ফাহমিদা ভালো হয়ে যাও
বিআরটিএ’র দূর্ণীতিবাজ অফিস সহকারী ফাহমিদাকে যোগাযোগমন্ত্রী
“ফাহমিদা ভাল হয়ে যাও। তোমার বিরুদ্বে বিস্তর অভিযোগ আমি শুনেছি। আমি কিন্তু আগের মতন আর কাউকে ধমকাই না। আমি এবার একশন নেব। তোমাকে শেষ সুযোগ দিয়ে গেলাম। তোমার বিরুদ্ধে আর কোন অভিযোগ যেন না শুনি।”
মাস দুয়েক আগে সরাসরি আকস্মিক অভিযান চালিয়ে সিলেট বিআরটিএ অফিসের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ফাহমিদাকে কথাগুলো বলেছেন খোদ যোগাযোগমন্ত্রী অবায়দুল কাদের। কিন্তু চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী।
লাগামহীন দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সিলেট অফিস। দালাল বেষ্টিত এই অফিসে দালাল চক্র আগাম খবর পেয়ে সটকে পড়ায় তিনি কাউকে হাতেনাতে ধরতে পারেননি। এ সময় ক্ষুব্ধ মন্ত্রী বিআরটিএ’র এই কর্মকর্তাকে ভর্ৎসনা করেন। তাৎক্ষণিক তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়ে যান অসৎ কর্মকর্তা ও দালাল চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। মন্ত্রী এমন দায়িত্ব দিয়ে গেলেও তদন্ত কমিটির সদস্যরা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকার সুযোগে বিআরটিএ অফিসে ফিরে এসেছে সেই পুরনো অবস্থা। সরকারি দফতর হলেও অফিসের চেয়ার-টেবিলজুড়ে প্রায় প্রতিদিনই বসে থাকে দালালরা। এমনকি অফিসে সংরক্ষিত ফাইল ভলিউম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অনেকটা দাফতরিক কাজও সেরে নেয়। মন্ত্রীর ভাষায় “সর্ব অংগে ব্যাথা ওষুধ দেব কোথা”। এই অফিসের প্রায় সব কর্মকর্তাই দূর্ণীতিতে নিমজ্জিত। এদের মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত সুন্দরী সুহাসিনি ফাহমিদা। ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেস, রেজিস্ট্রেশন, নবায়ন, নাম পরিবর্তনসহ বেশ কিছু কাজ ফাহমিদার নিয়ন্ত্রনে। আর এসব কাজ তিনি ঐ সব দালালদের দিয়েই করিয়ে থাকেন। কোন কাজে কেউ সরাসরি ফাহমিদার কাছে গেলে তিনিই কাজ সম্পন্ন করার জন্য দালালদের কাছে পাঠিয়ে দেন। এমনকি দালালদের ‘সুপারিশ’ ছাড়া ফাহমিদা কোন কাগজেই সই করতে চান না। তার টেবিলের দুইপাশে ফাইলের স্তুপ দেখে নচিকেতার সেই বিখ্যাত গানের কথাই শ্মরন করিয়ে দেয়। “ আমি অফিসেতে বসে বসে আনন্দ লোপ করি তাড়া থেকে ছাড়া পেল সঞ্জয়, আর টেবিলেতে আমার ফাইল এসে জমে জমে দুর থেকে মনে হয় হিমালয়। কারও ফাইল পাস করে র্নিলজ্জের মত হাত খানা পেতে দিতে পারি, আমি সরকারি কর্মচারি।”
তৃতীয় শ্রেণীর বেতন স্কেলে বেতন পেলেও ফাহমিদার বাসা ভাড়াই তার মূল বেতনের প্রায় তিনগুন। স্বামী ঢাকায় ব্যাবসায়ী। কালেভাদ্রে সিলেট আসেন। তার নিজের কোন গাড়ী না থাকলেও প্রায় সন্ধ্যায়ই একটি গাড়ীতে করে একজন সুদর্শন পুরুষ বিআরটিএ অফিসের সামনে থেকে ফাহমিদাকে তুলে নিয়ে যান। অফিস চলাকালীন সময়েই দিনের বেশীর ভাগ সময়ই ফাহমিদা তার বাচ্ছাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া ও স্কুল থেকে নিয়ে আসার কাজে ব্যায় করে থাকেন। তাছাড়া বাসায় অসুস্থ মাকেও প্রায় দিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয় নিজেকেই। যে কারনে ফাহমিদাকে প্রায় সময়ই অফিসে পাওয়া যায়না। সিলেট বিআরটিএ’র প্রতিটি শাখা থেকেই রয়েছে ফাহমিদার বাড়তি আয়। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে লাইসেন্স বানিজ্য। উদাহরন হিসেবে বলা যায়; ২৬/১২/২০১৩ ইং তারিখে অনুষ্ঠিত ড্রাইভিং লাইসেন্সের লিখিত পরীক্ষায় প্রায় ১৫০০ পরিক্ষার্থী অংশ নেয়। বিআরটিএ ভবনের নোটিস বোর্ডের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী এ পরীক্ষায় পাস করে ২০৭ জন পরিক্ষার্থী। কিন্তু ফিল্ড টেষ্টে সরেজমিনে দেখা যায় প্রায় ১৩০০ পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। পরীক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায় তারা প্রত্যেকেই ৫ থেকে ৮ হাজার টাকায় চুক্তি করেছন লাইসেন্স পাবার জন্য। নোটিসবোর্ডে তাদের নাম না থাকলেও তারা প্রত্যেকেই লাইসেন্স পেয়েছেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে কিছু পরিক্ষার্থী শুধু লিখিত পরীক্ষায় পাস করার জন্য ৭০০ থেকে ১০০০ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। এখানে ১৫০০
পরীক্ষার্থীর মধ্যে যদি ১০০০ পরিক্ষার্থীও ১০০০ টাকা করে ঘুষ দিয়ে থাকে তাহলে প্রতিবার শুধু লিখিত পরীক্ষায় পাস করার চুক্তি বাবদ আয় হয় দশ লক্ষ টাকা। প্রথমেই এই টাকার একটি বৃহৎ অংশ ফাহমিদা ও তার দালালগোষ্টিরা ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। জানা যায় বিআরটিএ অফিসের বড়কর্তাদেরও বিষয়টি জানা আছে। তবে সূত্রমতে বড়কর্তাকে ফাহমিদা গং প্রতি লাইসেন্সে ২০০ টাকা হিসেবে আদায় করেন বলে তথ্য দিয়েছেন। এই হিসেবে অফিসের বড়কর্তা যদি এই টাকার ভাগ পেয়েও থাকে তবে ২০০ টাকা হিসেবে মোট যে টাকার অংক দাড়ায় বড়কর্তা শুধু তারই হিস্যা পেয়ে থাকেন। প্রতি লাইসেন্স বাবৎ বাকী ৮০০ টাকাই চলে যায় ফাহমিদা ও তার নিয়ন্ত্রিত দালালদের পেটে। তারপর বাকী দু’শ টাকার হিস্যাতো আছেই। এতো গেল একটি শাখা। আমাদের পরবর্তী সংখ্যাতে ধারাবাহিকভাবে সিলেট বিআরটিএ’র প্রতিটি দূর্ণীতিবাজ কর্মকর্তা ও দালালদের প্রতিবেদন তুলে ধরব। ফাহমিদার আরও অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য আমাদের হাতে আছে। আছে গোপন ক্যামেরায় তোলা অনেক তথ্য। অনেক অপকর্মের খতিয়ান। সংবাদের সংক্ষিপ্ততার খাতিরে এ পর্বে ফিরে যাই মন্ত্রীর কথায়। ক্ষুব্ধ মন্ত্রী বিআরটিএ’র অনিয়ম দূর্ণীতি রোধে একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছিলেন। গঠিত কমিটির প্রধান করা হয়েছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মোঃ আবু জাহির এমপিকে। চার সদস্যের কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন ইমরান আহমদ এমপি, শফিকুর রহমান চৌধুরী এমপি ও সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শহিদুল আলম। মন্ত্রী ১৫ দিনের মধ্যে দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন চাইলেও তদন্ত কমিটির প্রধান বলছিলেন গণশুনানি শেষেই রিপোর্ট যাবে। মন্ত্রীর নির্দেশের পর ঢাকঢোল পিটিয়ে তদন্ত কমিটি গণশুনানি করলেও এই কমিটির চার সদস্যই যথাসময়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রদানেও ব্যর্থ হয়েছেন। এই সুযোগে ফাহমিদা চক্র আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কমিটির একাধিক সদস্য সাংসদ হওয়ায় তারা প্রয়োজনীয় সময় দিতে না পারায় তদন্ত প্রক্রিয়া থমকে আছে বলে জানা গেছে। একজন ক্ষুব্ধ গ্রাহক বললেন, মন্ত্রী এসে হাতেনাতে দালাল ধরলেন, তদন্ত কমিটিও গঠিত হলো। তদন্ত কমিটি গণশুনানি করলেও কেন দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, তা রহস্যজনক। তিনি অভিযোগ করেন, গণশুনানির দিন বিআরটিএ অফিসের কর্মকর্তা ও দালাল চক্র বাইরে অবস্থান করায় ভয়ে অনেকেই সাক্ষ্য দিতে আসেননি। তবে ৩০টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে। গণবিজ্ঞপ্তি ও স্থানীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দেয়ার কথা থাকলে ও সংশ্লিষ্টরা বিজ্ঞপ্তি দেননি। বিআরটিএ অফিসের চিহ্নিত এক দালাল কয়েক জনকে দিয়ে দুর্নীতিবাজদের পক্ষে বক্তব্য রাখার সুযোগ করে দেন। অবশ্য বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিবেদন জমা দিতে ব্যর্থতার জন্যে কমিটির সদস্যদের ‘ধরা’ হবে। এ ব্যাপারে বিআরটিএ সিলেট কার্যালয়ের উপপরিচালক শহিদুল হক বলেন, ‘আমি সিলেট অফিসে নতুন এসেছি। অফিসকে দালালমুক্ত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাব।’