শোধনাগারের রূপ পাবে কারাগার : প্রধানমন্ত্রী
ডেস্ক রিপোর্ট :: অপরাধীদের সংশোধন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কারাগারগুলোকে সংশোধন কেন্দ্রে পরিণত করতে তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুরে রোববার (১০ এপ্রিল) নতুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্বোধনী বক্তব্যে এ বিষয়ে কথা বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘কারাগারগুলোকে শোধনাগার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রত্যেকে সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পারে। অপরাধীদের সংশোধন করতে হবে; সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। তারা না থাকলে পরিবারের কী অবস্থা হয়, তা তাদের জানা দরকার।’
শুধু অপরাধের পর গ্রেফতারের চিন্তা না করে অপরাধ প্রবণতা থেকে মানুষকে কীভাবে বের করে আনা যায় সেদিকে চিন্তা-ভাবনা করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ‘অপরাধ করলে শাস্তি দিলাম- এতেই শেষ না।
একজন ছিঁচকে চোর যদি জেলখানায় গিয়ে আরও বড় চোরদের সংস্পর্শে আসে, তাহলে জেলখানা থেকে বেরিয়ে সে পাকা চোর হয়ে ওঠে; ট্রেনিংটা সেখানেই পেয়ে যায়।’
কারাবন্দিদের প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য, তাদের উৎপাদনমুখী কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা… সেজন্য তারা মজুরি পাবে এবং সেটা জমা থাকবে। যখন মুক্তি পাবে তখন একটা ছোটখাটো ব্যবসা বা দোকান দিয়ে সমাজে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে।
সে কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় তার মজুরির একটা অংশ পরিবারকেও দেওয়া হবে। কারণ, অপরাধ করে একজন কিন্তু তার জন্য ভুক্তভোগী হয় গোটা পরিবার।’ তিনি বলেন, ‘কাজের মধ্যদিয়ে কাজের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। সংশোধন করে বন্দিদের জীবন কর্মমুখর করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী সকালে কারাগার প্রাঙ্গণে পৌঁছালে তাঁকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। পরে সাড়ে চার হাজার মানুষ ধারণক্ষমতার নতুন এই কারাগারের ফলক উন্মোচন করেন তিনি। ৩১ একর জমির ওপর পুরুষ বন্দিদের জন্য নির্মিত এই কারাগারের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখেন প্রধানমন্ত্রী।
পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শিগগিরই পুরুষ বন্দিদের কেরানীগঞ্জের নতুন কারাগারে সরিয়ে নেওয়া হবে বলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জানান কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন। কারাগারের কিছু সুবিধা বৃদ্ধিতে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
নতুন এই কারাগারের মতো ধারণক্ষমতাসম্পন্ন পুরুষ বন্দিদের জন্য আরেকটি কারাগার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া পাশেই আরেকটি কারাগার নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে, যেখানে ২৭০ জন নারী বন্দি রাখা যাবে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকার মোট ১৯৫ একর জায়গার ওপর দুটি পুরুষ ও একটি মহিলা কারাগার থাকবে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, ‘পুরো কারাগারটি নির্মিত হলে আট হাজার বন্দি রাখা যাবে।’
নতুন এই কারাগারের উন্নয়নে কিছু নির্দেশও দেন প্রধানমন্ত্রী, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে-
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য প্রতিটি ভবনে সোলার প্যানেল স্থাপন, কারারক্ষীদের চাকরিকালীন সমস্যা দূর করা, কর্মকর্তার সংখ্যা বৃদ্ধি করা, পুরনো কারাগারের পরিবর্তে কেরানীগঞ্জে কারারক্ষীদের প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করে বন্দিদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা, কারাগারের হাসপাতালের ধারণক্ষমতা ২০০ শয্যায় উন্নীত করা, কারারক্ষীদের সন্তানদের জন্য নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করা, বন্দিদের জন্য পাবলিক টেলিফোনের ব্যবস্থা করা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘চুরি করে মোবাইল টেলিফোনে কথা বলা বন্ধ করতে পাবলিক টেলিফোনে মাসে হয়তো একবার পরিবারের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, স্বরাষ্ট্র সচিব মোজাম্মেল হক খান এবং সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
পরে প্রধানমন্ত্রী কারাগার প্রাঙ্গণে একটি গাছের চারা রোপণ করেন এবং কারাগারের উদ্বোধন উপলক্ষে কেক কাটেন। ১৭৮৮ সালে স্থাপিত নাজিম উদ্দিন রোডের পুরনো কারাগার থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-মাওয়া সড়কের দক্ষিণে রাজেন্দ্রপুরে নতুন এই কারাগারের অবস্থান।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তরের আলোচনা শুরু হয়েছিল সেই আশির দশকে। তার তিন দশক পর ২০০৬ সালে বিষয়টি একনেকে পাস হলে শুরু হয় জমি অধিগ্রহণ। পরের বছর সেপ্টেম্বরে ৪০৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।
ব্রিটিশ আমলে তৈরি বাংলাদেশের পুরনো কারাগারগুলোর মতো কেরানীগঞ্জ কারাগারের দেয়াল লাল নয়। তুলনামূলকভাবে খোলামেলা এ কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও অন্যগুলোর তুলনায় আধুনিক। ছয়টি ছয়তলা ভবনে হাজতি এবং একই ধরনের দুটি ভবনে কয়েদিদের রাখা হবে।
এসব ভবনের প্রতি তলায় ৪০টি করে কক্ষ; প্রতি কক্ষে ১৩ জন করে বন্দি রাখার ব্যবস্থা। ২০ হাত দৈর্ঘ্য ও ১০ হাত প্রস্থের প্রতিটি কক্ষে থাকবে চারটি করে সিলিং ফ্যান। পাশেই বাথরুম। চারটি চারতলা ভবন হবে ডেঞ্জার সেল। ৪০০ দুর্ধর্ষ জঙ্গি ও সন্ত্রাসীকে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। ডিভিশনপ্রাপ্ত (ভিআইপি) বন্দিদের জন্য ১৬টি বিশেষ কারাকক্ষ।
‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’, জঙ্গি ও গুরুতর মামলার আসামিদের এ কারাগারে চারটি ভবনে রাখা হবে, যেগুলোকে বলা হচ্ছে ডেঞ্জার সেল। কারাগার ঘিরে আছে ১৮ ফুট উচ্চতার সীমানা প্রাচীর। তার ওপর দুই ফুট বৈদ্যুতিক তারের সেন্সর। প্রতিটি ভবনের রয়েছে আলাদা ছোট প্রাচীর।
কোনো আসামি ১৮ ফুট দেয়াল টপকে যেতে চাইলে তারের সেন্সরে স্পর্শ লাগামাত্র নিরাপত্তা ঘণ্টা বেজে উঠবে। সেই সঙ্গে পলায়নপর কয়েদিকে খেতে হবে বৈদ্যুতিক শক। এখানে এক ভবনের আসামি অন্য ভবনে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।
কারাগারের ভেতর চিকিৎসাকেন্দ্র, সেলুন ও লন্ড্রি ভবন রয়েছে। বন্দিদের কাজের জন্য রয়েছে দোতলা ওয়ার্ক শেড। ব্যারাকে থাকতে পারবেন ৪০০ কারারক্ষী। আর সবকিছু পর্যবেক্ষণের জন্য কারাগারের চারপাশে রয়েছে ৪০ ফুট উঁচু চারটি ওয়াচ টাওয়ার।
প্রধানমন্ত্রী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে কেরানীগঞ্জে যান এবং ওই রাস্তায় ফিরে আসেন। যাওয়া-আসার পথে দুবারই তিনি টোল দিয়েছেন বলে জানান তার প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।