কানাইঘাটে ব্যালট পেপার-ব্যালট বাক্স লুট, কেন্দ্র দখলের চেষ্টা ও জালভোট প্রদানের দায়ে মামলা
কানাইঘাট (সিলেট) প্রতিনিধিঃ ব্যালট পেপার, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, কেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান ও সহিংসতার মধ্য দিয়ে ৪র্থ দফায় গত রবিবার অনুষ্ঠিত সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে বিএনপি সমর্থিত আশিক উদ্দিন চৌধুরী (মোটর সাইকেল) প্রতীক নিয়ে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি আ’লীগ সমর্থিত নিজাম উদ্দিন আল মিজান (ঘোড়া) প্রতীকের চাইতে ৬হাজার ২৬৬টি ভোট বেশি পেয়ে তৃতীয়বারের মতো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। আশিক চৌধুরী পেয়েছেন ২৭হাজার ৫শত ৪০টি ভোট আর নিজাম উদ্দিন পেয়েছেন ২১ হাজার ২শত ৭৪টি ভোট। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামায়াত সমর্থিত মরিয়ম বেগম (পদ্মফুল) প্রতীক নিয়ে ২৬হাজার ২শত ৭১টি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি রুবি রানী চন্দ (কলস) প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১৪হাজার ৭শত ২৮টি ভোট। ভাইস চেয়ারম্যান পদে জমিয়ত নেতা মাওঃ আলিম উদ্দিন (চশমা) প্রতীক ২৩হাজার ৭শত ৬২টি ভোট পেয়ে এগিয়ে রয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি আ’লীগ সমর্থিত জাহাঙ্গীর আলম রানা (মাইক) প্রতীক নিয়ে ২২ হাজার ৫শত ৩৩টি ভোট পেয়েছেন। ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনায় শিবনগর দারুল কোরআন মাদরাসা ভোট কেন্দ্রের ফলাফল স্থগিত ঘোষণা করায় পরবর্তীতে উক্ত ভোট কেন্দ্রে পুনরায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত কেন্দ্রের মোট ভোট সংখ্যা ৩হাজার ৩শত জন। ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত কানাইঘাট উপজেলার নির্বাচনে ১লক্ষ ৬৪হাজার ৭৮০জন ভোটারের মধ্যে ভোট প্রয়োগ করেছেন ৬৯হাজার ৪শত ৮৮জন। ভোটের হার শতকরা ৪৭.৩৪র্%।- যাহা বিগত কয়েকটি নির্বাচনের চাইতে সর্বনিু ভোটার উপস্থিতি। নির্বাচনের দিন ব্যাপক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে সকাল বেলা শান্তিপূর্ণভাবে ৬৭টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। তবে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। মহিলা ভোটারদের উপস্থিতি ছিল তুলনামুলক কম। কোথাও ভোটারদের দীর্ঘ লাইন চোখে পড়েনি। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভোট কেন্দ্রগুলি ফাঁকা হতে শুরু করে। এই সুযোগে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা তাদের সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী নিজাম উদ্দিন আল মিজানের পক্ষে কয়েকটি ভোট কেন্দ্র বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে একযোগে দখলের চেষ্টা করে। কয়েকটি কেন্দ্রে ব্যাপক জাল ভোট প্রদান করা হয়। সাড়ে তিনটার দিকে প্রশাসনের পাশেই অবস্থিত রায়গড় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্র থেকে সরকারী দলের কিছু নেতাকর্মী প্রতিপক্ষ চেয়ারম্যান প্রার্থীদের এজেন্টদের মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। এর প্রতিবাদ করলে কেন্দ্রের বাইরে সংঘর্ষ শুরু হলে ১৫ জন আহত হন। কেন্দ্রের দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রিজাইডিং অফিসারের কাছ থেকে জোরপূর্বকভাবে ব্যালট পেপার নিয়ে ভোট কাস্টিং করা হয়। এক পর্যায়ে প্রিজাইডিং অফিসার ইসমাইল হোসাইন কেন্দ্রের ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপার একটি কক্ষে তালা মেরে পালিয়ে নিজের প্রাণ রক্ষা করেন। এসময় ঘটনার ছবি তুলতে গিয়ে মোহনা টিভির সিলেট অফিসের ক্যামেরাম্যান ফেরদৌস আহমদ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের হাতে গুরুতর আহত হন। তার ক্যামের লুট করা হলে পরবর্তীতে তা উদ্ধার হয়। আহত এ সাংবাদিককে সিলেট ওমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত ফোর্স কেন্দ্রে এসে পুনরায় ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া শিবনগর দারুল কোরআন মাদ্রাসা ভোট কেন্দ্র থেকে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পাঁচমিনিট পূর্বে ঘোড়া মার্কার সমর্থকরা অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে ৮নং বুথ থেকে ব্যালট পেপার ভর্তি একটি ব্যালট বাক্স লুট করে বীরদর্পে নিয়ে যায়। এসময় পুলিশ শ্রীপুর গ্রামের যুবলীগ নেতা বাশারের পিতা ছমছু মিয়া ও হারুনুর রশিদ নামে ২জন কে আটক করলেও গভীর রাতে তাদের থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে রাতের দিকে কেন্দ্রের অদূরে খোলা মাঠ থেকে ব্যালট বাক্স ভোট বিহীন অবস্থায় উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। উক্ত ভোট কেন্দ্রটি উপজেলা আ’লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র লুৎফুর রহমানের বাড়ীর পাশে অবস্থিত। তার উপস্থিতিতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে বলে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে। এ ঘটনায় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মোস্তাক আহমদ রবিবার রাতেই কানাইঘাট থানায় বাদী হয়ে স্থানীয় যুবলীগ নেতা বাশার, ছাত্রলীগ নেতা ফরহাদ, জামিল, দুলালের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরো শতাধিক লোকজনকে আসামী করে উপজেলা নির্বাচন বিধি মালা ২০১৩এর ৭৪/৭৭ তৎসহ দন্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় একটি মামলা করেন। থানার মামলা নং- (১৫) তাং- ২৩/৩/১৪।- এছাড়া বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র পরিদর্শন করে দেখা গেছে নির্বাচনের শেষের দিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা মালিগ্রাম, কালিনগর, মনসুরিয়া, বিষ্ণুপুর, রতনপুর, পর্বতপুর ভোট কেন্দ্র ছাড়াও কোথাও কোথাও কেন্দ্র দখলের চেষ্টা ও ব্যাপক জালভোট প্রদান করেছে। প্রতিপক্ষ চেয়ারম্যান প্রার্থীদের এজেন্ট এবং সমর্থকরা কেন্দ্রে শক্ত অবস্থান থাকায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আশিক চৌধুরী জয়লাভ করেছেন বলে ভোটাররা জানিয়ছেন। নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা পক্ষপাতিত্ব ছিল বলে অন্যান্য চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকরা জানিয়েছেন। বিশেষ করে বিভিন্ন কেন্দ্রের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার সময় রাত সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে ভাইস চেয়ারম্যানপ্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম রানা ও মাওঃ আলিম উদ্দিনের সমর্থকদের মধ্যে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে উভয় প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাক্কা-ধাক্কি, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হলে সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরা ব্যাপক লাঠি চার্জ করে ছত্রবঙ্গ করে দেয়। এতে ৩০-৪০জনের মতো আহত হন। এসময় উপজেলা আ’লীগের আহ্বায়ক মেয়র লুৎফুর রহমান নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে জোরপূর্বকভাবে নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহীনি তাদের তাড়িয়ে দেন। পরবর্তীতে সরকারী দলের নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে মিছিল করে। এসময় আতংক ছড়িয়ে পড়ে পুরো উপজেলা চত্ত্বরে।