আবার তোরা মানুষ হও
আবু বকর সিদ্দিক
মানব জীবনে সমাজ ও দেশে বসবাসরত একে অন্যের আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, ঘৃনা, চাওয়া-পাওয়ার মাধ্যমেই যে বন্ধন সেটি সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই চলে আসছে। সৃষ্টিগতভাবেই একজনের দুঃখে অন্যজন দুঃখিত, ব্যথিত হয়ে থাকেন। কারো ভালোবাসায় খুশি হোন। খারাপ কিছু ঘটলে ঘৃনা প্রকাশ করেন। কিছু ঘটনা এমন যে মানুষকে বাকরুদ্ধ করে ফেলে। শিশু রাজন হত্যা তেমনি একটি ঘটনা যা গোটা দেশের মানুষকে বাকরুদ্ধ করেছে। আলোচনা সমালোচনার ঝড় তুলেছে সর্বত্রই। এক ফোটা পানি খেতে পারলোনা শিশুটি! চোর নয় বারবার বলার পরও চোরের তকমা নিয়ে পরপারে চলে গেলো পাষন্ডদের রোলের আঘাতে। মানুষ কেন এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে? এসবের সুষ্টু বিচার কেন হচ্ছেনা।কিভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে মূল আসামীরা। এমন প্রশ্ন অনেকেরই। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র কি এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারবে? অসংখ্য জীবনের ক্ষয় হচ্ছে। বিনাশ হচ্ছে। পিঠিয়ে, গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে। এসবের কি উত্তর নেই। কারো কাছে জবাবদিহিতা নেই। তাহলে আমরা কোন দেশে বাস করছি। কে আমাদের অভিভাবক। কোথায় আমাদের আশ্রয়ের ঠিকানা। অতিসম্প্রতি সিলেটে কয়েকটি ঘটনা শুধু সিলেটবাসী নয় গোটা দেশের মানুষকে ব্যথিত, মর্মাহত করেছে। ব্যথিত হয়েছেন লক্ষ কোটি প্রবাসীরাও। সিলেটের মান সম্মান ও স্বকীয়তায় টান পড়েছে। সচেতন বিবেককে নাড়া দিয়েছে দারুনভাবে। সমাজে ঘৃনার জন্ম দিয়েছে। এমন ঘটনা আর কতো? আর কতোটা পৈশাচিক ও বর্বরতম ঘটনার জন্ম হলে আমরা শুদ্ধতার পথ চলতে জানবো, শিখবো।
চলতি বছরের শুরুর দিকে অর্থের লোভে পুলিশের সোর্স ও ওলামালীগ নেতা নেতা কর্তৃক হত্যা করা হয়েছিলো শিশু সাঈদকে। এখন সেই আরেক হতবাগা শিশু রাজনকে হত্যা করা হলো। হতভাগা না হলে কেন তাকে এভাবে জীবন দিতে হবে। একটি ঘটনার বেদনা হৃদয় থেকে মুছতে না মুছতেই আরো একটি হৃদয় বিদারক ঘটনা তোলপাড় করলো। অনেক ঘটনাইতো প্রতিদিন ঘটছে। কিন্তু সেই সব ঘটনা শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করে। এভাবে অজ¯্র মানুষের হৃদয়ে ক্ষোভ ও ঘৃনার ঝড় তুলতে পারেনি। যা সব চেয়ে নিকৃষ্ট নজির স্থাপন করেছে শিশু সামিউল আলম রাজনকে হত্যা করে। এযাবত কালের মধ্যে সব চেয়ে মর্মান্তিক, পৈশাচিক এবং জঘন্যতম ঘটনা বলা যায়। একজনকে অর্থের লোভে আর অন্যজনকে চুরির সন্দেহে নাটকীয়ভাবে আইন, আদালত, বিবেকের দাবীকে তোয়াক্কা করে হত্যা করা হয়েছে। যা লক্ষ কোটি মানুষকে আঘাত করেছে মর্মন্তুদভাবে। প্রযুক্তির কল্যানে দুটি ঘটনার বিবরণ, ভিডিও চিত্র ছড়িয়ে পড়ে ভার্চুয়াল জগতে। পৃথিবীর মানুষ দেখলো আর ধিক্কার জানালো ঘাতকদের। হয়তো অনেকের কাছে মনে হতে পারে এই এলাকা বোধ হয় জঘন্য অপরাধীদের অভয়াশ্রম। কিন্তু তা কতটুকু সত্য ? সংবাদপত্র, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলো ধারাবাহিকভাবে সংবাদ করতে প্রকাশ করায় তোলপাড় সৃষ্টি করে দেশজুড়ে। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষজনও ধিক্কার জানালেন এমন জঘন্য ঘটনার। সাঈদ হত্যার পর শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যাকান্ড ঠিক একইভাবে জাতির জাগ্রত বিবেককে দংশন করেছে। নিজ এলাকার লোকজন, স্বজন, গোটা সিলেটবাসী এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবি থেকে নিয়ে বিভিন্ন শ্রেনী পেশার লোকজন এমন বর্বরতম হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা, ক্ষোভ ও ঘৃনা প্রকাশ করেছেন। অনেকেই নীরবে চোখের পানি ফেলছেন আর শাস্তি দাবী করছেন। যারা রাজন হত্যাকান্ডের ভিডিও দেখেছেন তারা বেদনায় নীল হয়েছেন। চুরির সন্দেহে অবিশ্বাস্যভাবে এমন হত্যাকান্ড কেউ ঘটাতে পারে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই হতোনা। ফেসবুকে লক্ষ-কোটি জনতা ভিডিও দেখে চোখের পানি আটকে রাখতে পারেননি বলে মন্তব্য করতে দেখা গেছে। আমাদের সমাজে এমন ঘটনা কেউ ঘটবে হয়তো কারো নখদর্পনে ছিলো না। নাৎসি বাহিনী আর আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগেই এমন ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক ছিলো। মানুষ যুগ যুগ ধরে এমন ঘটনার কথা শোনে আসছে। সিলেটের সংবাদপত্র এবং ঘাতকেদের রেকর্ড করা নির্যাতনের ভিডিও চিত্রে দেখা যায় শিশুটি তাদের নির্যাতন থেকে বাচতে বারবার আকুতি জানাচ্ছিলো। নির্যাতনে সে মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার পর ঘর্মাক্ত হয়ে যায়। তখন পানির তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পানি চাইলে নরপিশাচরা হাসতে হাসতে তাকে শরীর থেকে বের হওয়া ঘাম খেতে বলে। তার পা ও শরীরের বিভিন্ন হাড্ডি ভেঙ্গে দিয়ে হাত এবং পায়ের রশি খুলে দিয়ে তাকে হাটতে বলে। যখন সে হাটতে না পেরে পড়ে যা”্ছেিলা তখন ঘাতকরা উল্লাসে মেথে উঠছিলো। কতো নি¤œ মন মানসিকতার মানুষ হলে এমনটা করতে পারে মানুষ। শিশু রাজনকে গ্যারেজের একটি পিলারের সাথে বেধে নির্যাতন করতে করতে এক পর্যায়ে মৃত্যু হলে পর দিন ভোরে ঘাতকরা কুমারগাও এলাকায় লাশ ফেলতে গেলে লোকজন দেখে ফেলেন।পরে তারা পাকড়াও করে ঘাতকদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন বলে মিডিয়া সূত্রে জানা যায়। যারা এমন মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম দিতে পারে তাদের কাছে মানবতা, দয়া-দাক্ষিন্যের আশা করাটা বোকামি ছাড়া আর কি বলা যায়। ঘাতকদের কাছে একটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে যে, তোদের কি ছেলে সন্তান নেই। ভাই, ভাতিজা, ভাগ্নে বা আত্মীয় স্বজন নেই। যদি থাকে তাহলে অন্তত তাদের মুখের দিকে থাকিয়ে একবারও কি মনে পড়েনি আমি কতোটা অমানবিক কাজ করছি? কতো নিকৃষ্ট কাজ করছি? আইন আদালতের ভয় বাদই দিলাম। কারন সন্ত্রাস, বিবেকহীন অমানুষদের কাছে আইন, আদালত বলতে ডাল ভাত ব্যাপার মাত্র। জানা গেছে এই হত্যাকান্ডের সাথে চার থেকে ছয়জন জড়িত ছিলো। এতগুলো নরপিশাচদের মধ্য থেকে একজনেরও মধ্যে কী দয়ার সামান্যতম উদ্রেগ হয়নি যে, না ছেলেটাকে আর নির্যাতন করা ঠিক হবেনা। এবার ছেড়ে দেয়া যাক! অবাক করার বিষয় যে কয়েকটা প্রাপ্ত বয়ষ্ক লোক ঘন্টাখানেক উল্লাস করতে করতে একটা ১৩ বছরের শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করলো। পরে লাশ গুম করার মতো কী নিকৃষ্ট পায়তারাও করলো। যাই হোক এই জঘন্যতম ঘটনার বিচার কতটুকু পাবে নিহতের পরিবার। সেই বিষয়ে অনেকেরই সন্দেহ। আমি বিশ্বাস করি সকল সন্দেহকে পেছনে ফেলে পুলিশ প্রশাসন ও আদালত নির্যাতনকারীদের উপযুক্ত বিচার করবেন। আইনের শাসনই সব চেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। আগামী দিনে এমন পৈশাচিকতার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে সঠিক বিচার হওয়া সময়ের দাবী। মিডিয়া ও সমাজ সচেতন সকল শ্রেনী পেশার লোকজনকে এই ব্যাপারে বলিষ্ট ভূমিকা পালন করা জরুরী হয়ে পড়েছে। না হয় শিশু সাঈদ,সামিউল আলম রাজনের মতো আরো শিশুদের ভাগ্যে যে এমন ঘটনার পূনরাবৃত্তি হবেনা তা কেউ বলতে পারবেন না। সমাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বলেন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেন এমন ঘটনা এই সমাজে মেনে নেয়ার নয়। কেউ সহ্য করতে পারেন না। এক “আমারে ফোটা পানি দেউ রেবা”এই আকুতি আজ আমাদের ঋনী করে গেলো শিশু রাজন। কিছুই করতে পারিনি বলে দু:খিত। কলঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে একটাই চাওয়া অসভ্যতার বিনাশ হোক। শাস্তি হোক ঘাতকদের। আর কবির ভাষায় সুরের সাথে বলতে চাই আবার তোরা মানুষ হ।।।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক