এই বর্বরতা রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ
ডেস্ক রিপোর্টঃ এ এক বিপন্ন সময়। প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে লোমহর্ষক সব খবর। শিরোনাম হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুরা। হত্যা করা হচ্ছে তাদের। বিনা অপরাধে। অবিশ্বাস্য। তবে ঘটনা সত্য। প্রতিদিন গড়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে একজন শিশু। সর্বশেষ গতকালও পাওয়া গেছে এমন তিনটি বর্বরতার খবর। কুমিল্লায় দুই শিশুকে হত্যার খবর পুরনো হওয়ার আগেই জেলার মনোহরগঞ্জ উপজেলায় নিখোঁজের একদিন পর উদ্ধার করা হয়েছে এক শিশুর লাশ। সোমবার রাতে বনশ্রীতে নিহত ভাই-বোনের শরীরে পাওয়া গেছে আঘাতের চিহ্ন। চিকিৎসকরা বলছেন, তাদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হতে পারে। যশোরের অভয়নগরে তিন মাসের শিশুকে নিজ হাতে হত্যা করেছেন পিতা। চারটি কন্যা শিশুর পর পঞ্চম সন্তানটিও কন্যা হওয়ায় তাকে কীটনাশক পান করিয়ে হত্যা করা হয়েছে। শিশুটির পিতা এখন পলাতক রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
শিশুদের প্রতি কেন এই বর্বরতা। কেন অমানুষ হয়ে যাচ্ছেন মানুষ। কেন মারা গেছে বিবেক। মূল্যবোধের অবক্ষয় আর সামাজিক অস্থিরতাকেই এর জন্য দায়ী করেছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, মানুষের প্রতিশোধ পরায়ণতার নির্মম শিকার হচ্ছে শিশুরা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি অপরাধীদের আরও উৎসাহিত করছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এ অঞ্চলের মানুষের একসময় অর্থনৈতিক অভাব ছিল প্রকট। ক্ষুধার বিরুদ্ধে দিনের পর দিন সংগ্রাম করতে হয়েছে তাদের। তবে মূল্যবোধের দরিদ্রতা অতীতে কখনওই এতটা প্রকট হয়নি। মানুষ মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। লোভ আর হিংস্রতার কাছে হেরে গেছে মনুষত্ব। এ এমন এক সময় যখন মনুষত্ব নেই, কিন্তু মানুষ আছে। হবিগঞ্জের বাহুবলের সুন্দ্রাটিকি গ্রামে চার শিশু হত্যা নৈতিকতার প্রশ্নটি নিয়ে এসেছিল সামনে। এমন বর্বর হত্যা কি মানুষের পক্ষে সম্ভব- প্রশ্নটি উচ্চকিত হয়েছে কয়েক দিন। কিন্তু বর্বরতা থেমে নেই। একের পর এক শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেই চলছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছর প্রথম দেড় মাসে নিহত হয়েছে ৪৫ শিশু। শিশু হত্যার এ হার অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ শিশু ফোরামের তথ্যমতে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত চার বছরে সারা দেশে ১ হাজার ৮৫ জন শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। এর মধ্যে ২০১২ সালে ২০৯ শিশু, ২০১৩ সালে ২১৮ শিশু, ২০১৪ সালে ৩৬৬ শিশু ও ২০১৫ সালে ২৯২ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিশুদের হত্যা করা হয়েছে অপহরণের পর। অপরাধীদের সহজ টার্গেটে পরিণত হচ্ছে শিশুরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি দুটি আলোচিত শিশু হত্যার দ্রুত বিচার সম্পন্ন হয়েছে। সিলেটে রাজন এবং খুলনায় রাকিব হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে দ্রুতই রায় ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু এসব মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে আরও দুটি ধাপ রয়েছে। প্রথমে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স শুনানি হবে। এরপর আসামিরা যদি আপিল করেন তবে মামলা যাবে আপিল বিভাগে। সেখানেই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। তবে রাজন ও রাকিব হত্যার বিচার নিম্ন আদালতে দ্রুত হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বছরের পর বছর ঝুলে থাকে শিশুহত্যার বিচার। সন্তান হত্যার বিচারের জন্য যুগের পর যুগ অপেক্ষা করতে হয় পিতা-মাতাকে।
শুধু মৃত্যুদণ্ড দিয়েই যে শিশু হত্যার মতো বর্বর ঘটনা বন্ধ করা সম্ভব নয় তা এখন অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির মুখোমুখি করাই রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য; যেন অপরাধীরা কোনোভাবেই পার পেয়ে যেতে না পারে। অপরাধীদের আইনের মুখোমুখি করার পাশাপাশি শিশু হত্যা বন্ধে এখনই সামাজিক প্রতিরোধ শুরু করা প্রয়োজন। মানুষের বিবেক জাগ্রত করতে হবে। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা দূর করার জন্য কাজ করতে হবে রাষ্ট্রের কারিগরদের। শিশুদের প্রতি এই ধরনের নিষ্ঠুর বর্বরতা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এই বর্বর শিশু হত্যার বিরুদ্ধে এখনই রুখে দাঁড়াতে হবে বাংলাদেশকে। (মানবজমিন)