ইরাকি সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হচ্ছে বাংলাদেশীরা
সুরমা টাইমসঃ ইরাকি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশীদের সঙ্গে অসদাচারণ, এমনকি তাদের নিগ্রহ করার অভিযোগ উঠেছে। বার্তা সংস্থা এএফপির ২রা জুলাইয়ের এক প্রতিবেদনে দুই বাংলাদেশীর বরাতে বলা হয়েছে, ইরাকি সেনাবাহিনীর শিয়া সদস্যরা তাদের প্রহার করেছে। তাদের নগ্ন হয়ে হাঁটতে বাধ্য করা হয়েছে। বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে সুন্নি বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। গতকাল মিডলইস্ট আই ডট নেটের ওয়েবসাইটে এএফপির বরাতে এ খবর প্রকাশ করা হয়েছে।
ঢাকায় ইরাক প্রত্যাগত রকিবুল ইসলাম এএফপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘গত বৃহস্পতিবার আমাদের ক্যাম্প মসজিদের ইমামকে তারা আটক করে নিয়ে যায়। শনিবার তাকে ছেড়ে দেয়ার পরে এখন দেখতেই পাচ্ছেন তার কি হাল তারা করেছে। তার শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। তারা সিগারেট দিয়ে তার দাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর পর ছুরি দিয়ে তা কেটে ফেলে। পাথর দিয়ে তার শরীরেও আঘাত হানা হয়েছে। তিনি সুন্নি। তাই তার প্রতি এ আচরন। আমরা তার অপহরণের প্রতিবাদে কাজ বন্ধ করে দিলে তাকে ফেরত দেয়া হয়েছিল।’
মফিদুল ইসলাম আরেক প্রত্যাগত। যে ২১ জন সম্প্রতি ইরাক থেকে ফিরে আসেন মফিদুল এদের একজন। তার কথায়, ইরাকিরা শ’ শ’ বাংলাদেশীকে নির্যাতন করেছে। তারা মনে করে, দাড়ি হলো সুন্নি বিদ্রোহীর প্রতীক। আর তাই যার দাড়ি দীর্ঘ দেখে তাকেই তারা বেশি নির্যাতন করে।
ঢাকায় সরকারি একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তারা আটকে পড়াদের ফিরিয়ে আনতে সাহায্য দিতে প্রস্তুত। কিন্তু তারা আসতে অনিচ্ছুক। কারণ তারা অনেক ধারকর্জ করে ইরাকে কাজ করতে গেছে। বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের সচিব শওকত হোসেন এএফপিকে বলেন, ‘বাংলাদেশীরা দেশে ফিরতে চায় না।’
হেলিকপ্টার থেকে গুলি, লড়াই তীব্র : ইরাকে তটস্থ বাংলাদেশীরা
ইরাকের তিকরিতে কয়েক হাজার বাংলাদেশী, ভারতীয় ও নেপালি শ্রমিকের চোখেমুখে আতঙ্ক। নতুন করে অভ্যন্তরীণভাবে সৃষ্টি হওয়া যুদ্ধের মধ্যে আটকা পড়ে তাদের অবস্থা শোচনীয়। অনেকেই গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন স্টোরেজ ডিপোটে। তাদের ভয় সরকারি সেনাবাহিনী ও আইসিস জঙ্গিদের। সরকারি সেনারা তাদেরকে আইসিস-এর সদস্য মনে করতে পারে। আইসিস মনে করতে পারে তারা সরকারের অনুগত। এমন আতঙ্কে দুরুদুরু বুকে তারা ক্ষণ গুনছেন। মাথার ওপরে উড়ছে হেলিকপ্টার। কোন কিছু নড়াচড়া দেখলেই তার ওপর মুহুর্মুহু গুলি ছুড়ছে। ফলে যেসব স্থানে বাংলাদেশী শ্রমিকরা আশ্রয় নিয়েছেন সেখান থেকে বেরুতে পারছেন না। এমন ভীতিকর বর্ণনা দিয়েছেন শেখ বেলাল। কয়েক ডজন বাংলাদেশীর সঙ্গে একটি ডিপোতে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। তার বাড়ি বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। বয়স ২৯ বছর। পেশায় তিনি ছিলেন একজন কৃষক। গত বছর নির্মাণ শ্রমিকের কাজ নিয়ে গিয়েছেন ইরাকে। বাংলাদেশী সহ দক্ষিণ এশিয়ার শ্রমিকরা যুদ্ধকবলিত ইরাকে কেমন আছেন তার একটি চিত্র এভাবে তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। এতে আরও বলা হয়, ইরাকে সরকারি সেনা ও সুন্নি মতাবলম্বীদের মধ্যে ক্রমাগত যুদ্ধ তীব্র থেকে তীব্র হয়ে উঠেছে। এখন ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের জন্মভূমি তিকরিতে চলছে তীব্র লড়াই। সেখানেই আটকা পড়েছেন বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার হাজার হাজার শ্রমিক। ২০০৩ সালে ইরাক আগ্রাসনের পর ইরাক একেবারে স্থিতিশীল না হলেও গত কয়েক বছরে বিপুল সংখ্যক অভিবাসী সেখানে পাড়ি জমিয়েছেন উন্নত জীবনের আশায়। তারা কেউ নির্মাণ শ্রমিক। কেউ নার্স। কেউ গৃহপরিচারিকা। ইরাকে গিয়েছেন প্রায় ১০ হাজার ভারতীয় শ্রমিক। বাংলাদেশ বলছে, সেখানে রয়েছেন বাংলাদেশের ৩৫ হাজার শ্রমিক। এ সপ্তাহে ভারত তার নাগরিকদের ইরাক ত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে তারা পারস্য উপসাগরে একটি নৌজাহাজ পাঠিয়েছে। এ জাহাজে করে ভারতীয় নাগরিকদের উদ্ধার করে নিয়ে আসা হবে। কিন্তু তীব্র গুলির লড়াইয়ের মধ্যে কোন অভিবাসী শ্রমিকই আবাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। ফলে উদ্ধারের এ চেষ্টা অনেকটাই জটিল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশী শ্রমিক শেখ বেলাল বলেছেন, প্রথমে তিনি তিকরিত টিচিং হাসপাতালে শরণার্থীর মতো আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও যখন হামলা করা হলো তখন সেখান থেকেও পালাতে বাধ্য হন তিনি। তিনি ও বেশকিছু বাংলাদেশীকে অল্প সময়ের জন্য আটক করেছিল সুন্নিপন্থি যোদ্ধারা। তারা তাদেরকে ছেড়ে দিলে শেখ বেলাল ও অন্যরা এখন আশ্রয় নিয়েছেন একটি গুদামে। তিনি বলেছেন, সেখানে কোন বিদ্যুৎ নেই। তাদের কাছে যে খাবার মজুত ছিল তাও ফুরিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবার তিকরিত হাসপাতালের বেসমেন্টে আশ্রয় নিয়েছিলেন ৪০ জনেরও বেশি ভারতীয় নার্স। এ তথ্য ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। এতে বলা হয়েছে, তাদের অবস্থা নাজুক। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবার উদ্দিন এ কথা বলেছেন। ওদিকে ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড আল শামস (আইসিস) তিকরিতে ওই হাসপাতালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। সেখানে আটকা পড়েছিলেন ভারতীয় কমপক্ষে ৪৬ জন নার্স। আটকা পড়েছিলেন বাংলাদেশী নির্মাণ শ্রমিকরাও। বুধবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এমন দাবি করেছে। ভারতীয় এক শ্রমিক কপিল সিং (২৭)। তিনি ও প্রায় ২০০ ভারতীয় শ্রমিক ছিলেন হিল্লা শহরে। এক সপ্তাহ আগে তাদেরকে বলা হয় তারা ভারতে ফিরে যেতে পারবেন। কপিল সিং ইরাক থেকে ফোনে বলেছেন, আমরা ইরাকে নিরাপদ নই। যুদ্ধ আমাদের দোরগোড়ায় পৌঁছার আগেই আমরা দেশে ফিরতে চাই। কিন্তু যে কোম্পানি তাদেরকে নিয়োগ করেছে তারা তাদের পাসপোর্ট ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ফলে এক্ষেত্রে একটি বড় জটিলতা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে ইরাকের কারবালা শহরে পাঠানো হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা পিকে শর্মাকে। এর আগেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তাদের নাগরিকদের উদ্ধারে পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু এবার ঢাকায় বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও কল্যাণবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা শওকত হোসেন বলেছেন, সরকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে ইরাক থেকে বাংলাদেশী অভিবাসীদের উদ্ধারে প্রস্তুত রয়েছেন তারা। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ইরাকের রাজধানী বাগদাদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস গত মাসে ইরাকের মসুল শহর থেকে ৫১ বাংলাদেশীকে উদ্ধার করেছে। তবে তারা সবাই দেশে ফিরতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বরং তারা ইরাকের যেকোন স্থানে থাকতে পছন্দ করছেন। কিন্তু এ কথার সঙ্গে শেখ বেলালের বক্তব্য মেলে না। তিনি বলেন, দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাদেরকে বলেছেন লড়াই থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। শেখ বেলাল বলেন, আসলে সবই আমার দুর্ভাগ্য। আমি চাই শান্তি ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা।