নড়াইলে ১০কোটি টাকার গুচ্ছগ্রাম নির্মাণে দুর্নীতি ও অনিয়ম
ঘর পেয়েছেন সচ্ছল ব্যক্তিরা! দিয়েছেন ভাড়াও
এমপি বললেন “গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের বেশির ভাগ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে”
নড়াইল প্রতিনিধিঃ নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় পাঁচটি গুচ্ছগ্রাম নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গুচ্ছগ্রামে ভূমিহীনদের ঘর পাওয়ার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা দেয়া হয়নি। যাদের ঘরবাড়ি আছে, তারাও ঘর পেয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘর পেয়ে তাই অনেকে ভাড়া দিয়েছেন। অনেকে আবার বিক্রিও করে দিয়েছেন। মাইগ্রাম গ্রচ্ছগ্রামসহ অন্যান্য প্রকল্পের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঘরবাবদ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের হাতে ২৫-৩০ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। নিয়ম থাকলেও গুচ্ছগ্রামগুলোতে বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়নি। জানালা, দরজাসহ পিলার ও দেয়ালে ঠিক মত রঙ করা হয়নি। অথচ ছয়মাস আগে মাইগ্রাম, রায়গ্রাম ও পাংখারচর গুচ্ছগ্রামে বসবাস শুরু হয়েছে। এদিকে, মঙ্গলহাটা ও শিয়েরবর গুচ্ছগ্রামের কাজও শেষের দিকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পাঁচটি গুচ্ছগ্রাম নির্মাণে ১০ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে ১৬৩টি ঘর। এর মধ্যে রায়গ্রামে ৪০টি এবং পাংখারচরে ৩৩টি এবং মঙ্গলহাটা, শিয়েরবর ও মাইগ্রামে ৩০টি করে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি ঘর, রান্নাঘর ও টয়লেট নির্মাণ বাবদ এক লাখ ৩৭ হাজার ৫শ’ এবং হলরুম নির্মাণে ৭ লাখ ১৮ হাজার ৩শ’ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। গুচ্ছগ্রামের সুবিধাভোগীসহ এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন বসতঘর, রান্নাঘর ও ল্যাট্রিন তৈরিতে সর্বোচ্চ ৭০-৮০ হাজার টাকা এবং হলরুম নির্মাণসহ আসবাবপত্র বাবদ ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মঙ্গলহাটা গুচ্ছগ্রাম নবগঙ্গা নদী ভরাট করে নির্মাণ করা হচ্ছে। আর এটি মঙ্গলহাটায় নির্মাণ না করে লোহাগড়া পৌরসভার রাজুপুরে করা হচ্ছে। তবে, কাগজপত্রে মঙ্গলহাটা মৌজা হিসেবে দেখানো হয়েছে। এছাড়া ড্রেজার দিয়ে নবগঙ্গা নদী থেকে বালু উত্তোলন করে রায়গ্রাম গুচ্ছগ্রাম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এতে করে আশেপাশের লোকজন নদী ভাঙন আতঙ্কে আছেন। এদিকে, গুচ্ছগ্রাম নির্মাণে ‘কাবিখা’র শ্রমিক দিয়ে মাটি ভরাটের কথা থাকলেও ড্রেজার দিয়ে ভরাট করার কারণে শ্রমিকেরা তাদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আর মাইগ্রাম, রায়গ্রাম ও পাংখারচর গুচ্ছগ্রাম বাস্তবায়নে মাটি ভরাটের প্রয়োজন হয়নি। শুধু ঘরের মধ্যে অল্প কিছু মাটির প্রয়োজন হয়েছে। অথচ, ওই তিনটি গুচ্ছগ্রামে মাটি ভরাটের জন্য ১শ’ ১৭ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ ছিল। যার সরকারি মূল্য ৩৮ লাখ ৮১ হাজার টাকা। যে টাকার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া শিয়েরবর গুচ্ছগ্রামে মাটি ভরাটের জন্য ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ১শ’৬৯ টাকার চাল বরাদ্দ হলেও মাত্র ৫০ হাজার টাকার মাটি ভরাট করা হয়েছে বলে জানা গেছে। গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দাদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের যথাযথ প্রাপ্য থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। প্রতিটি পরিবারে ঘরের সাথে চার শতক জমির দলিল দেয়ার নিয়ম থাকলেও রায়গ্রাম গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পে তা দেয়া হয়নি। অন্যান্য গুচ্ছগ্রামে দলিল পেলেও জায়গা বুঝে পাননি। গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, প্রতিটি পরিবারের জন্য ৩০০ বর্গফুটের একটি ঘর, রান্নাঘর ও টয়লেট নির্মাণ করা হবে। তবে, লোহাগড়ার পাঁচটি গুচ্ছগ্রামের ঘরের বারান্দাতেই ছোট্ট পরিসরে রান্নাঘর করে দেয়া হয়েছে। গুচ্ছগ্রামের গৃহিনীরা জানান, এই রান্নাঘরে আগুনের ঝুঁকি নিয়ে রান্না করতে হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ জানার পর লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেবেকা খান গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দাদের নিজ খরচে রান্নাঘর তৈরি করে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
এদিকে, মাইগ্রাম, রায়গ্রাম ও পাংখারচর গুচ্ছগ্রাম নির্মাণের ছয়মাস যেতে না যেতেই বেশির ভাগ পিলার ও দেয়াল ফাটল ধরেছে। টিনের চালাও ছোট করে দেয়া হয়েছে। এ কারণে হালকা বৃষ্টি হলে ঘরে মধ্যে পানি প্রবেশ করবে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা। পাংখারচর গুচ্ছগ্রামের ৫-৬টি ঘরে নিজ খরচে ৩ হাজার টাকার মাটি পর্যন্ত দিতে হয়েছে। প্রতিটি গুচ্ছগ্রামের একটি করে হলরুম নির্মাণ করা হলেও তা মানসম্মত হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে হলরুমগুলোতে মধ্যে ফাটল ধরেছে। স্থানীয়রা জানান, কোনো রকম সিমেন্ট দিয়ে কাজ করা হয়েছে। গভীর নলকূপ স্থাপন করা হলেও বেশিরভাগ নলকূপে পানি উঠছে না বলে জানা গেছে। কোনোটিতে আবার আয়রন পানি উঠছে। নোয়াগ্রাম গুচ্ছগ্রামের নলকূপগুলো পাকা না করায় পাইপের গোড়া নড়ে গেছে। এতে করে ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব ও লোহাগড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তহমিনা খাতুন বলেন, আমি এখানে (লোহাগড়ায়) যোগ দেবার আগেই বেশিরভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ইউএনও সব কাজ তদারকি করেছেন। কমিটিতে থাকলেও আমি তেমন কিছু জানি না। ইউএনও রেবেকা খান বলেন, আমি মালামাল কিনে ঠিকাদার দিয়ে কাজ করিয়েছি। এ কারণে কিছুটা ত্রুটি থাকতে পারে। আর মাটি ভরাটের কাজ করেছেন, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানেরা। তিনি দাবি করেন, কাজ ভালো না হলে এ প্রকল্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ার তো টাকা ছাড়তেন না। নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের বেশির ভাগ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এছাড়া নদী ভরাট করে গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ কোনোভাবেই কাম্য না। এদিকে, দ্রুত গুচ্ছগ্রাম নির্মাণে সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ লোহাগড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেবেকা খান সরকারি ভাবে ১১ দিনের (১-১১ মে) শ্রীলংকা ও মায়ানমার সফর করেছেন। এ ব্যাপারে গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারাসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।