর জিয়ারত করলেন শহীদ মাতা । শুক্রবার এ উপলক্ষ্যে শহীদ মিনার এলাকার পরিবেশ ছিল কিছুটা অন্যরকম আবেগ প্রবণ। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার বিরাহীনপুর গ্রামের মৃত মেছের উদ্দিন বিশ্বাস ও বেলেজানন্নেছার বড় সন্তান পুলিশ কনস্টেবল আতাহার উদ্দিন বিশ্বাস সুনামগঞ্জের ডলুরা সীমান্তে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। শহীদ আতাহার উদ্দিনকে ডলুরায় কবর দেওয়া হলেও অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পরিবারের সদস্যরা তাঁর কবরের সন্ধান পাননি।
আতাহার উদ্দিনের ভাই বাগেরহাটের পুলিশ পরিদর্শক আলী আজগর বলেন, ‘আমাদের ৬ ভাইয়ের সবার বড় ছিলেন আতাহার ভাই যুদ্ধকালীন সময়ে ময়মনসিংহে পুলিশ কনস্টেবলের চাকুরি করতেন তিনি। ওখান থেকেই যুদ্ধে গিয়েছেন তিনি। যুদ্ধের পর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আমরা তাঁর সন্ধান না পেয়ে সিআর দত্তের কাছে গিয়ে খবর পাই সিলেট অঞ্চলের কোন এক জায়গায় শহীদ হয়েছেন আমার ভাই। সেই থেকেই সিলেট অঞ্চলের যাকেই পেয়েছি, বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের পেলেই আমার ভাইয়ের কবর কোথায় আছে জানতে চেয়েছি। সিলেট অঞ্চলে কয়েক বছর চাকুরি করেও ভাইয়ের সন্ধান বের করতে পারিনি আমি। কিছুদিন আগে সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহেরের সঙ্গে পরিচয়কালে আমার ভাইয়ের কবর খোঁজে না পাওয়ার কথা বলেছিলাম। সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরীর লেখা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসগ্রন্থ ‘রক্তাক্ত ৭১’এ ডলুরায় কবর দেওয়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় আমার ভাই আতাহার উদ্দিন বিশ্বাসের নাম দেখে আমাকে ফোন দেন তিনি। আমার বৃদ্ধ মা এ খবর পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং ছেলের কবর জিয়ারতের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।’
আলী আজগর জানান, বৃহস্পতিবার সকালে মা বেলেজানন্নেছাকে সঙ্গে নিয়ে অন্য ভাইয়েরাসহ পরিবারের ৯ জন তাঁরা সুনামগঞ্জের ডলুরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন।
রক্তাক্ত ৭১’র লেখক অ্যাডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী বলেন, ‘রক্তাক্ত ৭১ পড়ে গত বছর ৪২ বছর পর একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের স্বজনরা আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদের কবর খুঁজে পেয়েছিলেন। এবার আতাহার উদ্দিনের মা তাঁর ছেলের কবর খুঁজে পেয়েছেন। রক্তাক্ত ৭১’এ নাম পরিচয় ছাপা না হলে এই শহীদের স্বজনদের হয়তোবা জানাই হতো না মুক্তিযোদ্ধা আতাহার উদ্দিনকে কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে।
অবশেষে দ্বীর্ঘ ৪৩ বছর পর কবরের সন্ধান পেয়ে গতকাল শুক্রবার বেলা ১১ টায় ডলুরা শহীদ মিনারে পৌছে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে বেলেজানন্নেছা সন্তানের কবর জিয়ারত করেন। পরিবারের সদস্যরা এলাকাবাসী ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাগণ সহ এলাকার গণমান্য ব্যাক্তিগণের অংশ গ্রহনে সেখানে এক দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেন।
সন্তানের কবর জিয়ারত শেষে নিজের অনুুভুতি প্রকাশ করতে গিয়ে ৯৫ বছরের বয়োবৃদ্ধা শহীদ মাতা বেলেজানন্নেছা বললেন, মুক্তিযুদ্ধের পর সন্তানের বাড়ি ফেরার পথ চেয়ে অপেক্ষা করেছি বছরের পর বছর , এক সময় নিরাশ হয়ে তার কবরের সন্ধান করেছি, গত ৪৩টি বছর এভাবেই কেটেছে আমি ও আমার পরিবারের সদস্যদের । তিনি আরো বলেন, খোঁদা হয়ত এতোদিন আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন সন্তানের কবর খানা দেখানোর জন্যই, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে খোদা আমার ডাক শুনেছেন, তার কবর খানা দেখেছি এখন আমি মৃত্যু বরণ করলেও আমার আর কোন আফসোস থাকবেনা। তিনি কান্না জড়িত কন্ঠে আরো বলেন, আমার ছেলে আতাহার অবিবাহিত ছিল, তার ছেলে মেয়ে থাকলে তাদের দেখেও হয়ত ছেলে হারানোর দু:খ ভ’লতে পারতাম,দেশের জন্য আমার ছেলে শহীদ হয়েছে, আমার ছেলে পুলিশে চাকরি করত, কিন্তু দু:খ একটাই পুলিশ বিভাগ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমার ছেলেকে কোন স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।