পুলিশের বিরুদ্ধে একের পর এক নারী নির্যাতনের অভিযোগ
ডেস্ক রিপোর্টঃ পুলিশের হাতে একের পর এক নারী লাঞ্ছনার অভিযোগ যেন ক্রমেই বেড়ে চলছে। গত দুই সপ্তাহে পুলিশের বিরুদ্ধে অন্তত সাতজন নারী নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন। আর এসব ঘটনার বেশির ভাগই ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। সরাসরি মামলা করতে চাইলেও কেউ মামলা করতে পারছে না।
একটি বেসরকারি সংস্থার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ৩৭ জন নারী পুলিশ কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির অভিযোগও রয়েছে।
কয়েক দিন ধরে চাঞ্চল্যকর ঘটনার মধ্যে রয়েছে যাত্রাবাড়ী থানার ওসির হাতে দুই নারীর শ্লীলতাহানি। এ ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চলছে। সাবেক সচিবকন্যা ও গায়িকা বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে পুলিশের বিরুদ্ধে লাঞ্ছনার অভিযোগ এনে এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, ‘২০০১ সালের ঘটনা। মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করার সূত্র ধরে তৎকালীন এসআই ফখরুলের সাথে পরিচয়। আমি তখন মোহাম্মদপুরের ইস্টার্ন হাউজিংয়ে পরিবার নিয়ে থাকতাম। একদিন আমাদের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়লে মোহাম্মদপুর থানায় যাই। তখন ওই থানার উপপরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। ওই ঘটনার পর আমাদের গাড়িচালককে চাকরি থেকে বাদ দিলে সে আমাদের হুমকি দিচ্ছিল। ওই বিষয়ের সুরাহা করে দিয়েছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তারপর থেকে তিনি কারণে-অকারণে আমার বাসায় আসতেন।’ মোহাম্মদপুর ছেড়ে উত্তরা গেলেও ওই পুলিশ কর্মকর্তা পিছু ছাড়ছিলেন না দাবি করে এই নারী বলেন, ‘বারবার তিনি আমার সাথে প্রেম করতে চাইলেও আমি তাকে মেনে নিতে পারতাম না। এক সময় জোর করে তিনি আমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন।’ এখন ওই পুলিশ কর্মকর্তা সিআইডির ইন্সপেক্টর। এখনো তিনি হুমকি দিয়ে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য করছেন বলে ওই নারী অভিযোগ করেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) আদাবর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রতনকুমারের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা হয়েছে। হয়রানির শিকার বেসরকারি আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী ফারহানা আক্তার। সোমবার দুপুরে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক সালেহ উদ্দিন আহমেদের আদালতে ওই ছাত্রী মামলাটি করেন।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, রোববার বেলা ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাস শেষে বাড়ি ফেরার পথে এসআই রতনসহ দুই কনস্টেবল রিকশা থেকে নামিয়ে তাকে একটি দোকানে নিয়ে যান। এরপর ওই ছাত্রীর কাছে ২০০ পিস ইয়াবা আছে বলে দাবি করেন এসআই রতন। এ সময় ওই ছাত্রীকে নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করা হয়। এ দিকে রতনের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লবকুমার সরকার সাংবাদিকদের জানান, অভিযোগ ওঠার পর এসআই রতনকে প্রত্যাহার করে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনারের দফতরে সংযুক্ত করা হয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রাম আদালতে নারী কেলেঙ্কারির দায়ে এক পুলিশ কনেস্টবলকে বদলি করা হয়েছে। আদালত পাড়ায় পুলিশ মেসের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী নাজিম উদ্দিন নামে ওই কনেস্টবলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার ওই কনস্টবলকে বদলি করে বন্দর বিভাগে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন নগর পুলিশের উপকমিশনার (সদর) ফারুক আহমেদ। ফারুক আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আদালতে সম্ভবত কোনো সমস্যা হয়েছিল। প্রশাসনিক কারণে বদলির সুপারিশ আসার পর কনস্টেবল নাজিম উদ্দিনকে বন্দর বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
ওই নারীকে নাজিম উদ্দিন ধর্ষণ করেছেন বলে আদালত পাড়ায় খবর ছড়িয়ে পড়ে। ওই নারী বিভিন্ন জনের কাছে গিয়ে মৌখিকভাবে এ অভিযোগ করার পর নাজিমের বিরুদ্ধে তদন্ত করে পুলিশ।
গতকাল মঙ্গলবার পুলিশের হাতে বেধড়ক মারধরের শিকার কুলসুম নাহার (২৫) নামে এক অন্তঃসত্ত্বা নারী রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। রোববার চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা স্টেশনে কথাকাটাকাটির জের ধরে রেলওয়ে পুলিশ ওই অন্তঃসত্ত্বা নারীকে পিটিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরে অবস্থার অবনতি ঘটায় তাকে রামেক হাসপাতালের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। কুলসুম চাঁপাইনবাবগঞ্জের কন্দুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিকিা। তিনি আমনুরা এলাকার সাইফুল্লাহর স্ত্রী বলে জানা গেছে। তিনি বলেছেন, তার ভাই মইনুদ্দিন রোববার সকাল ৯টায় রাজশাহী স্টেশন থেকে কমিউটার ট্রেনে চড়ে আমনুরায় যান। এ সময় ট্রেনের টিটিই সুমন হোসেন আমনুরা রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে মইনুদ্দিনের কাছে টিকিট দাবি করেন। মইনুদ্দিন টিকিট দেখাতে ব্যর্থ হলে তাকে আটক করে মারধর করতে থাকে রেলওয়ে পুলিশ। আটকের খবর পেয়ে কুলসুম রেলস্টেশনে ছুটে গেলে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে রেলওয়ে পুলিশের সদস্য মোশাররফ হোসেন তার হাতে থাকা মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে কুলসুমের মাথায় আঘাত করেন। এতে মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন কুলসুম। অন্য দিকে রাজশাহী রেলওয়ে পুলিশের ওসি আকবর হোসেন দাবি করেন, ‘টিকিট না থাকার কারণে টিটিই মইনুদ্দিনকে চার্জ করলে সে উল্টো তাকে ধরে মারধর করে। এরপর রেলওয়ে পুলিশের সহযোগিতা চাইলে পুলিশ গিয়ে মইনুদ্দিনকে আটক করে। কিন্তু সে তার বোনকে মোবাইলফোনে খবর দিলে কুলসুম নাহার এসে পুলিশের ওপর চড়াও হন। তিনি পুলিশকে পায়ে থাকা স্যান্ডেল খুলে মারতে যান। এ সময় পুলিশ সদস্য মোশাররফ তার হাতে থাকা মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে ধাক্কা দিলে ওই নারী পড়ে যান। এতে তিনি আহত হন। তাকে মারধরের কোনো ঘটনা ঘটেনি।’
নারী নির্যাতন নিয়ে যখন সর্বত্র উদ্বেগ উৎকণ্ঠা তখনই পুলিশের বিরুদ্ধেও একের পর এক নারী নির্যাতনের অভিযোগ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। চলতি মাসে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলেছে, গত মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮ জন নারী, গণধর্ষণের শিকার হন চারজন ও ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় একজনকে। এই মাসে একটি শিশু ধর্ষিত হয়। নোয়াখালীতে একই সাথে দুই বোন গণধর্ষণের শিকার হন। নান্দাইলে বাসের চালক ধর্ষণ করে এক নারীকে। কমিশন এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে।
গত বৃহস্পতিবার প্রেস কাবে এক মতবিনিময় সভায় এসব ঘটনায় নারী নেত্রীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, পুলিশের হাতে নারী নির্যাতনের খুব কম ঘটনাই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। দু-একজন নারী তার নির্যাতনের প্রতিকার চাইতে গিয়ে হয়তো গণমাধ্যমের নজরে আসেন। অথবা চাঞ্চল্যকর কোনো পুলিশি নির্যাতনের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। তবে পুলিশি ভীতির কারণেই নির্যাতনের শিকার সিংহভাগ নারীই তার নির্যাতনের কথা গোপন করেন। পুলিশের কোনো সদস্যের অপরাধকে পারতপে আমলে নেয়া হয় না। কোনো পুলিশের অপরাধ দেশব্যাপী সমালোচনার সৃষ্টি করলে তখন লোকদেখানো ব্যবস্থা নেয়া হয়। অভিযুক্ত পুলিশকে কোজড বা সাময়িক বরখাস্ত করা হয়, বিভাগীয় তদন্ত হয়। যার কোনোটিই অভিযুক্ত পুলিশের অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারে না। এই বিষয়ে পুলিশের আইজির সাথে যোগাযোগের জন্য তার মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।