শ্রম আইনে প্রতিষ্টান-পুঞ্জঃ প্রেক্ষিত চা বাগান ও গার্মেন্টস শিল্প
ফকির মিলন শাহ্
বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এ সারাদেশের চা- বাগানকে একটি প্রতিষ্ঠান-পুঞ্জ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু একই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের গার্মেন্টর্স শিল্পকে যদি একই ধারায় প্রতিষ্ঠান পুঞ্জ হিসেবে ঘোষণা করা হলে বর্তমান জিএসপিসহ বিরাজমান গার্মেন্টস্ শিল্পের অনেক জটিল ও কঠিন সমস্যার সহজ সমাধান এত দিনে হয়ে যেত। প্রতিষ্ঠান-পূঞ্জর্ভূক্ত বাংলাদেশ চা- শ্রমিক ইউনিয়ন, রেজিঃ নং বি -৭৭ এর কার্যকরী কমিটির নির্বাচন, পঞ্চায়াত নির্বাচন এবং আঞ্চলিক কমিটির নির্বাচন আগামী ১০ আগষ্ট,২০১৪ মহা কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে সিলেট এবং চট্রগ্রাম বিভাগের ১৫৮টি চা বাগানের প্রায় ৯৪ হাজার ভোটার তাদের পঞ্চায়াত, আঞ্চলিক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। নির্বাচনী কার্যক্রম শ্রম পরিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসনের সম্বনয়ে সম্পন্ন করা হচ্ছে। শ্রম পরিদপ্তরের চা- শ্রম কল্যাণ বিভাগ, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজারে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কেন্দ্রীয় অফিস স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর আলোকে আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন, রেজিঃ নং ৭৭ রেজিষ্ট্রেশন এবং এ নির্বাচন কতটুকু আইন ও বিধিসন্মত তা পর্যালোচনার দাবী রাখে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন- ২০০৬ এর ১৮৩ নং ধারায় বর্ণিত প্রতিষ্ঠান পুঞ্জের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ‘‘ ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের উদ্দেশ্যে কোন প্রতিষ্ঠান-পুঞ্জ একটি প্রতিষ্ঠান বলিয়া বিবেচিত হইবে, এবং এই প্রতিষ্ঠান-পুঞ্জের অন্তর্ভূক্ত কোন প্রতিষ্ঠানে কোন স্বতন্ত্র ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা যাবে না।’’ এ আইনের ২ এর (৩২) উপ ধারায় প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে, ‘‘একই অথবা বিভিন্ন মালিকের অধীনে কোন নিদিষ্ট এলাকায় এমন একাধিক প্রতিষ্ঠান যেগুলিতে একই প্রকারের বা ধরনের শিল্প পরিচালিত হয।’’ আইনের ১৮৩ এর ৩ উপ ধারায় এলাকা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান-পুঞ্জ এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। (ক) ব্যক্তি মালিকানাধীন সড়ক পরিবহন,রিক্সাসহ, (খ) ব্যক্তি মালিকানাধীন অভ্যন্তরীণ নৌ- পরিবহন, (গ) অনুর্ধ ১০০ জন শ্রমিক নিয়োজিত দর্জি ও পোষাক প্রস্তুতকারী শিল্প,( গ) চা- শিল্প, (ঘ) জুট বেলিং, (চ) চামড়া শিল্প, (ছ) বিড়ি, (জ) হস্ত চালিত তাঁত, (ঝ) হোশিয়ারী,(ঞ) ছাপাখানা ইত্যাদি। এসংগে শ্রম আইনের এ ধারায় বাংলাদেশ গার্মেন্টস্ শিল্পকে সংযুক্ত করা হলো গার্মেন্টস্ শিল্পের তথা দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার রূপ অন্যরূপ হত। শ্রম আইনে উল্লেখ্য রয়েছে যে, সরকার যদি জাতীয় স্বার্থে উচিত বলে মনে করে, তাহলে সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা এ শিল্পের তালিকার সাথে অন্য কোন শিল্প যোগ করতে পারেন। তবে কেন সরকার গামেন্টস্ শিল্পের এ কান্তিকালে এবং জিএসপি সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের শর্ত সহজে পূরণের জন্য এ শিল্পকে শ্রম আইনের ১৮৩ ধারা অধীনে প্রতিষ্ঠান-পুঞ্জ ঘোষণা করছে না? এখানে প্রতিষ্ঠান -পুঞ্জ ঘোষণা করা হলে আর এককভাবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের দাবী উঠবে না। আর ভূইফোঁড় শত শত গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা ও সংগঠনও থাকতে পারবে না। এলাকা ভিত্তিক বা অঞ্চল ভিত্তিক চাÑ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের ন্যায় একটি বা একাধিক ট্রেড ইউনিয়ন থাকবে এবং সীমিত সংখ্যক ট্রেড ইউনিয়ন নেতা থাকবে, যারা প্রকৃত গার্মেন্টস্ শ্রমিক হবে। ফলে জিএসপি সুবিধা আদায় সহজ হবে আর গার্মেন্টস্ মালিকগণের ট্রেড ইউনিয়ন ভীতি কমে যাবে। এতে অনাকাংখিত ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের নেতাগিরির অবসান হবে এবং এ শিল্পে শৃংখলা ফিরে আসবে। রক্ষা পাবে দেশের সাধারণ গার্মেন্টস্ শ্রমিকগণ এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম হবে। সে সঙ্গে দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে।
প্রতিষ্ঠান-পুঞ্জ বলতে যে, সারা বাংলাদেশের একই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান পুঞ্জ ঘোষণা করা আমি কিন্তু তার পক্ষে নই। কারণ ভিন্ন ভিন্ন এলাকার মানুষরে ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা এবং জীবন যাত্রা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তাই এটা অঞ্চল ভিত্তিক, জেলা ভিত্তিক বা বিভাগ ভিত্তিক হতে পারে। যেমন গার্মেন্টস সেক্টররে ইপিজেডকে একটি অঞ্চল, গাজীপুর জেলা একটি জেলা ভিত্তিক এবং চট্রগ্রাম একটি বিভাগ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান-পুঞ্জ ভাগে ভাগ করে সরকার আন্তরিক হলে এবং নীতি নির্ধারণী মহল শ্রম আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ অনুসরণ করে বাস্তবতার আলোকে গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারী করতে পারে। এর ফলে চা-বাগানের ন্যায় প্রতিষ্ঠান পুঞ্জ হিসেবে গার্মেন্টস্ শিল্প একক ট্রেড ইউনয়নের অন্তর্ভূক্ত হতে পারবে। বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর ১৮৩ ধারার (৪) উপ ধারায় প্রতিষ্ঠান পুঞ্জের গঠন জাতীয়, আঞ্চলিক অথবা স্থানীয় ভিত্তিতে নির্ধারণ এবং ভিন্ন ভিন্ন শিল্পের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন এলাকা নিধারণ করার বিধান রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার চা- বাগানকে বাদ দিয়ে সিলেট ও চট্রগ্রাম জেলার সমগ্র চা বাগানকে একটি প্রতিষ্ঠান পুঞ্জ হিসেবে ঘোষণা করায় আইনের সঠিক প্রয়োগ বলে মনে হয় না। ঐসব এলাকার শ্রমিকদের এবং মালিকদের স্বার্থে একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান-পুঞ্জ গঠন এখন আইনগতভাবে প্রয়োজন। সিলেট এবং চট্রগ্রাম দু‘টি এখন ভিন্ন বিভাগ এবং জীবন যাত্রাও ভিন্ন । আর এতবড় এলাকা একটি মাত্র সংগঠন এবং তাদের নেতাদের হাতে বিশাল ক্ষমতা তুলে দেয়ার কারণে তাদেরকে স্বৈরাচারী ও দূর্নীতিবাজ হিসেবে গড়ে করে তোলার একটি সিড়ি হিসেবে সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। যা চা- শ্রমিকদের মাঝে বিব্রতরকর হিসেবে ইতিপূর্বে দেখা গেছে। মুষ্ঠিময় দু‘একজন নেতা দীর্ঘদিন ধরে সেখানে রাম রাজ্যত্ব চালিয়ে ছিল। চা- শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের কোটি কোটি টাকার হিসাবের গড়মিল রয়ে গেছে। এছাড়াও গোয়াইনঘাট-কানাইঘাট হতে রাঙ্গনিয়া পর্যন্ত দেখভাল করার একটি শ্রমিক সংগঠনের বিদ্যমান সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে যেমন অসম্ভব ব্যাপার, তেমনি ঐসব এলাকার শ্রমিকদের তাদের সুবিধা অসুবিধা ও সুখ দুঃখের কথা নেতাদের নিকট উপস্থাপন করাও অসম্ভব। এছাড়া বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ এর বিধান মতে কোন ট্রেড ইউনিয়ন কোন শাখা বা আঞ্চলিক কমিটি গঠন করতে পারবে না। অথচ বাংলাদেশ চা- শ্রমিক ইউনিয়ন- রেজিঃ বি-৭৭ এর আঞ্চলিক কমিটি এবং পঞ্চায়েত কমিটির বিধান কোন আইনে দেয়া হয়েছে, তা বোধগম্য নয়। অধিকন্তু উক্ত আইন পরিপন্থি আঞ্চলিক এবং পঞ্চায়েত কমিটির নির্বাচন শ্রম পরিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে পরিচলনা করার কোন আইনগত বিধান নেই। তবে কোন ট্রেড ইউনিয়নের অনুরোধক্রমে শ্রম পরিচালক কোন ব্যাসিক ইউনিযনের বা ফেডারেশনের কার্যকরী কমিটির নির্বাচন সম্পন্ন করে দিতে পারেন। শ্রম পরিচালক বাংলাদেশ শ্রম আইনের ২০২ ধারা বিধান মতে সিবিএ নির্ধারণী নির্বাচন করার এখতিয়ার রাখে। অথচ বর্তমানে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে সে সিবিএ নির্বাচন না করে ২০২ ধারা (১৫) উপ ধারার বিধান লংঘন করে কারচুপি যোগসাযসে বিনা প্রতিদ্বন্দিতার মাধ্যমে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বে আইনীভাবে সুবিধাবাদী দলকে সিবিএ ঘোষণা করা হচ্ছে। এ আইনের বিধান মতে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে কম পক্ষে ৩০% ভোট প্রাপ্ত্যতা সাপেক্ষে রেজিষ্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়ন সিবিএ ঘোষণা করতে পারেন।
দেশে শ্রম আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং শিল্পে শান্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রচলিত শ্রম আইনের যথাযথ গবেষণা করে এ ব্যাপারে যুগোপযোগী আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবী। সেসংগের উত্তরাঞ্চলের চা- শ্রমিকদের জন্য শ্রীমঙ্গলের ন্যায় পঞ্চগড়ে একটি চা- শ্রমিক কল্যাণ বোর্ড এবং একটি শ্রম কল্যাণ অফিস স্থাপন করা প্রয়োজন। বাস্তবতা হলো দেশে সকল আইনের গতি প্রকৃতি এবং বাস্তবতার আলোকে যুগোপযোগী গবেষণা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলিত শ্রম আইনের উপর এপর্যন্ত সরকারী পর্যায়ে কোন গবেষণা হয় নাই। শ্রম পরিদপ্তরের শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়তন টংগী, গাজীপুরে একটি গবেষণা সেল ১৯৭৯ সনে প্রকল্প হিসেবে চালু করা হয়েছিল। উক্ত গবেষণা সেলটি প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে আসে ১৯৮৫ সনে। প্রকল্পের কর্মকর্তা কর্মচারীরা পদোন্নতি পেয়ে শ্রম পরিদপ্তরের উচ্চপদস্থ পদে আসিন হয়ে ইতিমধ্যে অবসরে গেছেন। এখনও সেখানে প্রকল্প কর্মকর্তা, গবেষণা কর্মকর্তা ও গবেষণা সহকারী বিদ্যমান আছে এবং তারা সরকারী খাত থেকে বেতন ভাতাদি গ্রহণ করছেন। অথচ কাজের কাজ কাজকলা। এ দীর্ঘ সময়ে কোন গবেষণা হয়েছে বলে কোন নজির নাই। এ ব্যাপারে শ্রম পরিদপ্তর এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের কোন দায়বধ্যতা আছে বলে প্রতিয়মান হয় না। বিষয়টি গুরুত্ব দেশ ও জাতির স্বার্থে বিবেচনায় আনা জরুরী। এছাড়া মালিক পক্ষের এবং দেশের বিভিন্ন বে সরকারী সংস্তার মাধ্যমে এ বিষয়ে গবেষণা করা দরকার। এফবিসিআই এর একটি শ্রম সেল আছে এবং একজন অভিজ্ঞ শ্রম উপদেষ্টা আছেন। তিনি ইচ্ছা করলে এ ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।
দেশের গার্মেন্টর্স শিল্পের শান্তি -শৃংখলা রক্ষা করা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকাকে গতিশীল রাখার লক্ষ্যে চা- শিল্পের ন্যায় গার্মেন্টস্ শিল্পকে প্রতিষ্ঠান-পুঞ্জের অন্তর্ভূক্ত করে শ্রম আইনের সংশোধন এবং প্রতিষ্ঠান পুঞ্জের ট্রেড ইউনিয়নে শাখা কমিটি বা আঞ্চলিক কমিটি গঠনের বিধান চালু করা একান্ত প্রয়োজন বলে অভিজ্ঞ মহলের প্রত্যাশা।
ফকির মিলন শাহ্, শ্রমজীবী সংগঠক ও কলাম লেখক
E-mail: [email protected]