জামাই আদরেই চলছে র্যাবের জামাইদের জিজ্ঞাসাবাদ!
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর পুলিশ রিমান্ডে থাকা র্যাবের চাকরিচ্যুত তিন কর্মকর্তাকে জামাই আদরে রাখা হয়েছে বলেই অভিযোগ করেছেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান। রিমান্ডের আসামি হওয়া সত্ত্বেও তাদের উন্নত খাবার, পত্রিকা, নরম বিছানা, ফ্যান, ডাক্তার সবই চাহিদামত সরবরাহ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সোমবার দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সংশ্লীষ্টরা এই অভিযোগ করেন। একই অভিযোগ করেছেন নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলামও। দ্রুত র্যাবের চাকরিচ্যুত এই তিন কর্মকর্তাকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা হাজতখানায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি জানিয়েছেন তারা।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মুহিদ উদ্দিন বলেন, সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পর তা সাংবাদিকদের জানানো হবে। এ বিষয়ে কোনো লুকোচুরি করা হবে না।
বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় এর বাইরে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। এমনকি খাবার, পরিবেশ এবং পত্রিকা সরবরাহের বিষয়েও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
জানা গেছে, এই তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। পুলিশের আলাদা তিনটি টিমের ১২ জন সদস্য পর্যায়ক্রমে আড্ডার ছলে তাদের কাছ থেকে তথ্য আদায়ের চেষ্টা করছেন। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করা না গেলেও তারা একে অন্যকে দোষারোপ করে বক্তব্য দিচ্ছেন। এতে অনেকটাই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। এ অবস্থায় তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে বুধবার রাতে তিনজনকে মুখোমুখি করা হতে পারে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্রমতে, এখন পর্যন্ত তাদের আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও মূলত কথা বলছেন তারেক সাঈদ এবং এমএম রানা। অন্য কর্মকর্তা মেজর আরিফ এ বিষয়ে খুবই কম কথা বলছেন বলে জানা গেছে। তিনি এ বিষয়ে পুলিশকে সর্বোচ্চ তদন্ত করার পরামর্শ দিচ্ছেন।
পুলিশ লাইনের গারদখানার পাশে আলাদা তিনটি কক্ষে তিনজনকে রাখা হয়েছে। সেখানে কাঠের চেয়ার-টেবিল থাকলেও কোনো বিছানার ব্যবস্থা করা হয়নি। এ কারণে তাদের মেঝেতে ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে নরম তোশক ও বেডশিটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কক্ষগুলোতে সিলিং ফ্যান থাকলেও প্রচন্ড গরমের কারণে আলাদা করে নতুন তিনটি স্ট্যান্ডফ্যান দেয়া হয়েছে। দিনের বেশিরভাগ সময় এই তিনজন একাই রুমে অবস্থান করেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ সময় তারা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করে সময় কাটান। তবে গতকাল পর্যন্ত এই তিন সাবেক র্যাব কর্মকর্তার ব্যাপারে তাদের পরিবারের সদস্যরা কোনো খোঁজ-খবর নেননি বলে জানা গেছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিদিন সকালে তাদের দেশের প্রথম সারির ৬টি বাংলা পত্রিকা সরবরাহ করা হচ্ছে। পত্রিকাগুলোর মধ্যে দৈনিক যায়যায়দিন, প্রথম আলো, যুগান্তর, সমকাল, নয়া দিগন্ত ও কালের কণ্ঠ রয়েছে। সোমবার সকালে কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় নিজেদের ছবি দেখে বেশ উচ্চ কণ্ঠে পত্রিকা ও মিডিয়া মালিকদের গালাগাল করেন তারা। অশ্রাব্য ভাষায় কিছুক্ষণ গালাগাল করা হয় নূর হোসেনকেও। তাদের মধ্যে তারেক উঁচু গলায় দাবি করেন, ‘মিডিয়াও আমাদের পেছনে লেগেছে। কিন্তু একদিন সত্য বেরিয়ে আসবে।’ এমনকি নির্দোষ প্রমাণিত হলে এসব সাংবাদিককে দেখে নেবেন বলেও হুশিয়ারি দেন। নিজেরা নির্দোষ বলে র্যাব সদস্যরা তাদের পাশে আছেন বলেও সেখানে নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের জানান।
এদিকে, এই তিনজন কর্মকর্তাকে নারায়ণগঞ্জ শহরের একটি অভিজাত রেস্তোরাঁ থেকে উন্নত মানের খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে। গত শনিবার রাতে পুলিশ লাইনের একজন কর্মকর্তা এবং রোববার রাতে সাদা পোশাকের দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা ওই খাবার নিয়ে যান। খাবারের তালিকায় ছিল সকালে পরোটা, ডিম, সাদা সবজি, পাউরুটি ও জেলি। আর দুপুরে ছিল উচ্ছে ভাজি, ডাল, সাদা ভাত, কাঁচকি মাছের ভুনা ইত্যাদি। রাতের মেন্যুতে ছিল ফ্রাইড রাইস, সবজি ও চিকেন কারি। এছাড়া আটার রুটি, সবজি এবং দুধও দেয়া হয়।
নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত শনিবার রাতে পুলিশ লাইনের আরআই (এসআই পদমর্যাদার) একজন কর্মকর্তা নিজে এসে দুইজনের খাবার নিয়ে যান। পরদিন রোববার রাতে সাদা পোশাকের দুজন পুলিশ সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাবের একজন সদস্য আসেন। এরপর ওই সদস্যের মাধ্যমে তিনজনের খাবার নিয়ে পুলিশ সদস্যরা চলে যান।
উল্লেখ্য, ক্লাবের সদস্য ছাড়া খাবার বিক্রির কোনো নিয়ম নেই ক্লাবের গঠনতন্ত্রে। প্রথম দিন পুলিশ সদস্যরা খাবার নিলেও পরদিন ক্লাবের কর্তারা খাবার দিতে অপারগতা জানান। এ কারণেই একজন সদস্যকে ব্যবহার করে খাবার সংগ্রহ করে পুলিশ।
এদিকে এই তিনজনের জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুলিশ সুপারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুজন চিকিৎসকও দেওয়া হয়েছে। রিমান্ডে থাকায় অবস্থায় আদালতের নির্দেশ ছাড়া আসামিকে সার্বক্ষণিক চিকিত্সক দেওয়া বেআইনি—আইনজীবী নেতাদের এমন দাবির জবাবে জেলা সিভিল সার্জন বলেন, ‘রিমান্ডের আসামিদের চিকিত্সক দেওয়ার বিধান নেই। বিষয়টি গতকাল রোববার পুলিশ প্রশাসনকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে। বিষয়টি লিখিতভাবে পুলিশ প্রশাসনকে জানিয়ে দেওয়া হবে।’
তবে জেলা পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় কেউ অসুস্থ হলে তাঁকে চিকিত্সা দেওয়া হবে। তিনি বিষয়টিকে গণমাধ্যমে ভুলভাবে প্রচার বা অন্য দৃষ্টিতে না দেখার আহ্বান জানান।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সাধারণত সন্ধ্যার পরেই র্যাবের চাকরিচ্যুত ওই তিন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে প্রকৃত ঘটনা। তবে লে. কর্নেল সাঈদ তারেক বার বারই ঘটনা অস্বীকার করে বলেছেন, ঘটনার সময় তিনি আদমজীর ক্যাম্পে ছিলেন। তার মোবাইল ট্র্যাকিং করলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে। আর এমএম রানা বলেছেন, তিনি কখনোই সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় যাননি। এ ব্যাপারে সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী ক্যাম্পের লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। আর মেজর আরিফ একেবারেই নির্বাক রয়েছেন। এমএম রানা নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এ ঘটনার সঙ্গে র্যাবের সম্পৃক্ততা থাকলে তার দায় কর্নেল তারেকের ওপর বর্তায় বলে দাবি করেছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মেজাজি তারেক তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে শুরু থেকেই উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছেন। তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন দাবি করে এর বাইরে কোনো কথা বলতে চাইছেন না। এ কারণে পুলিশ কৌশলী হয়ে তার সঙ্গে কথা বলছে। গল্পের ছলে তার কাছ থেকে তথ্যে জানার চেষ্টা করছে।
তদন্ত সূত্র জানায়, গত শনিবার রাতে র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ এবং মেজর আরিফকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পুলিশ লাইনে যান জেলা পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার (অপরাধ)। পুলিশ সুপার খন্দকার মুহিদ উদ্দিন যান লে. কর্নেল তারেক সাঈদের কক্ষে এবং মেজর আরিফের রুমে যান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুব্রত পাল। তারা প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থান করেন সেখানে। মেজর আরিফ এ সময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মাঝেমধ্যে উত্তেজিত হয়ে কথা বলেন পুলিশ সুপারের সঙ্গে। তারেক এ সময় সাংবাদিকদের দায়ী করে বক্তব্য দেন। সাবেক এই দুই সেনা কর্মকর্তার এমন আচরণে হতভম্ব হয়ে যান তদন্ত তদারক এই দুই কর্মকর্তা। তারা বিষয়টি রাতেই ঊর্ধ্বতনদের জানান। এরপর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ, পুলিশ সদর দপ্তর, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ১২ জনের জিজ্ঞাসাবাদ কমিটি গঠন করেন পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা। এই কমিটির সদস্যদের কয়েকজন গত রোববার রাত ১০টার দিকে পুলিশ লাইনে গিয়ে আসামিদের সঙ্গে কথা বলেন এবং আড্ডা আর গল্পের ছলে হত্যাকা-ের বিষয়ে জানার চেষ্টা করেন। হত্যাকা-ের আগে ও পরে তাদের ভূমিকা কী ছিল, তা বের করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা বরাবরই নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেন। গণশুনানিতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তারেক পুলিশকে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ‘একেকজন প্রত্যক্ষদর্শী একেক ধরনের সাক্ষ্য দিয়েছে। কারো কথার সঙ্গে মিল নেই।’ উল্টো এসব সাক্ষ্য দেয়া ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, সেভেন মার্ডার মামলায় গ্রেপ্তারকৃত র্যাবের চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা শহরের পুরাতন কোর্ট এলাকায় অবস্থিত র্যাব-১১-এর স্পেশাল ক্রাইম প্রিভেনশন কোম্পানির সাবেক ইনচার্জ লে. কমান্ডার এমএম রানাকে পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। এর আগে র্যাব-১১-এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মাহমুদ এবং র্যাব-১১-এর মেজর আরিফ হোসেনকে গত শনিবার ৫ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। রিমান্ডের পর তিনজনকে মাসদাইরে জেলা পুলিশ লাইনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।