প্রতিদিন এভাবে মৃত্যু কেন?
দুর্ঘটনাজনিত প্রাণহানি গুম অপহরনের চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক
মীর আব্দুল আলীম: মাত্র পক্ষকাল আগে পটুয়াখালীর রামনাবাদ নদীতে লঞ্চডুবিতে প্রাণহানি হয়েছে ১৬ জন। সেই শোক কাটিয়ে না উঠতেই আবারও শোকগাথা রচিত হলো মেঘনায়। যখন লিখছি (১৫ মে) তখন এনদীতে ধারন করছে অসংখ্য লাশ। ৩ শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে উদ্ধার করা গেছে মাত্র ৩২ জনের লাশ। একই দিন টিভি স্ক্রলে দেখছি-‘মেজর হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়া হলো না ডা. সঞ্চিতার’। ঐ দিনই কুমিল্লায় বাস-এম্বুলেন্স সংঘর্ষে ৪জন নিহত হয়েছে। সকালে চট্টগ্রামের সীতাকু-ে হানিফ পরিবহনের একটি বাস ও কাভার্ডভ্যানের সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান সঞ্চিতা। আগামী ২১ মে মেজর হিসেবে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার কথা ছিল তার। দেশের সড়ক ও নদী পথে এখন এভাবে প্রতি নিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। পাশাপাশি অশংখ্য মানুষ আমৃত্যু পঙ্গুত্ব বরণ করছে।
আসলে বাংলাদেশে অপমৃত্যুর উদ্বেগজনক জায়গাটি কোথায়? দুর্ঘটনাজনিত প্রাণহানি। এ জাতিয় অপমৃত্যু হাল সময়ের আলোচিত গুম, খুন আর অপহরনের চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। পত্রিকান্তে জানতে জানতে পারি, বাংলাদেশে সড়ক, রেল ও নৌদুর্ঘটনায় গড়ে প্রতিবছর প্রায় সারে ১০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এছাড়া দুর্ঘটনাজনিত কারণে ফিবছর নষ্ট হচ্ছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। নৌ পথে বছরে অপমৃত্যুও সংখ্য অর্ধ সহ¯্রাধিকের কম নয়। কেবল সড়ক দুর্ঘটনায়ই দেশে গড়ে প্রতিদিন ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটছে। এ হিসাবে মাসে ৯শ’ জন এবং বছরে ১০ হাজার ৮ শ জন মারা যাচ্ছে। তবে সরকারি পরিসংখ্যানমতে এ সংখ্যা দিনে ১৬ এবং বছরে ৫ হাজার ৭ শ’ ৬০ জন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। আইন না মানাই হচ্ছে এসব দুর্ঘটনার মূল কারন। নিয়ম ভেঙে সামনের গাড়িকে ওভারটেক করতে যাওয়া, অদক্ষ ড্রাইভারের হাতে গাড়ি চালানোর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া, ড্রাইভারের অনুপস্থিতিতে হেলপারের গাড়ি চালানোর উদ্যোগ গ্রহণ, লন্স, ষ্টিমার কিংবা গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা না করেই রাস্তায় ও নদীতে নামানো। মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে নৌযান চালনা নৌ দুর্ঘটনার অন্যতম কারন। এ ক্ষেত্রে সকলকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশসহ চলমান প্রশাসন এ আইন প্রযোগে ব্যর্থ হলে প্রযোজনে তাদেও ঢেলে সাজাতে হবে অন্যথা দুর্ঘটনা রোধে নতুন করে র্যাবের মত দুর্ঘটনা রোধে বিশেষ বাহিনী গঠন করতে হবে।
দুর্ঘটনার অন্যতম কারন গুলোর মধ্যে (১) ত্রুটিপূর্ন যানবাহন রাস্তায় এবং নৌপথে চলাচল (২) মোবাইল ফোন ব্যবহার (৩) অতিরিক্ত যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন (৪) ট্রাফিক আইন না মান (৫) নিয়োজিতদের দায়িত্বে অবহেলা (৬) চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা ও অসতর্কতা (৭) অরক্ষিত রেল লাইন। আর এসব কারনে প্রতিদিনই ঘটছে হতাহতের ঘটনা। এভাবে প্রতি দিন মানুষ মরছে। দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। প্রশ্ন হলো দেশে ¯্রফে গাফিলতি এবং অনিয়ম জনিত একই ধরনে দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত কেন ঘটছে? অহেতুক মানুষের কে প্রাণ যাচ্ছে? সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং রাষ্ট্র পরিচালনর দায়িত্বে যারা কেউ কি এসব দেখেন না? দুর্ঘটনায় অহরহ মানুষ মরছে নদী আর সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যু এখন যেন ছেলের হাতের মোয়া। প্রতিবাদ হচ্ছে; কারন উৎঘাটিত হচ্ছে, আইনও হচ্ছে; প্রতিকার হচ্ছে না। কিন্তু কেন? দেশে সন্ত্রাস দমনে যদি বিশেষ র্যাব বাহিনী গঠন করা যায়, দুর্ঘটনা রোধে এ জাতিয় বাহিনী নয় কেন? এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশে সন্ত্রাসীদের হাতে শতকরা ৩০ জন লোক মারা গেলে দুর্ঘটনায় মারা যায় ৭০ জন। ৩০ জনের জীবনসহ অপরাপর জানমাল রক্ষায় সরকারের একটি বাহিনী থাকলে শতকরা ৭০ জনের জীবনসহ অসংখ্য অহত ও ডলারে কেনা পরিবহন রক্ষায় সরকার সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বাহিনী গঠন করছে না কেন? দেশের মানুষের জানমাল রক্ষা রাষ্ট্রেও দায়িত্ব। দুর্ঘটনা রোধে চরমভাবে ব্যর্থ সরকারকে দেশের মানুষের স্বার্থে যতসম্ভব দ্রুত ভাবতে হবে।
দেশে রেললাইনগুলো একে বারেই অরক্ষিত। রেলওয়ে সূত্র মতে, গত ২৬ মাসে ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৭৮ জন। এর মধ্যে রেলের সাথে বিভিন্ন পরিবহনের ৪৬ টি সংঘর্ষে ৩১ জন মারা। এছাড়া রেল সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দুর্ঘটনায় মারা যান ১৪৫ জন। রেললাইনের পাশ ঘেষে অবৈধভাবে বসতি স্থাপনসহ রেল লাইনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার না করাকেই এ দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তাছাড়া পথচারীরা মর্জিমাফিক রেল লাইন দিয়ে হাঁটা, আড্ডা দেয়া, কানে মোবাইলের হেডফোন দিয়ে অসতর্কভাবে গান শুনা এবং অভিমান করে রেল লাইনের নিচে ঝাপিয়ে পড়েও দুর্ঘটনা ঘটছে। একইসাথে ট্রেন চলাচলের সময় লেভেল ক্রসিংগুলোতে সিগন্যাল না মানাকেও দায়ী করা হচ্ছে। কেবল পূর্বাঞ্চল রেলের ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে গত তিন বছর ২ মাসে সিএনজি, পিকআপভ্যান, বাস ও মোটর সাইকেলের সাথে চলন্ত ট্রেনের মুখোমুখি সংর্ঘষের ঘটনায় মোট ৪৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মহিলাসহ ৩১জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০১১ সালে ১৫টি ট্রেন দুঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২জন, ২০১২ সালে ১৬টি দুর্ঘটনায় ৭জন নিহত, ২০১৩ সালে ১৪টি দুর্ঘটনায় ৮জন নিহত হয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে রেল দুর্ঘটনায় (ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু) ২০১২ সালে ৬৫ জন, ২০১৩ সালে ৬৪ জন এবং চলতি বছরে জানুয়ারিতে ৫ জন, ফেরুয়ারি ৫ জন এবং গতকালের দুর্ঘটনাসহ ৬ জন মারা গেছে। এ ছাড়া গত বছরের জানুয়ারিতে ৭ জন, ফেরুয়ারি ৪ জন, মার্চে ১ জন, এপ্রিলে ৬ জন, মে মাসে ৪ জন, জুন মাসে ৯ জন, আগস্ট মাসে ৮ জন, সেপ্টেম্বর মাসে ৮ জন, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে ৫ জন করে এবং ডিসেম্বর মাসে জন মারা যান।
প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একের পর এক অকালমৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না, এ দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবেলা করতে হচ্ছে, যা আমাদের কারো কাছেই কাম্য নয়। কয়েক মাস আগে খোদ জাতীয় সংসদে অনভিজ্ঞ ও অল্পবয়স্ক হেলপার বাস-মিনিবাস চালানোর ফলে দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানালেন যোগাযোগমন্ত্রী। তিনি বলেন গাড়ির সংখ্যা যে হারে বাড়ছে সে হারে দক্ষ চালক বাড়ছে না। ফলে সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক অমূল্য প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে আমাদের জীবন থেকে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক, শিশু, নববধূ-বরসহ পুরো বরযাত্রী, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা এমনকি সাবেক মন্ত্রীও এ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে নিহত হওয়ার খবর আমরা পত্রিকার পাতায় প্রত্যক্ষ করেছি। যার একটিও সহজভাবে মেনে নেয়া যায় না। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর ঘটনা যেমন আমাদের ব্যথিত করে, তেমনিভাবে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চরম অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভবও আমাদের মর্মাহত ও স্তম্ভিত করে। আমরা এর আগেও বহুবার লক্ষ্য করেছি, সড়ক দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি নিহত বা আহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিহতের ঘনিষ্ঠজন এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার কিছু লোক রাস্তায় নেমে রাস্তা অবরোধ, হামলা, গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে এক বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করেন। এতে কার কী উপকার হচ্ছে তা আমাদের জানা নেই। তবে এর ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ ও নির্দোষ জনগণ যারা কোনোভাবেই এ দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। যে কোনো হত্যার বিচার আমরা চাই, তবে কোনো হত্যা বা দুর্ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশের জন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়াক তা আমরা চাই না।
এসব অপমৃত্যু রুখতে হবে? যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। সে মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয়, তবে তা মেনে নেয়া আরো কঠিন। দুর্ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে; ঘটবেও। কেন তা রোধ করা যাচ্ছে না? আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় দেশে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। পরিশেষে বলবো, সকল দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় আনা হউক। আইন না মানার কারণেই একের পর এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটছে। নৌ, রেল ও সড়ক দুর্ঘটনা রোধে পরিবহন মালিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে সমন্বিত আন্তরিক, সচেতন, দৃঢ় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা আমরা আশা করি। সে সঙ্গে সরকারকেও এ ব্যাপারে কার্য্যকর ভুমিকা পালন করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। ই-মেইল [email protected]