কমলগঞ্জের চার মেধাবী শিক্ষার্থীর উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নের সমাধি
বিশ্বজিৎ রায়, কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি:
শুধুমাত্র টাকার অভাবে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নকে কবর দিতে হয়েছে কমলগঞ্জের চার মেধাবী শিক্ষার্থীকে। সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতায় তারা তাদের পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কথা তুলে ধরে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন সমাজের বিত্তবানদের কাছে।
লায়লা আক্তার
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী ইসলামপুর ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামের দিনমজজুর দম্পতির মেয়ে লায়লা আক্তার এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সীমাহীন বাঁধা পেরিয়ে ভান্ডারীগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সিলেট শিক্ষাবোর্ডের অধীনে লায়লা গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে। শুধু কি টাকার অভাবে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে লায়লার?
লায়লার মা ইয়ারুন বেগম জানান, তিনি ও তার স্বামী ইছমাইল মিয়া দিনমজুরী করে কোন রকমে পরিবারের ৮ জন লোকের জীবিকা নির্বাহ করছেন। এমনও দিন অনেক গেছে যে, অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে যে খাবার জুটেছে তা নিজে না খেয়ে ছেলে মেয়েদের খাইয়েছে। ভাই-বোনের মধ্যে লায়লা সবার বড়।
লায়লার দাদী সত্তরোর্ধ্ব জলিকা বেগম জানান, নিজেদের ভিটে মাটি না থাকায় চাচার বাড়িতে একটি চালা তুলে কোন রকমে রাতটুকু পার করেন তারা। এত কষ্টের পরেও লায়লার ১ বোন ও ৩ ভাইয়ের সবাই লেখাপড়া করছে। বিদ্যুৎ না থাকার কারনে হারিকেন জ্বেলে অথবা চাচার ঘরে বিদ্যুতের আলোয় খুব কষ্ট করে পড়ালেখা করতে হয়েছে লায়লাকে।
লায়লা জানায়, টাকার অভাবে কোন সময় প্রাইভেট পড়তে পারিনী। একটি স্কুল ড্রেসেই বছর তিনেক পার হয়েছে। এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপ করতে গিয়ে ধারদেনা ও নিজের হাঁসমুরগী বিক্রি করতে হয়েছে। ভাল কোন কলেজে ভর্তি হয়ে শিক্ষক হওয়ার তার খুব ইচ্ছে। কিন্তু বাধ বেধেছে অর্থ।
দু’চোখের জল ফেলে লায়লার মা আক্ষেপ করে বলেন, সন্তানদের লেখাপড়া ক্ষতি হবে জেনে নারী হয়ে মজুরীতে পরের গরু মাঠে চরাতে গিয়েছি। কিন্তু এখন আর পারছি না। বড় কাসে কেমন করে পড়াবো মেয়েকে ? এত টাকা কোথায় পাবো ? যদি সরকার বা সমাজের বিত্তবান কেউ আমাদের কিছু সহযোগীতা করতো তাহলে কলেজে ভর্তি করে মেয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারতাম। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে চারিদিকে অন্ধকার দেখছেন লায়লার মা-বাবা। মা-বাবা দুজন দিনমজুরী করে ৮ সদস্যের পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করতে যেখানে হিমশিম খাচ্ছেন। সেখানে জিপিএ-৫ পেয়ে মেয়েকে কিভাবে ভাল কলেজে ভর্তি করবেন এ চিন্তায় দিশেহারা।
নিহার দেবনাথ
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ্উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের চিতলীয়া জনকল্যান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ অর্জনকারী নিহার দেবনাথ উচ্চ শিক্ষা অর্জনের স্বপ্নকে মনের গহীনে কবর দিয়েছে। উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পথে বাঁধা হয়ে দেখা দিয়েছে দারিদ্রতা। আলীনগর ইউনিয়নের যোগিবিল গ্রামের মৃত নৃপেন্দ্র দেবনাথ এর ছেলে নিহার দেবনাথের রয়েছে আরও এক ভাই ও ৩ বোন। দুই বোন সঞ্জয়িতা রানী দেবী ও সোমা রানী দেবী এম.এ পড়ছে সিলেট এমসি কলেজে। নিহার তার বড় ভাই জিতেন্দ্র দেবনাথের সাথে নিয়মিত পরের ক্ষেতে কাজ করেছে। সেই কাজ থেকে অর্জিত টাকা দিয়েই চলেছে নিহারের লেখাপড়ার খরচ। নিহার জানায়, বাবার অবর্তমানে বড় ভাই, বোন ও শাহীন স্যারের সহযোগিতায় সে ভালো ফলাফল অর্জন করেছে। সে ভবিষ্যতে ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চায়। কিন্তু দরিদ্র হবার কারনে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিএএফ শাহীন কলেজ অথবা শ্রীমঙ্গল বার্ডস স্কুলে ভর্তি হবার স্বপ্নকে মনের গহীনে কবর দিয়েছে নিহার।
শামীমা সুলতানা
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নের মণিপুরী অধ্যুষিত একটি গ্রাম কান্দিগাঁও। এ গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের মেধাবী কন্যা শামীমা সুলতানা। বাবা পানদোকানী মোহাম্মদ উদ্দীন ও মা ফায়েকা বেগমের অন্য ৪ সন্তাানের সকলেই স্কুল কলেজে লেখাপড়া করছে। অনেক কষ্টে কোনভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে যে পরিবার। সে পরিবারের ৪ সদস্যের লেখাপড়া করানো দুঃসাধ্যই বৈকি। তবু লেখাড়া করে মানুষ হবার ব্রত নিয়ে শত বাধা ডিঙিয়ে শামীমারা পড়ছে। এবছর এসএসসি পরীক্ষায় তেতইগাঁও রশিদউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে সে জিপিএ ৫ লাভ করেছে। সে পিএসসি ও জেএসসিতেও বৃত্তি লাভ করেছে। আর বৃত্তির টাকায় এতদুর পর্যন্ত আসতে পেরেছে। বৃত্তির টাকা না পেলে হয়তো এ পর্যন্ত আসা সম্ভব হতোনা বলে জানায় শামীমা। কিন্তু অদম্য মেধাবীদের কি দমিয়ে রাখা যায়? নিজেদের ভাঙা ঘরে বিদ্যুৎ না থাকায় কেরোসিন কুপির মিটিমিটি আলোয় হাড্ডিসার পরিশ্রম করে পড়া তৈরি করেছে। পানের দোকানে আর কতইবা আয়, নুন আনতে পান্তা ফুরায় সংসারে অনেকদিন না খেয়েই ঘুমাতে হয়। ক্ষুধার যন্ত্রণা আর দারিদ্র্যের কঠোরতায় তবু তার শিক্ষা অর্জনের ¯পৃহাকে একটুও দমিয়ে রাখতে পারেনি। তাই খেয়ে না খেয়ে প্রতিদিন নিয়মিত কাস করে এসএসসিতে এ ফলাফল লাভ করেছে। অনেক আশায় বুক বেঁধে স্বপ্ন দেখেছিলো শামীমা। চিকিৎসক হয়ে দরিদ্ররোগীদের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেবে।
আঁধার ঘরে চাঁদের আলো মণিপুরী মুসলিম (পাঙান) মেয়ে শামীমার সে স্বপ্ন বোধ হয় আর ভেঙে যাবে অচিরেই। মা-বাবা চাচ্ছেন ভাল কোন বর দেখে মেয়ের বিয়ে দিতে। কিন্তু শামীমা চায় উচ্চশিক্ষা অর্জন করে তার স্বপ্ন পূরণ করতে। শুধু অর্থের অভাবে দারিদ্রতার করাল গ্রাসে মেধাবী এ সন্তানের লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছাকে পিষে ফেলে এ বয়সেই বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তার মা-বাবা। বাবা মোহাম্মদ উদ্দীন কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, অনেক কষ্টে সন্তানদের লেখাপড়া করিয়েছি। আর পারছি না। উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। এত টাকা আমি কোথায় পাব? পরিবারে এখন আনন্দের পরিবর্তে বিরাজ করছে শোকাবহ পরিবেশ। উচ্চ শিক্ষার প্রত্যাশা তার ও তার পরিবারের কাছে চরম বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়।
শামীমা সুলতানা ভবিষ্যতে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ ও সংসারের জন্য কিছুটা অবদান রাখতে চান, চান ডুবন্তপ্রায় সংসারের হাল ধরতে। এ অবস্থায় এসএসসি পরীক্ষায় এমন আশ্চর্য্য ফলাফলের পরও তার পরিবার চরম দূর্ভাবনায়। সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে পুরণ হতে পারে শামীমার উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নসাধ। নতুবা এখানেই থেমে যাবে অদম্য মেধাবী শামীমার শিক্ষা জীবন।
সিতারা বেগম
তাঁতে কাপড় বুনে লেখাপড়ার খরছ চালিয়েছে আদিবাসী মেয়ে সিতারা বেগম। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার তিলকপুর গ্রামের মণিপুরী মুসলিম (পাঙান)সম্প্রদায়ভুক্ত হতদরিদ্র তাজুল ইসলাম ও নাছিরা বেগমের চার সšতানের মধ্যে সবার ছোট সিতারা এ বছর এস,এস,সি পরীক্ষায় দয়াময় সিংহ উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ -৫ পেয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিক বাবা দ’ুবেলা খেয়ে না খেয়ে অনেক কষ্টে তার অন্য সšতানদের লেখাপড়া চালিয়ে যখন হাঁিপয়ে উঠছেন তখন মেয়ের এরকম ভালো ফলাফলের খবর তাকে অকৃত্রিম আনন্দ যুগিয়েছে। এ খবরে এলাকায় আনন্দের ঢল নামলেও সিতারাদের পরিবারে মেধাবী মেয়ের ভবিষ্যত আর স্বপ্ন পূরন নিয়ে আশংকার বাতাস বইছে। প্রচন্ড অভাবের কারণে বড়ভাইয়ের মতো সিতারারও উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্বপ্ন ধুলিস্মাৎ এখন।
নুন আনতে পাšতা পুরায় সংসারে তাঁতে কাজ করার পাশাপাশি অদম্য মনোবল আর কঠোর অধ্যাবসায়ে পিএসসি ও জেএসসিতেও বৃত্তি লাভ করেছিলো সিতারা। তার স্বপ্ন ছিলো লেখাপড়া করে সে চিকিৎসক হবে। দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করবে।কিন্তু তার সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।মেয়ের স্বপ্নপূরণে কলেজে পড়ার সাধ মেটাবেন কিভাবে সে চিšতায় অস্থির মা নাছিরা বেগম চোখের পানি ফেলে এ প্রতিবেদককে জানান, হতদরিদ্র সংসারের কষ্টের কাহিনী। একটুকরো ভিটে আর ঘাম ঝরিয়ে পরিশ্রম করার শক্তি ছাড়া যাদের আর কিছুই নেই,তাদের আছে শুধু স্বপ্ন ,মানুষের মতো মানুষ হবার স্বপ্ন।
সিতারা কান্নাজড়িত কন্ঠে তার এ পর্যšত এগিয়ে আসার গল্প শোনায়। বৃত্তির টাকা না পেলে হয়তো এসএস,সিটাও পড়া হতো না তার।সে লেখাপড়া করে ডাক্তার হয়ে আর্তমানবতার সেবা করতে চায়।কিন্তু চরম দারিদ্রতা তার সে স্বপ্ন পূরণে কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেখাপড়ার ফাঁকে অন্যের বাড়ীতে তাঁতে কাপড় বুনে যে নিজের লেখাপড়া আর সংসারের খরচ যুগিয়েছিলো সে সিতারার বাবা চান মেয়েকে কোন ভাল ঘরে পাত্রস্থ করতে অথবা যে কোন এন,জিওতে ছোটখাটো কোন চাকুরীর ব্যবস্থা করতে। অথচ ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো সিতারা আশায় বুক বেঁধে কতো কষ্ট করে প্রতিদিন ৯/১০ঘন্টা করে লেখাপড়া করে এ ফলাফল অর্জন করেছে। সারা গ্রামে বিদ্যুৎ থাকলেও নিজেদের বাড়ী অর্থ্যাৎ জরাজীর্ণ ছোট ঘরে বিদ্যুৎ নেই,তাই রাতে কেরোসিনের কুপির টিমটিমে আলোয় অথবা আশেপাশের বাড়ীর বিদ্যুতের আলোয় লেখাপড়া করেছে সে জীবনের লক্ষ্য বা¯তবায়নে। আজ শুধু চরম দারিদ্র্যের কঠোর কশাঘাতে ভেঙে যাচ্ছে স্বপ্নবাণ সিতারার মানুষ হবার স্বপ্ন।
বাবা তাজুল ইসলামের কথা, সংসারের ভরণপোষন চালাতে হিমশিম খাচ্ছি আর পারছি না। কিন্তু মা তার ছোট সন্তান লেখাপড়া করুক,মানুষ হয়ে মানুষের সেবা করুক।একমাত্র ভাই জহুর হোসেন যে এইচ.এস.সি. পাশ কওে এখন চাকুরীর খোঁজ করছে ,সেও চায় তার বোন লেখাপড়া করে তার স্বপ্ন পূরণ করুক।। দুবেলা খেয়ে না খেয়ে তাঁতে কাজ করে প্রতিদিন ৯/১০ঘন্টা করে লেখাপড়া করে এ ফলাফল অর্জন করে সিতারা । ঘরের ছাগল বিক্রি করে ও কাপড় বুনার মজুরী মিলিয়ে ফরম ফিল-আপের টাকা যোগাড় করেছিলো সে। হতদরিদ্র সংখ্যালঘু পরিবারের মেধাবী সšতান সিতারারা প্রতিমুহুর্তে দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকলেও মা বাবা আর শুভানুধ্যায়ীদের প্রেরণায় এতোদুর লেখাপড়া চালাতে পিছপা হয়নি। কিন্তু অভাগা বাবা মায়ের সাধ আছে,সাধ্য নেই অবস্থায় কতোদুরই যেতে পারবে তারা। মেধার আলোয় আলোকিত হবে হয়তো অল্পশিক্ষিত কোন বরের রান্নাঘর।অথবা কোন এন,জি,ওর প্রি-প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষার্থীদের স্বরবর্ণ,নামতা শিখাতে বা ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে কি¯িতর হিসাব দিতেই ব্য¯ত থাকবে।ভূলে যাবে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন।
নুন আনতে পাšতা ফুরায় সংসারের ভাত-কাপড়ের চাহিদা মিটাতে হিমশিম অবস্থা যাদের,কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানকে পড়ানো তাদের জন্য ভাঙা ঘরে ছেড়া কাঁথায় আকাশছোঁয়া স্বপ্ন বৈকি।কিন্তু অপ্রতিরোধ্য দারিদ্র্যের সুকঠিন বাধা ডিঙিয়ে এতটুকো পথ যারা পাড়ি দিতে পেরেছে,শাণিত মেধার মঙ্গল আলোয় স্বপ্ন পূরণের দৃঢ় প্রত্যয়ে তারা এগিয়ে যাবেই।