মিশরের পথে পথে : একটি পাঠ সমীক্ষা
মিজানুর রহমান মিজান
শাহজালালের পূণ্যভুমি সিলেট। চা , কমলা লেবু উৎপাদনের সুখ্যাতি লালন পূর্বক আধ্যাত্মিক রাজধানীর পরিচয় নিয়ে দ্বিতীয় লন্ডন উপাধি ধারণ করে সুরমা , কুশিয়ারা বিধৌত অঞ্চল সিলেট বিভাগ বাংলাদেশের একটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সোপান বলে পরিচিতি যার রয়েছে সর্বত্র। এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যে অভিভুত হয়ে যেমন এসেছেন বিশ্বখ্যাত পরিব্রাজকরা , তেমনি এসেছেন পৃথিবীর অনেক রাজা-বাদশাহ্রা। প্রত্যেক মানুষের জ্ঞানার্জন করা অবশ্য কর্তব্য। ভ্রমণ করার মাধ্যমে ক্লান্তি ও গ্লানি দুরের সঞ্জিবনী শক্তি অর্জন এবং দেখে শেখার একটি উত্তম মাধ্যম রুপে বিবেচিত।
এ সিলেট’র বিশ্বনাথ উপজেলার এক ভ্রমণ পিপাসু , তথ্য ও তত্ত্ব সংগ্রাহক হিসাবে ধাবিত হচেছন আলোর দিশারী রুপে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিতে অনুজ প্রতিম ইলিয়াস আলী। পরিব্রাজক সেজে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে তিনির ভ্রমণ ডাইরী করছেন সমৃদ্ধ। একজন সমাজ সচেতন , দেশপ্রেমিক ও পরিব্রাজক রুপে সংগ্রাহকের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি হলে ইতিহাসের উপাদান সন্ধানী বললে অত্যুক্তি হবে না। তাছাডা এ পৃথিবীতে জানার শেষ নেই তা প্রমাণিত সত্যেরই অংশ বিশেষ বলে পরিগণিত। বহু শ্রমলব্ধ ও কষ্টার্জিত অভিজ্ঞতার ফসল ইদানিং মিশর ঘুরে এসে লিখেছেন , “ মিশরের পথে পথে” নামক মুল্যবান একটি গ্রন্থ। ইতিপূর্বে যদি ও তিনি ভ্রমণ করেছেন চীনের প্রাচীর , আগ্রার তাজমহল ইত্যাদি ঐতিহাসিক স্থান সমুহ। যাক বিগত ফেব্রুয়ারী মাসের ৪ তারিখ রাত অনুমান দশ ঘটিকায় মুঠোফোনে ইলিয়াছ আলী জানালেন তিনির অসুস্থ পিতাকে নিয়ে সিলেটের ইবনেসিনা হাসপাতালে আছেন। জিজ্ঞেস করলাম কবে দেশে আগমণ করেছেন। প্রতি উত্তরে জানালেন একদিন পূর্বেই এসেছেন এবং তিনি দেশে আসলে অবশ্যই আমার খোজ-খবর নিয়ে থাকেন। আবার নুতন বই প্রকাশিত হলে তা প্রদান করেন অত্যন্ত আন্তরিকতার সহিত। পরদিন আমি সুযোগ সৃষ্টি করে নিলাম সিলেট গিয়ে তিনির অসুস্থ পিতাকে দেখার। সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌছে সাক্ষাৎ পেলাম। কোশলাদি বিনিময়ের পাশাপাশি অনেক কিছু নিয়ে আলাপ আলোচনা হল। এ সময় আমাকে প্রদান করলেন দু’টি বই। একটি তিনির রচিত “ মিশরের পথে পথে ” এবং অপর বইটি হাসনাত মোহাম্মদ আনোয়ার রচিত “ কাকন ফকিরের গান ” বইটি। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়। বিশ্বনাথ উপজেলা থেকে প্রথম পত্রিকা প্রকাশের কৃতিত্ব যেমন রহমত আলী সাহেবের। তিনি “ মাসিক বিশ্বনাথ দর্পণ ” পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। তেমনি বিশ্বনাথের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্বলিত প্রথম গ্রন্থ ( সম্পাদক ) প্রকাশের কৃতিত্ব অর্জনকারী হচেছন মোহাম্মদ ইলিয়াস আলী। বইটির নাম দিয়েছেন তিনি “ বিশ্বনাথের ইতিহাস ও ঐতিহ্য “। প্রকাশকাল হচেছ মে ২০০৪ সাল। যদ্যপি পরবর্তীতে আরো অধিক তথ্য সম্বলিত বিশ্বনাথের আরেক কৃতি সন্তান রফিকুল ইসলাম জুবায়ের সম্পাদনা পরিষদ নিয়ে “ আলোকিত বিশ্বনাথ ” নামক গ্রন্থ ( সম্পাদক ) প্রকাশ করে আলোচনার শীর্ষ পর্যায়ে অবস্তান করছেন। প্রকাশকাল মে ২০১০ সাল। উল্লেখ্য উভয় গ্রন্থ প্রকাশকাল মে মাস। এটা কি অলৌকিকতা নাকি কাকতালীয় ? ব্যবধান মধ্যখানে ছয় বৎসরের। আরেকটি তথ্যের সংযোজন এখানে করা অপরিহার্য। আমি ১৯৯৪ সালে পবিত্র ভুমি সৌদি আরবে প্রবাসী হিসেবে থেকে উদ্যোগ নিয়েছিলাম বিশ্বনাথের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্বলিত “ বিশ্বনাথ ডাইজেষ্ট ” নামক গ্রন্থ প্রকাশের। এ ব্যাপারে অনেক তথ্য ও আমি সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু নানাবিধ সমষ্যা আমাকে তা থেকে বঞ্চিত করলে ও আমার অনুজ প্রতিমদ্বয় তা সম্পন্ন করায় আমি তাদেরকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করি অকুণ্ঠ চিত্তে। সে সাথে গর্বিত বিশ্বনাথবাসী। এদিকে মাসিক বিশ্বনাথ ডাইজেষ্ট নাম নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে রফিকুল ইসলাম জুবায়েরের সম্পাদনায় পত্রিকাটি নিয়মিত হচেছ প্রকাশিত। কি বিচিত্রময়তা!
বইটি পাঠ করে প্রাপ্তি স্বীকারসহ কিছু লিখার অদম্য স্পৃহা থাকলে ও নানাবিধ সমষ্যা আমাকে পিছিয়ে দিয়েছে। সুতরাং এ বিলম্বতা আমার অনিচছাকৃত। এ পৃথিবীতে আশা , ইচছা করলেই সকল কিছু পূরণ করা সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে অপূর্ণতার বেদনা নিয়েই সংগ্রাম করে যেতে হয়। যাক আসছি মুল প্রসঙ্গে – মোহাম্মদ ইলিয়াছ আলীর মিশরের পথে পথে বইটি ঊৎস প্রকাশনীর কর্ণধার মোস্তফা সেলিম প্রকাশ করেছেন। প্রকাশকাল অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৩। প্রচছদ একেঁছেন সমর মজুমদার। বোর্ড বাঁধাই মুল্য রাখা হয়েছে ১২৫ টাকা। উন্নত সাদা কাগজে সুন্দর ঝকঝকে প্রিন্টিং ,বানান বিভ্রাট অতি নগণ্য। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে নি:স্বার্থ সমাজ সেবক , লেখক আলহাজ মো: বশির মিয়াকে। প্রচছদ একেছেন সমর মজুমদার। প্রচছদের ছবিগুলি বইটির আকর্ষন ও মুল্যায়ন বৃদ্বির পূর্ণ সহায়ক। এক কথায় বইটি তথ্যবাহী আকর্ষিক বলে আমার কাছে মনে হয়েছে।
লেখক ইলিয়াস আলী বইটির ভুমিকায় লিখেছেন , “ পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম হল মিশরের পিরামিড। বর্তমানে পিরামিড ছাড়া অন্য ছয়টি আশ্চর্য বিলুপ্তÑ কোনটি প্রাকৃতিক কারণে , কোনটি মানুষের কারণে। পিরামিড ছাড়া ও মিশর নানা কারণে জগদ্বিখ্যাত। মিশরের প্রাচীন সভ্যতা গর্বের ধন। সেখানকার নীল নদ , স্ফিংস , প্রাচীন চিত্রলিপি , কায়রো জাদুঘর , মমি , আলেকজান্দ্রিয়া বাতিঘর , আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরী , আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতির কথা ছেলেবেলা থেকেই বই পত্রে পড়েছি। পড়তে পড়তে মুগ্ধ হয়েছি। তখনই মনে জেগেছে যদি একবার মিশর যেতে পারতাম। পিরামিড দেখার স্বপ্ন তখন থেকেই দেখেছি। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হবে ভাবিনি। দীর্ঘকাল প্রতীক্ষার পর এ সাধ পূর্ণ হল ”। লেখকের লেখা থেকেই আমরা তিনির ইচছা পূরণের ধারাবাহিকতার কথা সুস্পষ্ট ভাবে অবহিত হতে পারলাম। তিনি ভুমিকার মধ্যে অন্যত্র লিখেছেন , “ মিশরের সব ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে বহুদিন লাগবে”। ১৩ অক্টোবর ২০১০ সাল থেকে ১৯ অক্টোবর ২০১০ সাল। ব্যবধান মাত্র সাত দিনের। এ সাত দিনের ভ্রমণে তিনির পক্ষে যতটুকু সম্ভব দেখার ও তথ্য সংগ্রহের
তা আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন মিশরের পথে পথে বইটির মাধ্যমে। অন্যত্র তিনি বলেছেন , মিশর ভ্রমণ সম্পর্কে লেখার জন্য তিনির শুভানুধ্যায়ীরা বার বার তাগিদ দিয়েছেন। সুতরাং এদিক বিবেচনায় নিলে শুভানুধ্যায়ীরা ও সম্পাদক ঊভয়েই ধন্যবাদ প্রাপ্তির দাবীদার। কারণ শুভানুধ্যায়ী কর্তৃক অনুপ্রাণিত না হলে আমরা হয়ত এ মুল্যবান বইটি ছাপার অক্ষরে দেখতে পেতাম না। বইটি পাঠক সমাদৃত হবে বা ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য পাঠ করা অতীব জরুরী বলে আমি মনে করি।
প্রথম দিন অর্থ্যাৎ ১৩ অক্টোবর ২০১০ সালের বিকাল বেলা কায়রো বিমান বন্দরে নেমে গাড়ী সংগ্রহ করতে পুলিশের যে সহযোগিতা ও আন্তরিকতা পেয়েছিলেন তা তিনি প্রকৃত অর্থে অনুধাবন করেই বলেছেন , “ একটু খুশি হলাম পুলিশের এমন আচরন দেখে ”। আবার উষ্মা প্রকাশ করেছেন , “ আমাদের দেশের পুলিশ এমন ব্যবহার করাতো দুরের কথা , পারলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করতো ” বাক্যের মধ্য দিয়ে। উভয় দেশের একটি বাস্তব সচিত্রতা অল্প কথায় পাঠককে উপহার দেয়ার সক্ষমতায় চিত্রিত। আবার প্রথম হোটেলে উঠেই আরবীয় বিয়ের অনুষ্টান দর্শনে আমাদের দেশের বিয়ের অনুষ্টানের সহিত যে পার্থক্য তা ব্যক্ত করেছেন পরিমিতবোধ থেকে।
লেখক তাদেরকে বিভিন্ন স্তানে নিয়ে যাবার জন্য ড্রাইভার নির্বাচন করতে যেয়ে সতর্কতা অবলম্বনের কথোপকথনে আমাকে স্মরণ করতে হল সৈয়দ মুজতবা আলীর “ দেশে বিদেশে ” ভ্রমণ কাহিনীর আব্দুর রহমান নামক ভৃত্য নির্বাচনের সময় সৈয়দ মুজতবা আলীর স্বগোক্তি ছিল “ কুইনাইন জ্বর সারাবে বটে। কিন্তু কুনাইন সারাবে কে ?” অভয় পেয়ে হয়েছিলেন নিশ্চিত। এক্ষেত্রে ও দেখা যায় ইলিয়াস আলী সঙ্গির নিকট থেকে ভয় দুরীভুতে নিয়োগ দানের নিশ্চয়তা প্রদানে।
ড্রাইভারের নাম মাঝদিক হলে ও মাঝি নামে ডাকার অনুমতি নিয়ে সহজবোধ্যতা ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যল্পতায় ভিন দেশের সামাজিক আবহ। অন্যদিকে নামের এ সংক্ষিপ্ততা আমাদের দেশে হলে অনেক ক্ষেত্রে উপহাস তুল্য ভাবা হত।
দেখা থেকে শেখা এবং অবলোকন থেকে জানার প্রত্যাশায় মধ্যপ্রাচ্যের জীবন যাপনের ইতিবৃত্ত উপস্থাপন করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরণের প্রতিকুলতার হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। একান্ত কাছে থেকে গভীর ভাবে দেখা এবং ব্যক্তিগত অনুভবের সাথে উপলব্ধিগুলোকে বর্ণনার মাধ্যমে জীবন্ত করে তোলা হয়েছে। যারা মিশর ভ্রমণে গেছেন বা যাবেন তাদের জন্য বইটি অধিক উপযোগি। সে দেশে ভ্রমণকারীর যাপিত দিন রাত্রির আশা-আকাংখা , হাসি-কান্না , দু:খ-বেদনা বইটির প্রতিটি বাক্যে বিধৃত। পিরামিডের দেশখ্যাত মিশরের ঐতিহাসিক ঘটনা ও স্থানের বর্ণনা পরিচিতিসহ আনুষ্টানিকতা পালনের বিবরণ , আচার , প্রথা ইত্যাদি আনুসাঙ্গিকতার পরিচয় সুন্দর করে ফুঠিয়ে তুলেছেন। যেমন লেখকের বর্ণনাতে , “ সাক্কারা পিরামিড দেখার আগ পর্যন্ত কিন্তু জানতাম না পৃথিবীর এ পিরামিড সম্পর্কে ” অন্যত্র আবার বলা হয়েছে , “ জানতে পারলাম এ পর্যন্ত মিশরে যত পিরামিড আবিষ্কৃত হয়েছে সাক্কারার পিরামিড সবচেয়ে প্রাচীন ” কি চমৎকার বর্ণনা ভঙ্গি ? প্রাচীন মিশরীয় চিত্রলিপি ও শিলালিপির ফটো সংযোজিত করায় বইটির গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। পিরামিড , স্ফিংস ইত্যাদির অবস্তান ও ঐতিহাসিক বর্ণনা যে কোন ভ্রমণকারীর সহায়ক হবে বলা যায় নির্দ্বিধায়।
তৃতীয় দিবসে লেখক কায়রো যাদুঘর দেখতে যান। সেখানে রক্ষিত বিভিন্ন দেবদেবীর মুর্তি , সোনার মুকুট , স্বর্ণের কফিন , মমি ইত্যাদির পুরো ইতিহাসসহ বিবরণ পাঠে মনে ধারণা জন্মে যেন অনেকটা নিজ চক্ষে দেখা হচেছ। কারণ লেখক তার স্বভাবজাত ভাষায় অত্যন্ত বাস্তবভিত্তিক বর্ণনা প্রদান করেছেন। মিশরের পথে পথে বইটির নামকরণে লেখকের সরল সমর্পিত অনুভুতির এক কথায় সুন্দরতম প্রকাশ ঘটেছে।
সেই অনাদিকাল থেকে এ পৃথিবী পৃষ্টে মানুষের আসা-যাওয়া। জন্ম মৃত্যু আর আনন্দ বেদনার এখানে সংমিশ্রণ। এভাবেই চলে প্রত্যেকের প্রবাহমান জীবন। দিন যায় , রাত আসে। কখনো চলে যাওয়া দিবসটি যেমন ফিরে আসে না। তেমনি যাপিত জীবন। জীবন সে স্বল্পদীর্ঘ। কিন্তু প্রত্যেকটি মানুষের জীবন বিভিন্ন অনুভুতির এক অবিস্মরণীয় উপাখ্যানে বা ইতিহাসে পরিপূর্ণ। বইটির সে উপাখ্যানে লেখক একজন কথক। তাছাড়া বইয়ের প্রতিটি উচচারণই প্রাচীন ইতিহাসের অংশ থেকে নেয়া উপাদান। ঘটনাচিত্র লেখক তার আবেগঘন ভাষা ও আন্তরিকতায় জীবন্ত করে তুলেছেন। এখানেই লেখকের ও বইয়ের সার্থকতা নিহিত। আমরা লেখক ও বইয়ের সফলতা ও সার্থকতা কামনা করি হৃদ্যতায়।
লেখক মিজানুর রহমান মিজান পরিচালক চাঁন মিয়া স্মৃতি পাঠাগার রাজা গঞ্জ বাজার বিশ্বনাথ সিলেট। মোবা ০১৭১২ ৮৭৯৫১৬।