নগরের ৩০ পরিত্যক্ত ভবনে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস
নুরুল হক শিপু :: সিলেট সিটি কর্পোরেশনের তৈরি করা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ফায়ার সার্ভিস ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, মহানগরীতে প্রায় ৮০ ভাগ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। আর সিটি কর্পোরেশনের তালিকায় রয়েছে মাত্র ৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের নাম। যে তালিকাটি করা হয়েছে ২০০৫ সালের দিকে। বিশেষজ্ঞদের জরিপ ও মতামতে ওঠে এসেছে সিলেটের ৭৪ ভাগ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের দেয়া এ সাথে মিল রয়েছে সিলেট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষে দেয়া তথ্যের। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বলছে, শুধু সিলেট মহানগরীতেই ৮০ ভাগ ভবন অগ্নিকান্ড ও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে।
ভূমিকম্পের ডেঞ্জারজোন সিলেটের মানুষের মাঝে এখন বড় আতঙ্ক মহানগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। কিন্তু বাসিন্দা বা মালিকরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন না ছেড়ে উল্টো জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছেন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও প্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম সবুজ সিলেটকে বলেন, ‘আমাদের প্রাপ্ত তথ্যে সিলেটের ৭৪ ভাগ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ অপরিকল্পিতভাবে বেশিরভাগ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কোনো প্রকৌশলীর পরিকল্পনা নয়; শহরে বেশিরভাগ ভবনই নির্মাণ করা হয়েছে রাজমিস্ত্রির নির্দেশনায় ও পরিশ্রমে। যা এখনও বন্ধ হয়নি। এই ভবনগুলো শতভাগ ঝুঁকিপূর্ণ বলে ধারণা করা হচ্ছে’।
এদিকে, সিসিকের প্রশ্নবিদ্ধ তালিকায় যে ৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে, সেগুলো অপসারণ করা দূরে থাক, সেগুলোতে নিয়মিত ঝুঁকি নিয়ে চলছে সার্বিক কার্যক্রম। ভবনগুলো অপসারণে শক্তিশালী কোনো পদক্ষেপে যেতে পারছে না সিসিক কর্তৃপক্ষ। শুধু নোটিস আর লাল রঙের একটি ব্যানার ভবনে সাঁটানোতেই যেন দায়িত্ব শেষ করছেন সংশ্লিষ্টরা। সিলেট কালেক্টর ভবন-৩ এ সাঁটানো একটি ব্যানারে লেখা রয়েছে, ‘অধিদপ্তর থেকে ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হইয়াছে। ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ করা হইল। নির্দেশক্রমে নির্বাহী প্রকৌশলী সিলেট সিটি কর্পোরেশন’।
তালিকাভূক্ত ঝুঁকিপূর্ণ ৩০টি ভবন হচ্ছে, কালেক্টরেট ভবন-৩, জেল রোডস্থ সমবায় ব্যাংক ভবন, মাহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়, জিন্দাবাজারস্থ কাস্টমস ও ভ্যাট অফিস ভবন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এসএ রেকর্ড অফিস, সুরমা মার্কেট, বন্দরবাজারস্থ সিটি সুপার মার্কেট, জিন্দাবাজারস্থ রহমান প্ল¬াজা ও মিতালী ম্যানশন, মিরাবাজারস্থ সিলেট মডেল স্কুল ও কলেজ, সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, কারিগরি ইনস্টিটিউট, সিলেট সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, মদিনা মার্কেটের পেছনের কয়েকটি বাসা (তালিকা বাসার নম্বর বা সংখ্যা উল্লে¬খ করা হয়নি), দরগাহ গেইটে আজমীর হোটেল ও মাহমুদ কমপ্লে¬ক্সের পেছনের বাসা, শেখঘাট পুরাতন পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন বাসা, মদনমোহন কলেজের নবনির্মিত ভবন, মধুবন মার্কেট, পূর্ব শাহী ঈদগাহস্থ অনামিকা এ/৭০ (খান কুঞ্জ), ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কালাশীল এলাকার মান্নান ভিউ, বন্দরবাজারের সিটি সুপার মার্কেট, শেখঘাটের শুভেচ্ছা-২২৬ নম্বর বাসা, চৌকিদেখির ৫১/৩ সরকার ভবন, যতরপুরের নবপুষ্প ২৬/এ, জিন্দাবাজারস্থ রাজা ম্যানশন, ভাতালিয়ার ১১৮-সীমানা দেওয়াল, পুরান লেনের শফিকুল হকের ৪/এ কিবরিয়া লজ, দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলায় সিদ্দিক আলীর বাবর ট্রাভেল্স ও খারপাড়ায় মিতালী-৭৪ নম্বর বাসা।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবীব বলেন, ‘২০০৫ সালে শাহজালালা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলীদের দিয়ে সিসিক এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করা হয়। তারা আমাদেরকে ৩০টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে দেন। এরপর আমরা ওইসব ভবন মালিকদের নোটিস করি। তারা ভবন সংস্কার কিংবা অপসারণ কোনোটিই না করায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ লিখে ব্যানার টানিয়ে দিই। এরপর ব্যানারও তারা খুলে ফেলে। আমরা শীঘ্রই এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। মহানগরে মাত্র ৩০টি ভবন কি ঝুঁকিপূর্ণ জানতে চাইলে এনামুল হাবীব বলেন, ৩০টির তালিকা ২০০৫ সালের, বর্তমানে আরো বাড়তে পারে। আমরা আবার নতুন তালিকা করব।’
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী (ভারপ্রাপ্ত) নুর আজিজ বলেন, ‘স্থাপনাগুলো খালি ও ভেঙে ফেলতে আমরা সকলকে নোটিস পাঠিয়েছি। কেউ কেউ সময় চেয়েছেন। অনেকে সময় পার হওয়ার পরও ভবন খালি করেননি। আমরা কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার। আমরা ব্যবস্থা নিতেই ব্যানার টানাই। ভবন মালিকেরা ব্যানার টানানোর পর আমাদেরকে উল্টো উকিল নোটিস পাঠিয়ে দেন। কোনো কোনো ভবন মালিক ব্যানার খুলে ফেলেন। নূর আজিজ বলেন, আমরা শীঘ্রই সিটি সুপার মার্কেট অপসারণের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব’।
শুধু ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কারণেই সিলেট হতে পারে মৃত্যুপুরী! এমন ধারণা এখন বিশেষজ্ঞদের। কারণ রিখটার স্কেলে পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প হলে নগরীর ৮০ ভাগ ভবনই ধসে যেতে পারে। আর ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে পুরো অঞ্চলের প্রায় ৯৫ ভাগ স্থাপনা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে। প্রাণ হারাতে পারেন ১২ লাখ মানুষ এবং টাকার অঙ্কে ক্ষতি হতে পারে ১৭ হাজার কোটি টাকার উপরে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও প্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেছেন, সিলেটের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বসবাসকারীদের সরে যাওয়া প্রয়োজন। আমরা যে ভবনগুলো সিটি কর্পোরেশনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছি সেগুলো মোটেও নিরাপদ নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিলেটে আগামী ১২ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্পের আশঙ্কা নেই। আর যদিও ওই সময়ের মধ্যে ভূমিকম্প হয়, তাহলে ৫ থেকে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেটের উপপরিচালক সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘সিলেটে ভূমিকম্প হলে মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে হবে। কারণ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছেন। তাই দুর্যোগ মোকাবেলায় সতর্ক থাকার পাশাপাশি প্রস্তুতিও থাকার প্রয়োজন।’
সিলেট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. জাবেদ আহমদ তারেক বলেন, ‘শুধু মহানগরীতেই ৮০ ভাগ ভবন অগ্নিকান্ড ও ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের শতভাগ আইন মেনে একটি ভবনও শহরে নির্মাণ করা হয়নি-এজন্য ভূমিকম্পে ভবন ধসে হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে। আর ফায়ার সার্ভিসের ২৯টি নিয়মের সবকটি না মানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।’