ওসমানীনগরে সংঘর্ষের নেপথ্যে স্ট্যান্ড দখল, টাকার খেলা
নুরুল হক শিপু, গোয়ালাবাজার থেকে ফিরেঃ সিলেটের গোয়ালাবাজারে আলোচিত সংঘর্ষের পেছনে মহাসড়কে জায়গা দখল করে স্ট্যান্ড করা আর নেপথ্যে প্রায় অর্ধকোটি টাকার খেলাও বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে এ বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। প্রায় এক মাস পূর্বে স্ট্যান্ড করা ও টাকা উত্তোলনের বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় এমপির কাছে বিচার প্রার্থীও হয়েছিল এক পক্ষ। সুরাহা না হওয়ায় এর জের ধরে গত বুধবার ঘটে সংঘর্ষ। সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে অনাকাংখিতভাবে ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের মৃত্যু এবং পরবর্তী অবস্থায় ঘটনার নেপথ্যের কারণ নিয়ে চলছে তোলপাড়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহাসড়কের এক পাশ দখল করে সড়কের উপরই সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ড ছিলো। সিলেট জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি নং ৭০৭) এর অনুমোদন নিয়ে স্থানীয় সিএনজি শ্রমিক নেতারা পরিচালনা করতেন। তাদের তালিকায় রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত ৫০০ সিএনজি অটোরিকশা থাকলেও রেজিষ্ট্রেশন ছাড়া ছিলো প্রায় আরো ৩০০ অটোরিকশা। প্রতিদিন অটোরিকশা শ্রমিকদের কল্যাণের নামে প্রত্যেক চালকদের কাছ থেকে আদায় করা হতো ১০ টাকা করে। আর যে আটোরিকশার রেজিষ্টেশন নেই তাদের কাছ থেকে আদায় করা হতো ২০ টাকা। রেজিষ্টেশন করা ৫০০ অটোরিকশা থেকে প্রতিদিন জমা হতো ৫ হাজার টাকা। আর রেজিষ্ট্রেশন ছাড়া ৩০০ অটোরিকশা থেকে ২০ টাকা করে প্রতিদিন আসতো ৬ হাজার টাকা। প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা থেকে গোয়ালাবাজারে আসা বাইরের সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিকরা গাড়িতে যাত্রী তুলতে হলে ওই স্ট্যান্ডের দায়িত্বপ্রাপ্তদের দিতে হতো ২০ থেকে ৩০ টাকা। এভাবে গত ২০১৩ সালে শুরু থেকে গোয়ালাবাজারের সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা সব মিলিয়ে চাঁদা আদায় করেন প্রায় ৫৬ লাখ টাকা। সাধারণ শ্রমিকদের ওই টাকার হিসেব দিতে গিয়ে স্ট্যান্ডের সভাপতি জিলু মিয়া, সাধারণ সম্পাদক কাউসার আহমদ, সাংগঠনিক সম্পাদক দুদু মিয়া বিভিন্নখাতে ৫৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান। আর ব্যাংকে জমা রয়েছে ২ লাখ টাকা। তখন শ্রমিকদের একাংশের নেতা তাজ উদ্দিন, মাহমদ আলী, পিয়ার আলী, হাবিব, সুমন, জুয়েল, রজতসহ কয়েকজন শ্রমিক ব্যাংকে খবর নিয়ে জানতে পারেন ব্যাংকে কোনো টাকা নেই। তারা তখন সিদ্ধান্ত নেন জিলু মিয়া, কাউসার আহমদ, দুদু মিয়াদের সাথে থাকবেন না। তারা নতুন শাখার অনুমোদন আনবেন। তখন শতাধিক শ্রমিক একমত হয়ে দক্ষিন গোয়ালা বাজারে সিএনজি অটোরিকশার নতুন শাখা নিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। এক পর্যায় সিলেট জেলা শ্রমিক ইউনিয়ন (৭০৭) এর নেতারা দক্ষিণ গোয়ালাবাজারে নতুন স্টেন্ড করার অনুমোদন না দেয়ায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে শ্রমিকরা হয়ে পড়েন বিভক্ত। তাদের মাঝে গত ৬ মাস থেকে বিরাজ করে উত্তেজনা। এরই ধারাবাহিকতায় গত বুধবার সকাল ১১টার দিকে দক্ষিণ গোয়ালাবাজারে সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করেন। এসময় গোয়ালাবাজার শাখার বর্তমান শ্রমিক ইউনিয়নের একদল শ্রমিক অবরোধে বাধাঁ দিলে উভয় গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে শুরু হয় সংঘর্ষ। খবর পেয়ে থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে উভয় পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করে দেন। পরে মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। পরবর্তীতে দুপুর ১ টার দিকে নতুন শাখা স্থাপনকারী অটোরিকশা শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে আবারও মহাসড়ক অবরোধ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। সংঘর্ষে গোয়ালাবাজার উত্তর অংশের শ্রমিকদের সাথে ব্রাহ্মণ গ্রামের লোক এবং দক্ষিণ অংশের শ্রমিকদের সাথে করনসী গ্রামের কিছু লোকজন অংশ নেন। ১টা থেকে প্রায় দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চলে এ সংঘর্ষ। এ সময় উভয় পক্ষ দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে একে ওপরের উপর হামলা চালায়। শুরু হয় গুলাগুলি, আর ইটপাটকেল নিক্ষেপ। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৮০ রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষে ওসমানীনগর থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান প্রাণ হারান। পুলিশ সদস্যসহ আহত হন প্রায় অর্ধশতাধিক শ্রমিক। ওই দিনরাতেই পুলিশ বাদি হয়ে প্রায় ১০০ জনের নামোল্লেখ করে ও অজ্ঞাত ৭০০ থেকে ৮০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে।
অভিযোগ উঠেছে, সংঘর্ষে গোয়ালাবাজার উত্তর প্রান্তের শ্রমিকদের নেতৃত্ব ও মদদদাতা হলেন, জিলু মিয়া, আনোয়ার উদ্দিন, আরিফ উল্লা, কাউসার আহমদ, দুদু মিয়া, কাদির, বাবুল, হামিদসহ ব্রাহ্মণ গ্রামের লোক এবং দক্ষিণ অংশের শ্রমিকদের নেতৃত্ব ও মদদদাতা হলেন, আতাউর রহমান মানিক, মাহমদ আলী, তাজ উদ্দিন, হাবিব, জুয়েল, সুমনসহ করনসী ও জায়ফরপুর গ্রামের লোকজন।
ওসমানীনগর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) অকিল উদ্দিন বলেন, সংঘর্ষেরমূল কারণ হচ্ছে একটা পক্ষ নতুন স্টেন্ডের অনুমোদন চায়। কিন্তু পায়নি। আর এ নিয়েই দু’পক্ষের মাঝে সংঘর্ষ বাদে। স্টেন্ড আগে একটা ছিলো এখন দু’ভাগে বিভক্ত হওয়ার নেপথ্যে ৫৬ লাখ টাকার কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এ বিষয়টি আমার জানা নেই। আর এটি আমাদের তদন্তের বিষয় না। সংঘর্ষে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অপর আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, যে দুই পক্ষ সংঘর্ষ করেছে তাদের উভয় পক্ষকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম জানান, মহাসড়কে স্ট্যান্ড থাকার কথা না। আমাদের মাসিক সমন্বয় সভায় আলোচনা করা হয় যাতে মহাসড়কের উপর কোনো স্ট্যান্ড বসানো না হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সমস্যা তো সব দিকে। এদের সরিয়ে দিলে কোনো না কোনো স্থানে তো এদের জায়গা দিতে হবে। উচিত হলো তাদের স্ট্যন্ড করে দেয়া সড়কের পাশে।
সিলেট-২ আসনের সংসদ সদস্য ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী জানান, শ্রমিকদের সংঘর্ষের কারণে একজন পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু হয়েছে। যা কখনই কাম্য নয়। তিনি ওই ঘটনায় যারা জড়িত তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় এতে শাস্তির আহবান জানান।
৫৬ লাখ টাকা নিয়ে শ্রমিকদের মাঝে বিভক্তির এক পর্যায়ে সংঘর্ষ হয়-এ ব্যাপারে এমপি বলেন, প্রায় এক মাস পূর্বে শ্রমিকদের এক পক্ষ আমার কাছে বিচার প্রার্থী হন যে স্ট্যান্ডের প্রায় ৫৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। তারা আর এক স্ট্যান্ডে থাকবেন না। তাদেরকে বিষয়টি স্থানীয়ভাবে উভয় পক্ষ বসে সমাধান করতে বলেছিলাম।