জুতো : আবু মালিহা

একদা এক বালক তার মায়ের কাছে বায়না ধরল ভাল জুতো কিনে দেয়ার জন্য। কেননা তার স্কুলের সহপাঠীরা খুব দামী ভাল জুতো পরে স্কুলে যায়। কিনতু সে খালি পায়ে প্রতিদিনই স্কুলে যাতায়াত করে। এতে তার মন খুব খারাপ থাকে এবং পায়েও ব্যাথা অনুভব করে। গ্রামের পথে নিয়মিত স্কুলে যেতে এমন কষ্ট তার অনেকটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। তবুও কখনো খুব জোরের সাথে তার মাকে জুতো কেনার জন্য আবদার ধরেনি। কারণ তার মতো অনেকেই ছেঁড়া জুতো বা খালি পায়ে স্কুলে যাওয়া আসা করতো। বালক বয়সে তেমন কোন মনোপীড়ার কারণ হতো না। এখন সে একটু একটু করে বড় হতে চলেছে এবং উপরের ক্লাসে উঠেছে। বোধকরি ব্যক্তিত্ব এবং মনের অভিলাষ ও আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে। সে কারণেই প্রায় সময়ই সে তার দরিদ্র মাকে জুতো কেনার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলো। এভাবে কিছুদিন চলে গেলো। তবুও দুঃখিনী মা তাকে জুতো কিনে দিতে পারলো না। এতে তার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। স্কুলে প্রায়ই তার সহপাঠীরা জুতো না নেয়ার জন্য মন্তব্য করতো। এতে তার মন আরও খারাপ হয়ে যেতো। একদিন সে স্কুল থেকে ফেরার পথে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো যে করেই হোক তার মাকে জুতো কিনে দেয়ার জন্য চাপ দিবে। মনের আগ্রহটা এখন জেদী মনোভাবে পরিণত হলো। যদিও সে জানে তার মায়ের পক্ষে ভাল দামী জুতো কিনে দেওয়া অনেকটাই কষ্টকর। তবুও সে নাছোড়বান্দা। যে করেই হোক তার জুতো লাগবেই! অতএব আজকের সিদ্ধান্তে সে অটল। মাকে বাধ্য করবে জুতো কিনে দেওয়ার জন্য।

সেদিন স্কুল থেকে ফিরে সে আর কোন খাওয়া দাওয়া করলোনা। অভিমান করে চালা ঘরের এক কোণে মুখভার করে বসে আছে। মা তার কাছেই কাজ সেরে এলো খাবার দেয়ার জন্য এবং চললো বাছা… হাত-মুখ ধুয়ে খাবার খেতে এসো। আমি প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছি। দু’একবার ডাকাডাকি করার পরও যখন সে খেতে বসলো না, মা তার কাছে এসে বললো, কি হলো… তোমার! ভাত খাবে না। এভাবে চুপচাপ বসে আছো কেনো! কি হয়েছে, অসুখ করেছে, নাকি! এভাবে তো কখনো বসে থাকোনা। লক্ষী! সোনা, গুমড়া মুখো হয়ে বসে আছো কেন, খিদে লাগেনি, ভাত খাবেনা। তখন সে মুখ গম্ভীর করে বললো, না- আমি ভাত খাবোনা। আমাকে জুতো কিনে না দিলে ভাত খাবোনা। তুমি এখন পর্যন্ত আমাকে জুতো কিনে দাওনি’।
মা তখন বুঝতে পারলেন ছেলের আবদারের কথা। কিন্তু মনে মনে ভীষণ রুষ্ট হলেন ছেলের ব্যবহারে! কেননা, স্বামী মারা যাবার পর থেকেই তিনি তার ছেলেকে অনেক কষ্টে এবং সতর্কতার সাথে স্কুলে পাঠিয়ে পড়াশুনা করাচ্ছিলেন এবং দারিদ্রতার আবরণকে চাপা বেদনায় সয়ে সয়ে ছেলেকেই একমাত্র বড় করতে চাইছিলেন ভবিষ্যত সুখের প্রত্যাশায়। এবং কঠোর শাসন নিয়মের মধ্যেই ছেলেকে বড় করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে ছেলে বেয়াড়া বা অভদ্র আচরণ করবে তা তিনি ভাবতে পারেন না। তাই আজকের ঘটনাটা মাকে একটু বিব্রত এবং ব্যাথায় ভারাক্রান্ত করলো। তাই তিনি ছেলেকে ধমকালেন এবং মনের অগোচরে ছেলের আবদার রাখতে না পেরে কষ্টে চোখের অশ্র“ ফেলছিলেন। আড়াল থেকে ছেলের দৃষ্টি এ বিষয়টি এড়াতে পারেনি। সেও মায়ের এহেন পরিস্থিতিতে একটুখানি ভড়কে গেলো এবং মায়ের মনের কষ্ট বুঝতে পেরেছিলো। যাই হোক, পরের দিন সে নিয়মিত স্কুলে যাচ্ছিল। পথে যেতে যেতে গতকালের দুঃখজনক পরিবেশের স্মৃতিটি বার বার তার মনকে কাতর করছিল মায়ের মন খারাপ করার জন্য। এমনি ভাবনাতে সহসাই তার চোখে পড়লো তার মতোই একটি ছেলে পথ দিয়ে যাচ্ছিল, যার কিনা একটি পা’ই নেই। তার সমস্ত মন শিউরে উঠলো এবং মনে মনে মহান আল্লাহকে কৃতজ্ঞতা জানালো এবং বললো। হায় আল্লাহ! আমি তো বড়ো নাফরমান বান্দা! তার নিজের অপরাধবোধ তাকে লজ্জিত করে ফেললো। যখন সে দেখলো যে, আমারই মতোন একটি ছেলে, যার একটি পা’ই নেই। সেও তো লাঠি ভর দিয়ে চলাচল করছে। অথচ আমার দু’টো সুন্দর পা থাকার পরও আমি কতো মহা অকৃতজ্ঞ। শুধু এক জোড়া জুতোর জন্য আমি আমার মা’কে কতোই না কষ্ট দিয়েছি। অথচ তার একটি পায়ের অভাবে সুস্থ্য ও সুন্দরভাবে চলাফেরাও করতে পারছে না। এতো বড়ো কষ্ট পৃথিবীতে আর কী আছে! নাহ্, আমার মাকে আর জুতোর জন্য বায়না ধরবো না। আমার এতো সুন্দর পা দিয়ে অনায়াসে স্কুলো যাতায়াত করতে পারছি। আমার মালিক আমাকে মহা সম্পদ দানে ধন্য করেছেন। আমি তার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ। তখন তার সেই ছেলেটির প্রতি দয়া ও করুণা ঝরে পড়তে লাগলো এবং দোয়া করতে লাগলো। বাড়ি ফিরে সাথে সাথে মায়ের পা’ জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইতে লাগলো এবং স্কুলে যাওয়ার পথে পূর্বাপর ঘটনা বর্ণনা করতে লাগলো। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আবেগ তাড়িত হয়ে বলতে লাগলো ‘মা… তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আমাকে ক্ষমা করো, আমার আর জুতো লাগবে না। আবেগে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলতে লাগলো.. মা গো’ আমার তো সুন্দর দু’খানা পা আছে, সেই ছেলেটির তো একখানা পা’ও নেই…. একথা শুনে মা তার পরম তৃপ্তিতে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধররেন এবং ছেলের কৃতজ্ঞ মনের শুভ বুদ্ধি উদয়ের জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করলেন এবং প্রতিটি বাবা-মায়ের যেন এমন কৃতজ্ঞ চিত্তের সন্তান হয়, তাই কামনা করলেন। (একটি নীতিকথা অবলম্বনে)

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট, সভাপতি-সিলেট কেন্দ্রীয় লেখক ফোরাম। মোবা: ০১৭১৬৮৯৫৮২২