‘তিন মাসে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ৭৩২টি ঘটনা’
ডেস্ক রিপোর্টঃ বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদ। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালের প্রথম তিন মাসেই প্রায় তিনগুণ সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। গত তিন মাসে ৭৩২টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে নিহত, আহত, অপহরণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত, গণধর্ষণ, জমিজমা, ঘরবাড়ি, মন্দির, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছেদের ঘটনা রয়েছে। গতকাল সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত এ তথ্য তুলে ধরেন। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ২০১৫ সালের বাংলাদেশের সংখ্যালঘু মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কিত যে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছিলাম তাতে ২৬১টি আলাদা ঘটনা সারা দেশে সংঘটিত হয়েছিল। বেশির ভাগ একক ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার সংখ্যা কমপক্ষে ১৫৬২টি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে যে মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল এ মুহূর্তে তা আরও ভয়াবহ পর্যায়ে রয়েছে। রানা দাশগুপ্ত বলেন, ২০১৬ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত প্রথম তিন মাসে সংখ্যালঘুদের ওপর কমপক্ষে ৭৩২টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, যা পূর্ববর্তী বছরের ঘটনার প্রায় তিনগুণ। এসবের বেশির ভাগ একক ঘটনায় একাধিক ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার সংখ্যা কমপক্ষে ৯৫৬৬ যা পূর্ববর্তী বছরের ছয়গুণেরও বেশি। এ সময়ে নিহত ১০ জন, আহত ৩৬৬ জন, অপহরণের শিকার হয়েছেন ১০ জন। তাদের মধ্যে জোরপূর্বক ধর্মান্তরের অভিযোগ রয়েছে ২টি। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮ জন। জমিজমা, ঘরবাড়ি, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, দখল ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ৬৫৫টি। ২২টি পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। শুধু এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৮২৫০। তিনি বলেন, এসব ঘটনায় অপরাধীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা স্থানীয় প্রশাসনকে প্রভাবিত করে ঘটনার পরবর্তী কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সেই সব স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এমনকি মামলা চলাকালীন অবস্থায় অথবা আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সম্পত্তি দখলের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরে রানা দাশগুপ্ত বলেন, গত তিন মাসে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘুদের বসতবাড়ি, জমিজমা দখলের ঘটনা ঘটেছে ১৭টি। একই সময়ে কমপক্ষে ২২টি পরিবারকে দেশত্যাগের হুমকি দেয়া হয়েছে। শুধু পিরোজপুরের একটি গ্রামেই ২০টি সংখ্যালঘু পরিবারকে দেশ ছাড়ার হুমকি দেয়া হয়। ৩০শে জানুয়ারি ২০১৬ পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার শাঁখারিকাঠী গ্রামের ২০টি সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারকে তাদের পৈত্রিক ভিটেমাটি ছেড়ে ভারত চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা। শুধু হুমকি নয়, ইতিমধ্যে ওই সকল হিন্দু পরিবারের বাড়ির পাশের খালি জায়গায় কয়েকটি মুসলিম পরিবারকে টং-ঘর তুলে দিয়ে সংখ্যালঘুদের প্রায় ৭ একর জমি দখল করেছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় এই নেতা। এ ছাড়া ঝালকাঠিতে এক কৃষক পরিবারকে মারধর করে ভারত চলে যাওয়ার হুমকি দেয়া হয়। অন্য একটি হিন্দু পরিবারকে দেশত্যাগের হুমকি, বসতবাড়ি দখলের চেষ্টা এবং এই ঘটনায় থানায় মামলা না নেয়ার অভিযোগ উঠেছে নীলফামারীতে। ১৭ই মার্চ নীলফামারী জেলার সদর থানার প্রগতিপাড়া গ্রামে রতিশ চন্দ্র রায় নিজের বাড়ির সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করতে দেয়নি দখলদার চক্র। জানুয়ারি মাসে আদালতের নির্দেশ অমান্য করে নারায়ণগঞ্জ শহরের পালপাড়ায় এক হিন্দু বিধবার প্রায় কোটি টাকা মূল্যের জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে। ওদিকে একই সময় ঠাকুরগাঁওয়ে একজন হিন্দু সংখ্যালঘুর জমি অবৈধভাবে দখল করে সেখানে ঘর তোলে এক ভূমিগ্রাসী। ৭ই জানুয়ারি কক্সবাজার সদর উপজেলার জালালাবাদ জলদাসপাড়ায় আওয়ামী লীগ নেতার নেতৃত্বে এক হিন্দু পরিবারের ওপর হামলা ও তাদের বসতভিটা দখলের ঘটনা ঘটে। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলায় এক সংখ্যালঘু পরিবারের জমি দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে এ মাসে। ১৮ই জানুয়ারি ফেনীর সোনাগাজি উপজেলায় চরদরবেশ ইউনিয়নের সেনেরখিল গ্রামের পাল বাড়ি থেকে লক্ষাধিক টাকার গাছ কেটে নিয়ে গেছে যুবলীগ কর্মীরা। জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও জমিদখলের তৎপরতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৩রা ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সূত্রাপুর এলাকায় সংখ্যালঘু একটি পরিবারের সম্পত্তি দখল করতে তাদের বসত-বাড়িতে হামলা ও লুটপাট চালিয়েছে প্রভাবশালী গোষ্ঠী। গত ৭ই ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে হিন্দু পরিবারের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে হামলা করে জমি দখলের চেষ্টা করেছে একদল সন্ত্রাসী। ১৮ই ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁও শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকার জগদীশ চন্দ্রের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করে সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতার লোকজন। গত ১৯শে মার্চ নওগাঁর মান্দা উপজেলার চকরাজাপুর গ্রামে অসহায় এক হিন্দু বিধবার বসতবাড়ি জবরদখল করে নেয় সংঘবদ্ধ ভূমিদস্যুরা। গত ২১শে মার্চ পিরোজপুর শহরের বাইপাস সড়কস্থ সার্জিকেয়ার ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনিস্টক সেন্টারের মালিক ডা. বিজয় কৃষ্ণ হালদার, তার মা, স্ত্রী যিনি সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ এবং তার কলেজপড়ুয়া কন্যা অপহৃত হন। পরে স্থানীয় লোকজন তাদের উদ্ধার করেন। ইউপি নির্বাচনে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক গাজী আবদুল হাদী উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালে রুদাঘরার হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ তার কাছে সাহায্যের জন্যে গিয়েছিল। তিনি তাদের নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দেয়া এবং তাদের অর্থ-সম্পদ পাঠিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জমি, জায়গা লিখে নেন। এরপর তারা টাকা দাবি করলে রাতের অন্ধকারে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করেন। ভারতে চলে যাওয়া এরকম পরিবারের অন্যতম দুজন মধুগ্রামের কৃষ্ণপদ ভট্টাচার্য ও ভুপিন্দুর কুন্ডুর নাম উল্লেখ করে বলা হয় তাদের সম্পত্তিতে এখন হাদীর ভ্রাতুষ্পুত্র তৌহিদুজ্জামান বাস করছেন। এদিকে গত মাসে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরে না জানিয়ে জমি বিক্রির অপরাধে এক সংখ্যালঘুর দোকানে তালা দিয়েছে যুবলীগের নামধারী সন্ত্রাসীরা। যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার বুড়ুলিয়ায় এক সংখ্যালঘু পরিবারের পৈত্রিক সম্পত্তি জবরদখলের চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত ৬ই মার্চ চাঁদা না দেয়ায় মৌলভীবাজারের বড়লেখার খাসিয়াপুঞ্জির ২ হাজার পান গাছ কর্তন করে সন্ত্রাসীরা। লালমনিরহাট জেলায় জমিসংক্রান্ত পুর্ব শত্রুতার জেরে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে এক আদিবাসী নারীকে মারাত্মক ভাবে আহত করে একটি ভূমিগ্রাসীচক্র। সম্পত্তি দখলের চেষ্টায় গত ১৪ই মার্চ মাথায় কোদাল দিয়ে কোপানো হয় লালমনিরহাট সদরের উত্তর সাপ্টানা কোরবানটারী গ্রামের কৃষক অনিল চন্দ্র রায়ের স্ত্রী অর্চনা রানীকে। গত মাসে জামালগঞ্জের সাচনা বাজারে এক হিন্দু পরিবারের বাজারভিটি জোরপূর্বক প্রভাব খাটিয়ে দখল করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে একটি সন্ত্রাসী চক্রের অত্যাচারে রাজবাড়ী সদর এলাকার বহু হিন্দু পরিবার ইতিমধ্যে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছে। গত ২রা ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে নবীগঞ্জের কুর্শি ইউনিয়নের সমরগাঁও গ্রামের ব্যবসায়ী সিতাংশু শেখর দাশের বাড়ির খড়ের ঘরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মহল্লা হিসেবে পরিচিত শীষমহল এলাকায় পর পর দুই রাতে চার স্থানে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে এ মাসে। গত ২২শে মার্চ সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণের বারকোট গ্রামে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর, নারী ও শিশুকে মারধরের ঘটনা ঘটে। গত ৩ মাসে বেশ কয়েকটি স্থানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি জবর দখল, দখলের তৎপরতা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। গত ১লা জানুয়ারি ভূমিদস্যুরা দিনাজপুর সদর উপজেলার আইহাই গ্রামের কালীমন্দির, শিবমন্দির ও মনসা মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে। ২রা জানুয়ারি চাঁদা না পেয়ে দুর্বৃত্তরা প্রথমে সুধিন চন্দ্র শীল নামে এক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে মারধর করে, পরে মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে। ৬ই জানুয়ারি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার কাশিনাথপুর ইউনিয়নের কার্বারিখোলা সার্বজনীন কালীমন্দিরে দুর্বৃত্তরা পেট্রল ঢেলে আগুন দেয়। এ ছাড়া ৩১শে জানুয়ারি গৌরনদীতে ১টি কালীমন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। চলতি মাসে গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার ছোট দৌলতপুর গ্রামের একটি কালীমন্দিরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ফেনীর পরশুরামের বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের মুহাম্মদপুর গ্রামে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তার ব্যক্তিগত সুবিধার্থে জোরপূর্বক রাস্তা নির্মাণের পূর্বের নকশা বাদ দিয়ে মন্দির ও শ্মশানের উপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করার চেষ্টা করে। গত ৫ই ফেব্রুয়ারি যশোরে সংখ্যালঘু হিন্দুদের শত বছরের দখলে থাকা জমি দখল করে দরজায় ইট গেঁথে বন্ধ করে দিয়েছে এক পুলিশের সদস্য। গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়নের মগপুকুর এলাকার এক প্রভাবশালী ভূমিদস্যু হিন্দুদের শ্মশান দখলের উদ্দেশ্যে শ্মশানের উপর ঘর তোলার চেষ্টা করে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মাহমুদাবাদ নীলকুঠি এলাকার প্রভাবশারী ভূমিদস্যুরা রাতের আধারে দীপক বিশ্বাসের জমিতে জোরপূর্বক ঘর নির্মাণ করে।