গ্যাসের মজুদ নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির প্রচারণা,নেপথ্যে কারণ কি?
শাইখুল হাদিস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুছ: “দেশে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাসের মজুদের অর্ধেকের বেশি ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ২৬টি গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসের মজুদ নিরূপণ করা হয়েছে ২৭.১২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ১৩.৬৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসই ব্যবহার হয়ে গেছে। অবশিষ্ট আছে মাত্র ১৩.৪৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।” গত ১৮ জানুয়ারি-২০১৫ ঈসায়ী, সোমবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পেশকৃত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উত্থাপন করা হয়েছে।
এদিকে গ্যাস সঙ্কটের প্রভাব পড়েছে খোদ রাজধানীতেই। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পাইপলাইনে গ্যাস থাকছে না। ফলে দিনে বাসাবাড়িতে চুলা জ্বলছে না। পানি পর্যন্ত গরম করা যাচ্ছে না। গভীর রাত জেগে গৃহিণীদের রান্না করতে হচ্ছে। এতে অসুস্থ হয়ে পড়ছে অনেকেই।
মহানগরীর বাসিন্দাদের এ দুর্ভোগ যেন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। প্রতি বছরই শীত এলেই এ সঙ্কট শুরু হয়, স্থায়ী হয় পুরো শীত মৌসুমজুড়ে। এ দুর্ভোগের কারণ নিয়ে বরাবরই গ্যাস খাতের সংস্থাগুলো পরস্পরকে দোষারোপ করতে দেখা যায়। যেমন গ্যাস বিতরণের সঙ্গে জড়িত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তিতাস থেকে বলা হয়- চাহিদা অনুযায়ী তাদের গ্যাস সরবরাহ করছে না পেট্রোবাংলা। আবার পেট্রোবাংলা থেকে বলা হয়, তিতাসের পাইপলাইনগুলো অনেক পুরনো এবং ব্যাসে কম থাকায় শীতকালে বর্ধিত চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা যায় না।
আসলে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ নিয়ে একধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। আসলে বলা উচিত- ‘আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে’।
কারণ বিনিয়োগকারীরা গ্যাস না পেলে হতাশা প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি যখন সরাসরি মজুদ ফুরিয়ে আসার সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রকাশ করে এবং কোনো বিকল্প দেখায় না, তখন তাকে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ছাড়া আর কী বলা যায়?
সম্প্রতি বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে বিনিয়োগকারী-ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা প্রয়োজনীয় গ্যাস না পাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছে। একইভাবে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীও বলেছে, ‘সামনে কঠিন দিন আসছে। ১৫ বছর পর দেশের গ্যাস একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যাবে…।’ (প্রথম আলো: ২৭ অক্টোবর-২০১৫ ঈসায়ী; পৃষ্ঠা ১২)
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী রাষ্ট্রের একজন দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার কথা হেলাফেলা করার নয়। তবে তার এ বক্তব্যে যথার্থতা খতিয়ে দেখা যায়। কারণ বর্তমানে গ্যাসের যে মজুদের কথা আমরা জানি, তা-ই দেশের সব গ্যাস নয়। হতে পারে না।
আসলে দেশে গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ কত, তা এখন পর্যন্ত নিরূপণই করা হয়নি। সরকার ২০০৯ সাল থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়নে প্রশংসনীয় অনেক কিছুই করেছে। কিন্তু গ্যাসের মজুদ নির্ধারণের মতো মৌলিক কিছু কাজে হাতই দেয়নি। বরং সমুদ্রসীমায় অনুসন্ধান কার্যক্রম আরো যাতে পিছিয়ে যায়, সেই পদক্ষেপ নিয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দেশের সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা লাভের জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল একটি জরিপ (মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে) চালানোর। একাজের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি কোম্পানিকে (ফ্রান্সের সø্যামবার্জার) নির্বাচন করা হয়। চলতি শুকনো মৌসুমেই (নভেম্বর-মার্চ) কোম্পানিটির কাজ শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগের প্রক্রিয়া বাতিল করে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের।
নতুন করে দরপত্র প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত শুরু করা হয়নি। এ কারণে দেশের সমুদ্রসীমায় ওই জরিপ পরিচালনা প্রায় দুই বছর পিছিয়ে গেল। দেশে যখন গ্যাসের চাহিদা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে, বর্তমান মজুদ ফুরিয়ে আসছে বলে প্রচারণা চালাচ্ছে, তখন সরকার এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলো কেন? জ্বালানি খাতের খোঁজ-খবর রাখে, এ রকম যে কেউ এখন জানে যে- সরকারের পছন্দের ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা যে বিদেশী কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে এক্ষেত্রে কাজ করছে, সেই কোম্পানি দরপত্রে অংশ নিয়েও কাজ পায়নি বিধায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
গ্যাসের মজুদ নির্ধারণের উদ্যোগ না নেয়ায় সরকার জানেই না যে- দেশে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু। এটা না জেনে জ্বালানি খাতের কোনো পরিকল্পনা করা যায় না। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, সরকার এসব না জেনেই ২৫-৩০ বছরের জন্য দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। আর এসব পরিকল্পনায় জ্বালানি খাতকে আমদানিনির্ভর করার করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকার বর্তমানে অন্ততঃ তিনটি এলএনজি প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। কয়লা আমদানির বিশাল পরিকল্পনা করা হয়েছে। তাহলে কি আমদানি বাড়ানোর জন্যই দেশের সম্পদের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ধীরগতি?
কোনো কোনো ভূ-তত্ত্ববিদের ধারণা, দেশের স্থলভাগে বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার সম্ভাবনা কম, তবে অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট অনেক গ্যাসক্ষেত্রই দেশের স্থলভাগে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু অন্য ভূ-তত্ত্ববিদদের গবেষণা মতে, ছাতকের একাংশ ও সুনেত্র অনেক বড় গ্যাসক্ষেত্র হতে পারে। এর মধ্যে ছাতকে বাপেক্স কাজ করতে চেয়েছিল। করতে দেয়া হয়নি।
তাছাড়া দেশের সমুদ্রসীমায় এখন পর্যন্ত কার্যত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরুই করা হয়নি। সেখানে তো গ্যাসক্ষেত্র পাওয়ার সম্ভাবনা আছেই। তাই আগামী ১৫ বছরের মধ্যে দেশের সব গ্যাস ফুরিয়ে যাবে- এ কথা জোর গলায় বলার সময় এখনো আসেনি।
তবুও বলা হচ্ছে, এর একটি বড় কারণ হতে পারে উচ্চমূল্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা। এর ফলে ভবিষ্যতে দেশে জ্বালানির দাম যে অনেকটাই বাড়বে এবং সেটা মেনে নেয়ার কোনো বিকল্প নেইÍএ ধারণা দেয়া।
সরকার এলএনজি আমদানি প্রকল্প বাস্তবায়নেও অনেক পিছিয়ে পড়েছে। প্রকল্পটি ২০১০ সালের। ৩ বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে (জানুয়ারি ২০১৪) ক্ষমতায় আসার পরপরই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলো, ২ বছরের মধ্যে এলএনজি আমদানি শুরু হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কার্যাদেশই দেয়া হয়নি। এখন যে অবস্থায় বিষয়টি রয়েছে, তাতে সবকিছু ঠিক মতো চললেও আরো অন্ততঃ ২ বছর লাগবে মহেশখালীতে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করতে।
সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসার ব্যাপারে যত কথা বলে থাকে, নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য অনুসন্ধান বাড়ানো এবং বিপুল পরিমাণ গ্যাসের অপচয় ও চুরি বন্ধের কথা এক বিন্দুও ভাবে না, প্রচারও করে না। দেশের ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির (সব ক’টিই সরকারি) সমন্বিত হিসাব অনুযায়ী, অপচয় ও চুরি মিলে প্রতিদিন বিফলে যাচ্ছে প্রায় ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। এটা বন্ধ করতে পারলে বর্তমান মজুদ আরো বাড়তো। সে উদ্যোগও সরকারের নেই।
মূলত, প্রাকৃতিক গ্যাসসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদের নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিতে বাপেক্সের লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানো দরকার। বাপেক্স শক্তিশালী হলে আরো বেশি অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাতে পারবে। একই সঙ্গে উৎপাদন কার্যক্রম মনিটরিং, মিয়ানমার-সংলগ্ন অফশোর ব্লকসহ সীমান্তবর্তী অনশোর ব্লকগুলোয় দ্রুততার সঙ্গে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম শুরু করলেই অভাবনীয় সফলতা পাওয়া যাবে। ইনশাআল্লাহ!