সিলেটে মুক্তস্বরের ব্যানারে তৎপর হিযবুত তাহরীর
নোমান বিন আরমানঃ পুনর্গঠিত হচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত উগ্র জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর। সিলেট নগরীকে তারা বেছে নিয়েছে তাদের তৎপরতা বিস্তার ও শক্তি সঞ্চয়ের সবচেয়ে নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে। ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি বলে খ্যাত এ নগরীর ধর্মপ্রাণ মানুষের সরল আবেগ হিযবুতের কার্যক্রমের পক্ষে বেশ অনুকূল। এ আবেগকে কাজে লাগিয়ে অনেকটা প্রকাশ্যেই কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি। প্রায় প্রত্যেক জুমার পরেই নগরীর কোনো না কোনো মসজিদের সামনে চলছে লিফলেট বিতরণ। গত ২৩ জুন নগরীর প্রাণকেন্দ্র বন্দরবাজারের আবু তোরাব মসজিদের সামনে একদল হিযবুত কর্মীকে লিফলেট বিলি শেষে ধীরেসুস্থেই চলে যেতে দেখা গেছে। গুরুত্বপূর্ণ এলাকার দেয়ালে দেয়ালে চলছে পোস্টারিং। গভীর রাত্রে বৈঠক বসছে প্রতিষ্ঠানে, হোটেলে। একাধিক সূত্র জানায়, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে হিযবুতের কর্মীরা ব্যবহার করছে নানা প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের ব্যানার। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের “ইয়ুথ ফর চ্যাঞ্জ”-এর স্বরূপ সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও সিলেটে “মুক্তস্বর সাংস্কৃতিক ফোরাম” ও লন্ডনে “আল-আহরার মিডিয়া” নামে সক্রিয় রয়েছে হিযবুতের দুটি মুখোশপরা অঙ্গসংগঠন।
মুক্তস্বরের প্রতিষ্ঠা ২০০৮ সালে। এর মূল পরিকল্পনাকারী আফগান-ফেরত মুজাহিদ ও ‘লাহোর থেকে কান্দাহার’ বইয়ের লেখক সৈয়দ মবনু। প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি নোমান বিন আরমান ও সম্পাদক ফায়জুর রহমান ওরফে আহবাব ওরফে ফাইয়্যাজ, দুজনই কাজিরবাজার মাদরাসার সাবেক ছাত্র। ২০০৯ সালের ৪ জুলাই টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে সিলেটে কোদাল মিছিল করে সামাজিক সংগঠন হিসেবে প্রথম পরিচিতি পায় মুক্তস্বর। যদিও তাদের ছাপানো গঠনতন্ত্রে এই জাতীয় কর্মসূচির পরিকল্পনা ছিল না। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুক্তস্বরের সব সদস্যই বিভিন্ন কওমি মাদরাসার ছাত্র এবং নিষিদ্ধ হবার আগে পর্যন্ত প্রকাশ্যে সকলেই ছিল হিযবুতের সক্রিয় সদস্য। তন্মধ্যে বর্তমান সভাপতি আবু যর রেজোয়ান, সম্পাদক ফায়জুর রহমান, সহ-সম্পাদক সালমান আহমদ, প্রচার সম্পাদক সাদিকুর রহমান ও সাংগঠনিক সম্পাদক সালেহ ফুয়াদ হিযবুতের কেন্দ্রীয় তত্ত্বাবধানে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। হিযবুত তাহরীর ছাড়াও বর্তমানে মুক্তস্বরের অধিকাংশ সদস্যই জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে যুক্ত। শিবির-সংশ্লিষ্টতার প্রতিবাদ করায় মুক্তস্বরের সদস্যরা ২০০৯ সালে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি নোমানকে মুক্তস্বর থেকে বহিষ্কার করে।
মুক্তস্বরের বর্তমান সম্পাদক ফায়জুর রহমান বর্তমানে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী। গত ৩০ জুন আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে মুঠোফোনে হত্যার হুমকি দিয়ে তিনি র্যাবের হাতে গ্রেফতার হন। হুমকিতে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদ- দেওয়া হলে আইনমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট বিচারকদের হত্যা করা হবে। এর আগে একইভাবে অর্থমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দিয়ে গত বছরের ৩০ জুন কদমতলি এলাকা থেকে রিভলভারসহ ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন ফায়জুর। তখন ধনাঢ্য সৈয়দ মবনু ও হুজির সাবেক মহানগর আমীর ছাতকের মাওলানা ইসলাম উদ্দিনসহ হিযবুতের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রচুর অর্থ খরচ করে তার জামিন করিয়ে নিতে সক্ষম হন। এবারও উৎকোচের মাধ্যমে জামিনের চেষ্টা চলছে। সেজন্যে তালতলার রহমানিয়া বোর্ডিং ও বারুতখানার সিটি প্রেসের মালিক সৈয়দ মবনু ছাড়াও লন্ডন থেকে টাকা পাঠাচ্ছেন মুক্তস্বরের সহ-সম্পাদক এবং লন্ডনস্থ ‘আল-আহরার মিডিয়া’ ও এর মুখপত্র মাসিক ‘আল-আহরার’-এর নির্বাহী সম্পাদক সালমান আহমদ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পূর্ব-লন্ডনের ব্রিকলেন এলাকার জনৈক ইমাম জানান, পত্রিকা প্রকাশ ছাড়াও আল-আহরার মিডিয়ার লোকজনকে সিলেটে দুঃস্থদের সাহায্য প্রভৃতি নানা মানবকল্যাণমূলক কাজের কথা বলে প্রায়ই চাঁদা তুলতে দেখা যায়। সিলেটের বালুচরে অবস্থিত জামিয়া সিদ্দিকিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি সৈয়দ মবনুও প্রতি বছর লন্ডনে এসে মাসখানেক সময় অবস্থান করে অর্থ সংগ্রহ করেন এবং আল-আহরার অফিসে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে একাধিক সেমিনার ও ঘরোয়া আলোচনাসভায় মিলিত হন। উল্লেখ্য, জামিয়া সিদ্দিকিয়া দীর্ঘদিন ধরে সিলেটে জঙ্গিদের নিভৃত আস্তানা হিসেবে গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। এর প্রতিষ্ঠাতা-মুহতামিম ছিলেন হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মাওলানা আব্দুস সামাদ, যিনি ২০১১ সালের ২৬ মে ঢাকার সাভার থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরকসহ র্যাবের হাতে আটক হন।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নগরীর বন্দরবাজারের কাষ্ঠঘর এলাকায় অবস্থিত ‘আল-মদীনা’ আবাসিক হোটেলের দোতলায় মুক্তস্বরের স্থায়ী অফিস। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এখানেই এর অধিকাংশ গোপন বৈঠক ও সাপ্তাহিক ‘আসর’ অনুষ্ঠিত হয়। বহুতল এ হোটেলটির মালিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মাওলানা আবদুল মালিক চৌধুরী। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এখানে শহরের কিছু মাদরাসার ছাত্র প্রতি শুক্রবার বিকেলে সাহিত্য আসর করে। তবে আমি তাদের আসরে কখনও উপস্থিত থাকি না। এরা কোনো জঙ্গী সংগঠনের সদস্য কি না, সে বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’