বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস আজ
স্টাফ রিপোর্টার :: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৬ তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস আজ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত এই নেতা ১৯২০ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় এই বয়সী অনেক রাজনৈতিক এবং বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিত্ব এখনও স্ব-স্ব কমর্কান্ডে নিয়োজিত থাকার নজির থাকলেও আমাদের জাতির পিতাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল ।জাতি যথাযোগ্য মর্যাদা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার দিবসটি উদযাপন করবে। দিনটিতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার সকাল দশটায় টুঙ্গিপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করবেন। এছাড়াও মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে এবং শিশু সমাবেশ, আলোচনা সভা, গ্রন্থমেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন।যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলো দুদিন ব্যাপি বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ।
আওয়ামী লীগের অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছেÑ ১৮ মার্চ বিকেল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আর্ন্তজাতিক সন্মেলনে কেন্দ্রে আলোচনা সভা। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।সারাদেশে জেলা ও উপজেলা সদরে দিবসটি উপলক্ষে শিশু সমাবেশ, র্যালি, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা সদরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ডিএফপি ও গণযোগাযোগ অধিদফতরের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও মহান মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সপ্তাহব্যাপী পুস্তক ও ডকুমেন্টারি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।বিশ্বের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশী দূতাবাসসমূহে দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় উদ্যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সারাদিন ধরেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের রেকর্ড বাজানো হবে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে সারাদেশে বিভিন্ন মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং অন্যান্য উপাসনালয়ে প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেল দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করবে বিশেষ ক্রোড়পত্র।জাতির জনকের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে যুবলীগ, মহিলা যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা ঢাকা মহানগর শাখা এদিন দিনব্যাপি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল ৭ টায় উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং সকাল সাড়ে দশটায় ছাত্র –শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে আলোচনা সভা । এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদসহ আবাসিক হলের মসজিদ ও উপাসনালয়ে দোয়াÑ প্রার্থনা ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করা হবে। সকালে চারুকলা অনুষদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হবে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা ।
জাতির পিতার জন্ম দিন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবা, রক্তদান, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে ।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদানের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমানে মওলানা আজাদ কলেজ) ছাত্র ইউনিয়নের (ছাত্র সংসদ) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের টিকেটে ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলীর সদস্য নির্বাচিত হন। ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আজীবন সোচ্চার এই অবিসংবাদিত নেতাকে রাজনৈতিক জীবনে বহুবার কারাবরণ করতে হয়।
তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬-দফা ও পরবর্তীতে ১১ দফা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এই অবিসংবিদত নেতা এবং বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ করেন।
তাঁর সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ধাপে ধাপে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হলেও তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতির ওপর নানা নির্যাতন শুরু করে। বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন।২৫ মার্চ মধ্যরাতে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালীর বহু আকাক্সিক্ষত বিজয় ও স্বাধীনতা অর্জিত হয়।বিংশ শতাব্দীতে নির্যাতিত, নিপীড়িত ওশোষিত মানুষের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে যারা বিশ্বনন্দিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের অন্যতম।
সাম্য, মৈত্রী,স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিরামহীন সংগ্রামে অবদান রাখার জন্য তিনি বিশ্বশান্তি পরিষদের জুলিও কুরি পদকে ভূষিত হন।বিশ্ব গণমাধ্যমের চোখে বঙ্গবন্ধু ক্ষণজন্মা পুরুষ। অনন্য সাধারণ এই নেতাকে স্বাধীনতার প্রতীক বা রাজনীতির ছন্দকার খেতাবেও আখ্যা দেয়া হয়। বিদেশী ভক্ত, কট্টর সমালোচক এমনকি শত্র“রাও তাদের নিজ নিজ ভাষায় তাঁর উ”চকিত প্রশংসা করেন।বিগত বিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তী কিউবার বিপ্ল¬বী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেন।
ক্যাস্ট্রো বলেন, আমি হিমালয়কে দেখেনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি ছিলেন হিমালয় সমান। সুতরাং হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা আমি লাভ করেছি। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ক্যাস্ট্রোর সাক্ষাত ঘটে।এ সময় তিনি বঙ্গবন্ধু সর্ম্পকে এ মন্তব্য করেন।
শ্রীলংকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষ্মণ কাদির গামা (নৃশংস হত্যার শিকার) বাংলাদেশের এই মহান নেতা সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া গত কয়েক শতকে বিশ্বকে অনেক শিক্ষক, দার্শনিক, দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, রাজনৈতিক নেতা ও যোদ্ধা উপহার দিয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সবকিছুকে ছাপিয়ে যান, তাঁর স্থান নির্ধারিত হয়ে আছে সর্বকালের সর্বোচ্চ আসনে।
বিবিসি’র এক জরিপে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী নির্বাচিত হন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু যখন বিভিন্নমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করতে শুরু করেন ঠিক সেই মুহূর্তে স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তি ও কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল তাঁর বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং ওই ষড়যন্ত্রেরই অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনে কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার হাতে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ নিহত হন।জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের মধ্যে ৫ জনের ফাঁসির রায় ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কার্যকর করা হয়। এর মধ্যদিয়ে জাতির ইতিহাসের অন্ধকার যুগের অবসান ঘটে।