বেকায়দায় মমতা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান কালোতালিকাভূক্ত ছিল!
আন্তর্জাতিক ডেস্ক :: গতকাল ভে্ঙ্গে পড়া ফ্লাইওভারটি নির্মাণ কাজ যারা করছিল সেটে ছিল রেলের খাতায় অনেক আগেই কালো তালিকাভুক্ত। খোদ হায়দরাবাদের সংস্থা হয়েও, শ্রমিক নিরাপত্তার প্রশ্নে তদন্তের মুখে পডতে হয়েছে গ্রেটার হায়দরাবাদ পুরসভার। কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে কালো তালিকাভুক্ত করেছে উত্তরপ্রদেশ জল নিগম। তবু ‘আইভিআরসিএল’ নামে সেই সংস্থার হাতেই বিবেকানন্দ উড়ালপুল তৈরির ভার ছেড়ে রেখেছিল এই রাজ্যের সরকার। যদিও কার্যত দেউলিয়া হতে বসা ওই সংস্থা গত বছরের শেষ ছ’মাস প্রকল্পের কাজ প্রায় বন্ধ রাখতেও বাধ্য হয়েছিল। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর নির্বাচনকে সামনে রেখে বেকায়দায় পড়েছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়।দুর্ঘটনার পর পরই ইস্যুটি সামনে চলে এসেছে।তবে এ ব্যাপারে মমতা সরকারের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে নির্মীয়মাণ সেই সেতুর ১০০ মিটার লম্বা একটি অংশ ভেঙে ২১ জনের মৃত্যু এবং অন্তত ২৭ জন আহত হওয়ার পরেই হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরল! দায়ের হল এফআইআর। সংস্থার কলকাতার অফিসে হানা দিল লালবাজার। কর্তাদের কাউকে না পেয়ে সিল করা হল অফিস। পুলিশ সূত্রের খবর, কর্তাদের খোঁজে রাতে হায়দরাবাদ রওনা দিয়েছে গোয়েন্দাদের দল।
উড়ালপুল তৈরির বরাত অবশ্য সংস্থাটি পেয়েছিল ২০০৭-০৮ সালে বামফ্রন্ট আমলে। ইউপিএ সরকারের ‘জেএনইউআরএম’ প্রকল্পের আওতায় ২০০৯ সালে বামফ্রন্ট সরকার ওই উড়ালপুল নির্মাণের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল আইভিআরসিএল সংস্থার হাতে। কথা ছিল হাওড়া ব্রিজ থেকে গিরিশ পার্ক ২.২ কিলোমিটার লম্বা এই উড়ালপুল ২০১১ সালের অগস্ট মাসের মধ্যে শেষ করে সরকারের হাতে তুলে দেবে ওই সংস্থা। ইতিমধ্যে রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল হয়। শুরু হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানা। ঘোষিত সময়ে কাজ শেষ হওয়া তো দূরের কথা, গত বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ন’বার সময়সীমা ছুঁতে ব্যর্থ হয় ওই সংস্থা। জমি জটের কারণে সময়ে কাজ শেষ না হওয়ার জন্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় ২০১৪ সালে সরকারের কাছে ৭২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণও দাবি করে সংস্থাটি। সরকারি সূত্রের দাবি, ঋণের পুনর্বিন্যাস ঘটিয়ে গত ডিসেম্বর মাস থেকে ওই প্রকল্পের কাজে নতুন করে হাত দেওয়া হয়।
২০০৭-০৮ সালে দরপত্রের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ওই সংস্থা কাজের বরাত পেয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারও অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্তু পরের দু’বছর ঠিকঠাক কাজ করা যায়নি। ২০১১ সালে উত্তরপ্রদেশ জল নিগম নির্মাণ কাজে খারাপ মাল ব্যবহারের অভিযোগে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করে। তার দু’বছর আগে শ্রমিক আইন না মানায় হায়দরাবাদ পুরসভাকে ওই সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার। এখানেই শেষ নয়, খারাপ কাজ করা ও সময়ে কাজ শেষ করতে না পারার কারণে রেল বিকাশ নিগম লিমিটেড ২০১৩ সালে তিনটি প্রকল্প থেকে সরিয়ে আইভিআরসিএলকে। ২০১৩ সালে তিনটি প্রকল্পে ওই সংস্থার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে আরভিএনএল। কেএমডিএ-র একাংশ বলছেন, সংস্থাটি তেল সরবরাহের লাইন এবং জলের লাইনের কাজ করতেই অভ্যস্ত। ওই কাজ পাওয়ার সময় উড়ালপুল বানানোর তেমন অভিজ্ঞতাও ছিল না।
‘কালো তালিকাভুক্ত’ হওয়ার বিষয়টি জানার পর সংস্থাটিকে সরানো হল না কেন? কেনই বা রাজ্যের সরকারের বদলের পরেও সংস্থাটির ‘ইতিহাস’ যাচাই করা হয়নি? এ সব প্রশ্নে রাজনীতির চাপানউতোরকেই ঢাল করছেন প্রাক্তন ও বর্তমান সরকারের কুশীলবেরা।
বামফ্রন্ট সরকারের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের দাবি, তাঁদের আমলে এই সংস্থার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বর্তমান সরকার এই সংস্থাকে সরাল না কেন? আসলে ওই সংস্থার নামে কাজ হলেও কারা কাজ করছিল, তা খোঁজ করে দেখা দরকার। ঠিকঠাক তদন্ত হলে সেটাই সামনে আসতে পারে। যদিও তা আসবে কি না সন্দেহ।’’ এই উড়ালপুল তৈরির জন্য দীর্ঘদিন নানা ভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ ও স্থানীয় নেতা সুধাংশু শীল। তাঁর অভিযোগ, প্রকল্পের সর্বশেষ বরাত দেওয়ার সময় চরম দুর্নীতি হয়েছে। তার উপর দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য মাত্রাতিরিক্ত রাজনৈতিক চাপ ছিল। কম টাকায়, দ্রুততার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে নিরাপত্তা, সতর্কতা— এ সবের উপর ঠিকাদার নজর দেয়নি। গুরুত্ব দেয়নি কেএমডিএ-ও। এ দিন রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ ঘটনাস্থলে যান সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি বলেন, ‘‘পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রয়োজন। তবে সরকারের তদন্তের উপরে নির্ভর করি না।’’ তার পরেই তাঁর সংযোজন, ‘‘এটা রাজনীতির জায়গা নয়, তাই আর কিছু বললাম না। মানুষ আছেন, সব দেখছেন। কোনও কিছুই চাপা থাকবে না।’’ কিন্তু উড়ালপুলের টেন্ডার তো তাঁদের সময়েই হয়েছিল। তাঁর জবাব, ‘‘বাম আমলে কী এই আমলে তা বলার জন্যে অনেক মঞ্চ রয়েছে।’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বর্তমান নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম কিন্তু দোষ দিচ্ছেন পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারকেই। ববির দাবি, ‘‘এখানে উড়ালপুল করা যে অনুচিত আমরা সেটা বুঝেছিলাম। কিন্তু বামফ্রন্টের আমলেই দরপত্রের মাধ্যমে বরাত পেয়ে এই সংস্থা কাজ শুরু করে দিয়েছিল। বহু টাকা খরচও হয়ে গিয়েছিল। সেই অবস্থায় কাজ বন্ধ করতে আমরা চাইনি। সংস্থাটি অন্য কোথাও কালো তালিকাভুক্ত হয়েছিল কি না সে সম্পর্কেও নির্দিষ্ট খবর আমাদের কাছে নেই। এখন এই ঘটনার পরে অবশ্যই সংস্থাটির কাজ করার প্রশ্ন ওঠে না। কেন এই ঘটনা তারও তদন্ত হবে।’’ বছর দুয়েক আগে এক মার্চের ভোরে উল্টোডাঙা উড়ালপুলও এ ভাবে ভেঙে পড়েছিল। সেই প্রসঙ্গ তুলে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় বলেন, ‘‘অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নির্মাণ কাজ চলছিল। রাজ্য যে উল্টোডাঙার ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়নি তা এই ঘটনা থেকেই স্পষ্ট।’’
দুর্ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিশেষজ্ঞেরা যা বলছেন, তাতে গাফিলতির প্রশ্নটাই উঠে আসছে। তাঁরা বলছেন, উড়ালপুলের কাজে পর্যাপ্ত সতর্কতা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবেই এত বড় বিপর্যয় ঘটল। গড়িয়াহাট, পার্ক স্ট্রিট আর নাগেরবাজার— এই তিনটি উড়ালপুল নির্মাণকারী সংস্থার চেয়ারম্যান কাজল সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘সেতু বা উড়ালপুল তৈরির ক্ষেত্রে নজরদারির বিষয়টিই সব থেকে গুরুত্বপর্ণ। আমরা তিনটি উড়ালপুল তৈরির ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত সতর্কতা নিয়েছিলাম। নজরদারি ছিল ষোলো আনা।’’ কাজলবাবু বলেন, ‘‘নাগেরবাজার উড়ালপুল তৈরির সময় পুলিশ যান-নিয়ন্ত্রণের পর্যাপ্ত সুযোগ পাচ্ছে না। অথচ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। এই উভয় সঙ্কটের মধ্যেও কাজ চালাতে হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা নজরদারি রেখে কোনও দুর্ঘটনা ছাড়াই কাজটা শেষ করেছি।’’ অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, নকশা এবং নির্মাণসামগ্রীর গুণগত মান নিয়েও। সেতুতে যে পিয়্যারক্যাব হুইল থাকে, কংক্রিটের ওজন নেওয়ার পক্ষে তা কতটা উপযুক্ত ছিল, সে ব্যাপারেও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
প্রথম থেকেই নিরাপত্তার উপর জোর দিলে এত বড় দুর্ঘটনা এড়ানো যেত বলে মনে করেন কেএমডিএ-র প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল দেবদাস ভট্টাচার্যও। প্রায় চার দশক কেএমডিএ-র ইঞ্জিনিয়ার থাকার সুবাদে বেশ কিছু উড়ালপুল তৈরির কাজ করেছেন। তিনি জানান, নির্মাণকাজ চলাকালীন উড়ালপুল ভেঙে পড়ার ঘটনা অতীতেও হয়েছে। বিদ্যাসাগর সেতু তৈরির সময় এ-পারে, মানে খিদিরপুরের দিকে প্রায় ৩০ মিটার দীর্ঘ একটা অংশ (‘ডেক’) ভেঙে পড়ে। ঢালাইয়ের গন্ডগোলের জন্য ও রকম হয়েছিল। ফাঁকা জায়গা ছিল বলে কেউ হতাহত হয়নি। ‘‘কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল হওয়ায় বিবেকানন্দ রোড প্রকল্পের কাজে আরও অনেক সতর্ক হওয়া উচিত ছিল,’’ বলেন দেবদাসবাবু।
উড়ালপুল তৈরির এই কাজে নজরদারির দায়িত্ব ছিল কেএমডিএ-র উপরে। সেখানে কোনও অনিয়ম বা গাফিলতির কথা মানতে চাননি ববি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এই উড়ালপুলের নকশা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত অভিজ্ঞ এক সংস্থার তৈরি। তদারকির দায়িত্বে ছিলেন কেএমডিএ-র অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার প্রিয়তোষ ভট্টাচার্য। কংক্রিটের মিশ্রণ, ‘কাস্টিং কিউব’— এ সব কাজ অভিজ্ঞরাই করেছেন। নিরপেক্ষ নজরদার হিসাবে কাজ করেছে ইন্ডিয়ান রেজিস্ট্রার ফর শিপিং (‘আই আর ক্লাস’)।’’
যদিও কেএমডিএ’র অন্দরেই অভিযোগ উঠেছে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী পোস্তায় জগদ্ধাত্রী পুজোর উদ্বোধনে গিয়ে ফেব্রুয়ারির মধ্যে সেতুর কাজ শেষ করতে বলার পরেই উঠেপড়ে লেগেছিলেন নির্মাণকারী সংস্থা ও সরকারি কর্তারা। দ্রুত কাজ করতে গিয়ে মান নিয়ে সতর্কতা শিকেয় উঠেছিল। কেএমডিএ’র এক অফিসার জানান, যে ধরনের সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়েছে তা ওই রকম উড়ালপুল নির্মাণের ক্ষেত্রে উচিত হয়নি। এই বিষয়টা কেএমডিএ’র কর্তাদের অনেকেই জানতেন। কেএমডিএ সূত্রের খবর, কাজ কেমন চলছে তা এ দিনই দেখতে যাওয়ার কথা ছিল তাদের ইঞ্জিনিয়ারদের। তার আগেই দুর্ঘটনা। নগরোন্নয়ন মন্ত্রী অবশ্য যুক্তি দেন, ‘‘সময়ে এবং দ্রুত কাজ শেষ করার কথা অনেক সময়েই বলা হয়। তার মানে এই নয় যে কাজের ক্ষেত্রে মান বজায় না রেখে তা করতে হবে। এ সব অহেতুক অভিযোগ।