‘ম্যাডাম তাজেল তো মারা গেছে’
ডেস্ক রিপোর্ট :: হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাস্টার ট্রেনিং চলছে সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সরকারি ছুটি ছিল গত দুই দিন। চতুর্থ শ্রেণিতে রোল কল করছিলেন শিক্ষিকা নাজমুন নাহার। রোল ৪০, তাজেল, রোল ৪০, তাজেল। কোনো সাড়াশব্দ নেই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে হঠাৎ একজন বলে উঠলো, ‘ম্যাডাম তাজেল তো নেই। তাজেল মারা গেছে’। এভাবেই ক্লাসে তাজেলের নাম ধরে ডাকছিলেন শিক্ষিকা। শিক্ষিকা নাজমুন নাহার বলেন, ‘এ কথাটি আমার কাছে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। গত সপ্তাহেও আমার সামনে বসা ছিল তাজেল। খাতায় এখনও তার নাম, রোল ও হাজিরা রয়েছে। এ খাতায় প্রতিদিনই ওর নাম থাকবে এ বছর। কথা বলতে বলতে চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে শিক্ষিকা নাজমুন নাহারের। স্কুলের ১০০ মিটারের মধ্যেই কবর দেয়া হয়েছে সুন্দ্রাটিকি হত্যাকাণ্ডে নিহত ৪ শিশুকে। তারা হলো সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), তার চাচাতো ভাই প্রথম শ্রেণির ছাত্র মনির মিয়া (৭), চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র তাজেল মিয়া (১০) ও তাজেলদের প্রতিবেশী সুন্দ্রাটিকি মাদরাসার ছাত্র ইসমাইল মিয়া (১০)। শিক্ষিকা বলেন, ‘এ পথ দিয়েই আমরা প্রতিদিন স্কুলে আসি। আসার পথে নিজের ছাত্রদের কবর দেখে বুকের ভেতর হু হু করে কান্না আসে। যতক্ষণ স্কুলে আমরা প্রাইমারির শিক্ষকরা থাকি ছাত্রছাত্রীদের নিজের সন্তানের মতো দেখি। এটা সন্তান হারানোর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।’ এ যন্ত্রণা যেন আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি। ২য় শ্রেণির ছাত্র শুভর রোল ছিল ২। নাজমুন নাহার বলেন, ‘বেশ ভালো ছাত্র ছিল সে। সবকিছু একবারেই শিখতে পারতো। ম্যাডাম, ম্যাডাম বলে এমনভাবে ডাকতো যেন এখনও শুনতে পাই তার ডাক, তাকে চোখে ভাসে এখনও। স্কুলের আরেক শিক্ষিকা নূরে জান্নাত শেফা বলেন, ‘ছোট ছোট ৪টি কবর পার হয়ে এ স্কুলে আসাটা যে কতটা বেদনার তা বোঝাতে পারবো না। নিজের ছাত্রদের কবর!’ এত নিজের সন্তানের খবর। আমার সন্তানদের এভাবে মরতে হলো আমি তা কি করে মেনে নেব বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তিনি জানান, এ স্কুলে সুন্দ্রাটিকি গ্রামের শিক্ষার্থীই বেশি। এ ছাড়া বাগানের (চা বাগান) কিছু শিক্ষার্থী রয়েছে। সব শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের চেনেন। স্কুলে বর্তমানে ৩৭০ শিক্ষার্থী থাকলেও সবাই রেগুলার নয়। যারা নিয়মিত, তাদের সঙ্গে সবারই খাতির আছে। ওই শিশুগুলো স্কুলে নিয়মিত ছাত্র। তাই তাদের সবাই চিনেন। মনির মিয়া ভর্তি হয়েছিল এ বছরই ১ম শ্রেণিতে। খুব মিষ্টি ছিল বাচ্চাটা। ফুট ফুটে চেহারা তার। ছোট ছোট শব্দে কথা বলতো। মাত্র শুরু করেছে পড়াশোনা। এমন ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুকে কেউ খুন করতে পারে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় শিক্ষকদের! দুই শিফটে এ স্কুল চলে। সকাল ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ১ম, ২য় শ্রেণি ও শিশু-১ শ্রেণি এবং ২য় শিফট দুপুর সোয়া ১২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ৩য়, ৪র্থ এবং ৫ম শ্রেণির ক্লাস চলে। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন এই শিক্ষিকারা। নাজমুন নাহার বলেন, ‘স্থানীয় একটি দৈনিকে আমার বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে, ছাত্রদের স্কুলে আসতে বাধা দেয়া হতো। এ ধরনের কিছুই আমি বলিনি কাউকে। আমরা অন্য গ্রাম থেকে এসে শিক্ষকতা করি। এসব জানারও কথা নয়।’ অপহরণের ৫ দিন পর গত ১৭ই ফেব্রুয়ারি সকালে গ্রামের সামান্য অদূরে ইছারবিল খালের পাশে বালুচাপা দেয়া অবস্থায় ওই শিশুদের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। গ্রামের পঞ্চায়েতের দ্বন্দ্ব ও গাছের ডাল কাটা নিয়ে বিরোধের জের শিশুদের শ্বাসরোধে হত্যা করে ঘাতকরা।( মানব জমিন)