জিন-পরী তাদের হাতের মুঠোয়, তাদের রয়েছে ঐশ্বরিক ক্ষমতা!!
ডেস্ক রিপোর্ট; প্রেমে ব্যর্থতা, অবাধ্যকে বাধ্য করা, মনের মানুষকে আয়ত্তে আনা, স্বামী-স্ত্রীর অমিল, পরীক্ষায় পাস, অবাধ্য সন্তানকে বাধ্য করা, শত্রু দমন, বিদেশ যাত্রায় বাধা, ব্যবসায় ক্ষতি, বন্ধ্যত্ব- এরকম অনেক সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকেন তারা। সবই তারা করতে পারেন ঐশ্বরিক ক্ষমতায়। তাদের দাবি- জাদুটোনায় দীক্ষিত তারা। জিন-পরী তাদের হাতের মুঠোয়।
বিভিন্ন নামে পরিচিত তারা। কেউ সাধক বাবা, কেউ মুশকিলে আহসান, কেউ কেবলা হুজুর। এরকম নানা নামে পরিচিত তারা। মানুষ ঠকানোই তাদের কাজ। নানা রকমের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রচারণা চালান এই প্রতারকরা। তাদের কাছে ছুটে যান সমস্যাগ্রস্ত মানুষ। এসব মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। রাতারাতি প্রতারকদের ভাগ্য বদলাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সমস্যাগ্রস্ত মানুষগুলো আরও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। কেউ কেউ পীর-দরবেশ সেজে আড়াল করতে চান নিজেদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। পীর সেজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই নানা রকম অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন এক নারী। ঢাকার একটি শ্রেণীর কাছে এক নামেই পরিচিত তিনি। এই নারীর নাম নাজমা বেগম।
ঘনঘন আস্তানা পরিবর্তন করে এখন তার আস্তানা রাজধানীর দনিয়ার ধোলাইপাড় এলাকায়। সেখানেই প্রতিদিন জড়ো হন তার ভক্তরা। পানি পড়া, তাবিজসহ নানা তদবির করেন। অনেকের সমস্যা সমাধান হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। বিনিময়ে খুব বেশি টাকা দাবি করেন না। সমস্যার অজুহাত নিয়ে নাজমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তিনি ফোনে জানতে চান, সমস্যা কি। পূর্ব থেকেই বানানো গল্পটা তাকে জানাই আমার বাসার গৃহকর্মী হারিয়ে গেছে। জানার পরও দেখা করতে আগ্রহী না তিনি। বুঝার চেষ্টা করেন প্রতিবেদকের প্রকৃত উদ্দেশ্য। বারবার নাম-পরিচয় সম্পর্কে জানতে চান। কারণ নাজমার এই রূপকে ঘিরে আছে রহস্য। তাই সবসময়ই অচেনা কারও সঙ্গে কথা বলতে ভয় কাজ করে তার। এক পর্যায়ে বিশ্বাস করেন সমস্যাগ্রস্ত হয়েই তার দ্বারস্থ হয়েছি। জানতে চান গৃহকর্মীর নাম, মা-বাবার নাম, বয়স, কখন-কিভাবে হারিয়েছে। বলার পরেই জানান, তার সঙ্গে জিন রয়েছে। তিনি ডাকলেই জিন হাজির হয়। নাজমার নিজের কোন ক্ষমতা নেই। সবই করে জিন। জিনকে হাজির করতে অনেক কষ্ট হয় তার। অসুস্থ হয়ে যান তিনি। কয়েক দিন দুর্বল থাকে শরীর। এ জন্য জিনকে টাকা দিয়ে খুশি করতে হবে। এই টাকা তিনি নিজের কাজে ব্যয় করেন না।
নাজমা বলেন, আমি এসব টাকা মন্দিরে দিয়ে দেই। কারণ জিনটা হিন্দু।
হারিয়ে যাওয়া গৃহকর্মীর সন্ধান দিতে পারবেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, জিন পারে না এমন কোন কাজ নেই। তবে অনেক সময় মিথ্যা বলে, কাজ করতে চায় না। অর্থাৎ কাজে সফল না হলেও দোষারোপ করা যাবে না নাজমাকে। তবে প্রাথমিকভাবে তদবির করে প্রায় আধাঘণ্টা পরে তিনি জানান, গৃহকর্মী আছে। তাকে পাওয়া যাবে। বিস্তারিত জানতে হলে রাত ৮টার পরে টাকা নিয়ে যেতে বলেন তিনি। বাস্তবে এই প্রতিবেদকের বাসা থেকে কোন কর্মী হারিয়ে যায়নি। তবে নাজমার গল্পটা ভিন্ন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পাঁচ বছর ধরেই তাবিজ-কবজ, তদবিরের নামে এই প্রতারণা চালাচ্ছেন তিনি। নারী ও মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত নাজমা বেগম। পুলিশের খাতায় তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। এ পর্যন্ত একাধিকবার কারাগারে যেতে হয়েছে তাকে। এখন এসবে জড়িত নেই বলে প্রচার করছেন নিজেই। এসব ছেড়ে দিয়ে চালাচ্ছেন ‘পীর’ ব্যবসা। নাজমার সুন্দর ব্যবহার ও ভদ্র-সুন্দর চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই এই সেই নাজমা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিবির বাগিচার দুটি বাসায় রয়েছে তার অনৈতিক ব্যবসা। এমনকি মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এতে জড়িত রয়েছে রনি নামে এক যুবক। নাজমা তাকে স্বামী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততা আড়াল করতেই ‘পীর’ সেজেছেন এই নারী। আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে পটুয়াখালীর বাউফলের প্রত্যন্ত গ্রাম গোসিঙ্গা থেকে ঢাকায় পা রাখেন নাজমা ও তার এক বোন। সঙ্গে ছিলেন নাজমার প্রথম স্বামী ফারুক। ফারুকই প্রথম নাজমাকে ঠেলে দেন অনৈতিক পথে। যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, কদমতলী, ধোলাইপাড়সহ বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত নাজমার অপরাধ কর্মকাণ্ড। ফারুকের পরে অন্তত স্বামী হিসেবে অন্তত আট জন পুরুষ এসেছে তার জীবনে। বর্তমান স্বামীর নাম জানতে চাইলে নাজমা বলেন, তার নাম কামরুল হাসান রনি। পীর ব্যবসা সম্পর্কে নাজমা বলেন, কবিরাজি করে টাকা উপার্জনের ইচ্ছে। টাকা আমার কম নেই। উপার্জনের উৎস জানতে চাইলে তিনি বলেন, একসময় নাটক-ফিল্মের ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। অস্বীকার করেন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের।
একই ধরনের প্রতারক না হলেও অবাধ্যকে বাধ্য করার চ্যালেঞ্জ করে দীর্ঘদিন বাণিজ্য করে আসছেন আফসার উদ্দিন। নামের আগে সাধক হুজুরে কেবলা ইত্যাদি বিশেষণ যোগ করেন তিনি। যাত্রীবাহী বাসে বিজ্ঞাপন দেখে এই প্রতিবেদক ফোনে কথা বলেন তার সঙ্গে। সমস্যা কি জানতে চান। সমস্যার ধরন শুনেই সাক্ষাৎ করতে বলেন তিনি। জানান, শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে নেমে তাকে কল দিলেই তিনি ঠিকানা বলে দেবেন। পরদিন গত বুধবার দুপুরে শেওড়াপাড়া থেকে ফোনে যোগাযোগ করা হয় হুজুরে কেবলার সঙ্গে। রিকশায় চড়ে কাফরুল থানার ইব্রাহিমপুরে কামাল খান সড়কে যেতে বলেন তিনি। যথারীতি কামাল খান সড়কে গেলে আরও একটু ভেতরে ব্লুবার্ড কিন্ডারগার্টেনের গেইটের সামনে যেতে বলেন তিনি। অতঃপর ওই স্কুলের ৬৩৪/১ ভবনের পাঁচ তলায় গেলে দেখা মেলে তার। সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত হুজুরে কেবলা। মুখে লম্বা দাড়ি। বয়স প্রায় চল্লিশ। একটি কক্ষে নিয়ে যান। বসার পরপরই জানতে চান সমস্যা কি।
অভিন্ন সমস্যার কথা বলি তাকেও। হারানো গৃহকর্মীর নাম-ঠিকানা বলার পর তিনি বলেন তদবির করে জানাচ্ছি এই কাজ সম্ভব কি-না। হুজুরে কেবলা জানান, তদবির ছাড়া কোন কাজ করেন না তিনি। যে কাজ সম্ভব সেটাই করেন। যা সম্ভব না তা করেন না। তিনি তদবির করতে থাকেন। প্রায় এক ঘণ্টা পর তিনি জানান, গৃহকর্মী একজনের আশ্রয়ে আছে। তবে সে সহজে ফিরে আসবে না। এমনকি তার স্বজনদের কাছেও যাবে না। এতে মহাবিপদে পড়ে যেতে পারি আমি। উপায় একটাই। ত্রিমুখী নদীর পানি পড়ে গৃহকর্মী যে কক্ষে থাকতেন সেখানে ছিটাতে হবে। ওই কক্ষে জাফরান কালির লেখা একটি তাবিজ ঝুলিয়ে রাখতে হবে। সাত দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে বলে আশ্বস্ত করেন কেবলা হুজুর। এ জন্য তাকে দিতে হবে সাত হাজার এক টাকা। পরবর্তীতে টাকা নিয়ে আসবো জানিয়ে ফিরে আসি।
কথা হয় ওই বাড়ির বাসিন্দা এক নারীর সঙ্গে। তিনি জানান, প্রতিদিনই অনেক মানুষ আসা-যাওয়া করে তার কাছে। কিন্তু কেউ উপকৃত হয়েছেন কি-না জানেন না তিনি। একইভাবে পাশের ‘ভাই ভাই ইলেকট্রিক অ্যান্ড রেফ্রিজারেশন’র স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ সাগর জানান, হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে প্রতিদিনই অনেক লোকজন আসেন। কিন্তু হুজুরের কাজকর্ম সম্পর্কে কিছুই জানা নেই। তবে এই হুজুরের কাছে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন এক যুবক জানান, কয়েক মাস আগে বিজ্ঞাপন দেখে কেবলা হুজুরের কাছে যান তিনি। তার কাছ থেকে চার হাজার টাকা নিয়েছেন তিনি। মেয়েবান্ধবী তার অবাধ্য হয়ে গেছে। আগের মতো মধুর সম্পর্ক নেই তাদের। তাকে বাধ্য করার জন্যই হুজুরের সহযোগিতা চান।
আফসার জানান, সবই সম্ভব। এজন্য মাত্র দুটি তাবিজ দেবেন তিনি। ৪১ দিনের মধ্যেই তাদের সম্পর্ক অনেক মধুর ও গভীর হবে। টাকার বিনিময়ে তাবিজ নেন তিনি। একটি রাখা হয় ওই মেয়েবন্ধুর চলাচলের সড়কে অন্যটি নিজের হাতে। তারপর চলে যায় দীর্ঘ দুই মাস। সম্পর্কের উন্নতি হবে দূরে থাক। ততদিনে অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়েছে ওই মেয়ের। এবার টাকা ফেরত চান যুবক। কিন্তু হুজুর কেবলা জানিয়ে দেন টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব না। উদাহরণ হিসেবে বলেন, রোগী সুস্থ না হলে ডাক্তার কি টাকা ফেরত দেন? শুধু আফসার না। এরকম আরও অসংখ্য প্রতারক ছড়িয়ে আছেন রাজধানী জুড়ে। প্রকাশ্যেই প্রতারণা চালাচ্ছেন তারা। এসব প্রতারককে প্রায়ই গ্রেপ্তার করা হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, তারা জামিনে বের হয়ে আবার প্রতারণা শুরু করে। তবে অভিযোগ পেলেই পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানান তিনি। – মানবজমিন