‘হ্যাকিংয়ে বিদেশিদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের লোকজনও জড়িত’ (ভিডিও সহ)
ডেস্ক রিপোর্টঃ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বিপুল অংকের টাকা চুরির ঘটনায় বিদেশিদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ না কেউ অবশ্যই জড়িত বলে মনে করছেন তথ্য ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জাকারিয়া স্বপন। তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় কেবল দেশীয় ব্যক্তি নয়, জড়িত আছেন বিদেশি জালিয়াত গ্রুপ, যারা বিশ্বব্যাপী পরিকল্পিতভাবে চুরি করে থাকেন’।
‘তথ্য প্রযুক্তি খাত ঝঁকির মুখে: সাইবার সিকিউরিটি ঝুঁকিতে আর্থিক খাত’ শীর্ষক যমুনা টেলিভিশনের অর্থ ও বাণিজ্য বিষয়ক সাপ্তাহিক ‘ইনসাইড বিজনেস’ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল যমুনায় সীমা ভৌমিক সঞ্চালিত এই অনুষ্ঠানে জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘আমরা যেভাবে টেকনোলজিকে অ্যাডাপ্ট (তাল মিলিয়ে চলা) করেছি, টেকনোলজি সিস্টেমকে সেভাবে অ্যাডাপ্ট করা হয়নি। মূলত বাংলাদেশে একটা বিষয়ে আটকে গেলে সেটাকে অ্যাড্রেস (আলোচনায় নিয়ে আসা) করা হয়। টেলিকমিউনিকেশনের সিকিউরিটি নিয়ে অনেকদিন ধরে কথা বলেছি কিন্তু আমরা ওই স্কেলে (গতিতে) সচেতন ছিলাম না। সেই কারণেই এই সমস্যাগুলো হচ্ছে’।
তথ্য প্রযুক্তির সাইবার সিকিউরিটি ঝুঁকিতে বাংলাদেশে শীর্ষে থাকার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই খাতে সংকটের একটা বড় কারণ হলো ইকোনমি। এটি বিশ্বের অনেকগুলো ম্যাচিউরড অর্থনীতি থেকে ম্যাচ গ্রো (দ্রুত অগ্রসর) করছে। আমাদের লাস্ট টেন ইয়ার্সের ডেভেলপমেন্ট উন্নয়ন বিশ্বের অনেক দেশেই নাই। সেই বিবেচনায় এটি হতে পারে। তবে এটির জন্য ভয় পাবার কোনো কারণে নেই।…’
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিভিন্ন চুরির ঘটনা একেবারেই নতুন নয় বলে মনে করেন এই তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘এই ঘটনাগুলো একদম প্লানিং করা। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের উদাহরণ যদি দেখি, একশ মিলিয়ন ডলার যার ২০ মিলিয়ন নিয়ে গেছে শ্রীলঙ্কাতে, ৮০ বা ৮১ মিলিয়ন ডলার নিয়ে গেছে ফিলিপাইনে। টাকাটাকে রোটেড করে দেওয়ার জন্য পুরো টাকা দিয়ে দেওয়া্ হয়েছে তার ক্যাসিনোর ভিতরে। ক্যাসিনোতে গিয়ে কয়েন কিনেছে। কয়েন কিনে জুয়া খেলে, ওটাকে আবার কারেন্সিতে কনভার্ট করা হয়েছে। সো আপনি বুঝতেই পারবেন টাকা কোন হাতে চলে গেছে। তারপর টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েছে হংকংয়ে। এই চেইন বৃহৎ চক্র। এই চক্র নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের বড় বড় জায়গাগুলোতে পরিকল্পনা করে তারা কাজ করে।’
চাইনিজ হ্যাকাররা টাকা নিয়ে চলে গেছে ব্যাপারটা এত সহজ নয় বলে জানান জাকারিয়া স্বপন। তিনি বলেন, ‘এর মধ্যে একটা বড় চক্র জড়িত আছে। দেশে একই ঘটনা ঘটেছে এটিএম কার্ড জালিয়াতির ক্ষেত্রেও। সেখানেও কিন্তু বিদেশি লোকজন জড়িত ছিলেন। এবং আমাদের লোকাল বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তারা কাজটি করেছেন। সুতরাং পরিকল্পনা অনেক দিনের আর এর ফল আমরা পাচ্ছি এখন।’
টাকা চুরির বিষয়ে ফেডারেল ব্যাংক সব নিয়ম মেনেই টাকা দিয়েছে এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘এটা একটা ধোঁয়াশে জায়গা। এখনও আমরা অনেক বিষয়ে ধারণা করতে পারি। কিন্তু সঠিক জিনিসটা কিছুদিনের মধ্যেই বেরিয়ে আসবে।’
সমসাময়িক অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচিত এই অনুষ্ঠানে তিনি আরো বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা যা জানি, ৩৫টি ম্যাসেজ গিয়েছে ফেডারেল ব্যাংকে। বলা হয়েছে যে তুমি উমুক উমুক ব্যাংকে টাকা পাঠাও। তার পাঁচটা তারা অনার করেছে। এবং তাদের কাছে কিন্তু মনে হয়েছে, এটা ঠিক জায়গা থেকে সঠিকভাবে আসছে না। তাদের কাছে যে চেকলিস্টগুলো আছে। ওখানে তারা মনে করছে জিনিটা সঠিক মনে হচ্ছে না। বিজনেস ঠিকমতো হচ্ছে না। ঠিক এরপরই তারাই ওটা বন্ধ করেছে।’
এখন পর্যন্ত বিশ্বে এমন ধরনের হ্যাক হওয়ার নজির নেই উল্লেখ করে জাকারিয়া স্বপন বলেন, ‘আমার জানামতে এমন কোনো ইনসিডেন্ট মিডিয়ায় নেই যে, সুইচ ব্যাংকে হ্যাক করে অন্য ব্যাংকে তারা টাকা সরিয়ে ফেলতে পেরেছে। যদি প্রমাণ হয় তবে এটিই বিশ্বে প্রথম উদাহরণ হয়ে থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘টাকা ট্রানজেকশনের আগে তিনটা জায়গা থেকে তা ভেরিফাই করা হয়। একজন ইনিশিয়েট করে, একজন চেক করে এবং একজন অথোরাইজড করে। তারপরই ট্রানজেকশনটা হয়। সো এমনভাবে কম্পিউটারগুলো বসানো হয়েছে যে, স্পেসিফিক ওই কম্পিউটারটাকেই ওরা বিশ্বাস করে। ইভেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য কম্পিউটার থেকে পাঠালেও কিন্তু সেটাকে ওরা অনার করবে না। এটাকে যদি খুব সরলভাবে আমরা বলি, ওই তিনটা পিসিকেই ওরা অপারেট করতে পারে। সেটা ইন্টারনেট দিয়ে হোক, ঢাকা থেকে হোক কিংবা বাইরে থেকে হোক সেটা এক্সেস করে ওখান থেকে তারা নির্দেশনা পাঠিয়েছে যে, টাকাগুলো আমেরিকার ওই ব্যাংকগুলোতে দিয়ে দাও। অথবা আরেকটা টেকনোলজি আমরা বলি, ম্যান ইন দ্যা মিডল। সেটা কাজ করেছে। ম্যান ইন দ্যা মিডল কনসেপ্ট হলো এমন যে আমি আপনি কথা বলছি সেখানে আরেকজন মাঝখানে আসবে। আপনি মনে করবেন যে আমার সাথে কথা বলছেন। কিন্তু আপনি আসলে আরেকজনের সাথে কথা বলছেন। এটা বিশ্বব্যাপী প্রমাণিত একটি বিষয়। হ্যাক করার জন্য ম্যান ইন দ্যা মিডল একটি মেথড।’
হ্যাক সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলে দিতে পারি এটা বিদেশি এবং দেশি সব মিলেই এমনটা হয়েছে।’
বিদেশিদের বিষয়ে কম নজরদারির কারণে তারা অপকর্ম কার সুযোগ পান বলে মনে করেন এই প্রযুক্তিবিদ। আর এই সুযোগে তারা কিছু বাংলাদেশিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। এ পর্যায়ে তিনি কয়েকটা এমন উদাহরণও দেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরির বিষয়ে বিদেশিরা জড়িত তো আছেনই। কিন্তু একটা জিনিস বলা প্রয়োজন, ঘটনা ঘটার এক মাস পরে এটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক’। এত দিন বিষয়টা কেমন ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এই প্রযুক্তিবিদ। ‘এটা কিন্তু একটা রহস্য’, যোগ করেন জাকারিয়া স্বপন।
আর সাইবার সিকিউরিটি আইন থাকলেও এর প্রায়োগিত বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কোডগুলো কেউ শেয়ার না করলেও কীভাবে হলো এমন আলোচনার পরিপ্রেক্ষেতে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না যে বাংলাদেশে এত বড় ঘটনা ঘটেছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ জড়িত না, এটা আমি বিশ্বাস করি না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু লোক অবশ্যই এটার সাথে জড়িত আছেন। এবং দেখবেন সবই বেরিয়ে আসবে। আসলে কারা জড়িত ছিলেন।’
তবে এগুলো নিয়ন্ত্রণে যে সিস্টেমগুলো আমরা বানাচ্ছি তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকার কথা বলেন এই বিশেষজ্ঞ। একই সঙ্গে প্রযুক্তিগত বিষয়ে সচেতন থাকার আহবান জানান তিনি।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ থেকে ১০ কোটি ডলার মানি লন্ডারিং হয়েছে বলে একটা খবর প্রকাশের পর থেকেই সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। খবরে বলা হয়, চীনা হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা সেখানকার কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এ অর্থ হাতিয়ে নেয়। হ্যাকার দল এ অর্থ প্রথমে ফিলিপাইনে পাচার করে।
অবশ্য এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বিপুল অংকের টাকা চুরি যাওয়ার কথা স্বীকার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইসঙ্গে চুরি যাওয়ার টাকার একাংশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে গত সোমবার বিকেলে একপ্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।