সবাই নির্বিকার, বাঁচাতে এগিয়ে গেলেন বাংলাদেশি যুবক
ডেস্ক রিপোর্টঃ চলন্ত ট্রেনের হাতলটা ধরে প্ল্যাটফর্মের উপরে ছুট ছিলেন এক বৃদ্ধ। কিন্তু তাল রাখতে না পেরে প্ল্যাটফর্মে পড়েও গেলেন। দৃশ্যটা সহ্য করতে না পেরে চোখ বুজে ফেলেছিলেন স্টেশনের অনেকেই। তাদের মধ্যেই ছিলেন বাংলাদেশের বাসিন্দা বিজয়কৃষ্ণ বিশ্বাস। চোখ খুলে দেখেন, রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছেন সেই বৃদ্ধ। কেউ তাকে তুলতেও এগিয়ে যাচ্ছেন না।
বিস্ময়ের ঘোরটা কাটতেই বিজয়কৃষ্ণ ছুটে যান সে দিকে। রানাঘাট স্টেশনে তখন প্রচুর ভিড়। বেলা দুটো বাজে। বিজয়কৃষ্ণ চেঁচিয়ে বলেন, ‘এ ভাবে পড়ে থাকলে মানুষটা মরে যাবে। আপনারা একটু হাত লাগান। হাসপাতালে নিয়ে যাই।’
স্টেশনের যাত্রী, দোকানদার, ফেরিওয়ালা কেউই তাতে সাড়া দিলেন না। বরং বিজয়কৃষ্ণকে আরো অবাক করে দিয়ে তারা বললেন, ‘ছেড়ে দিন। রেল পুলিশ দেখবে।’
বিজয়কৃষ্ণ কিন্তু বুঝতে পারছিলেন, রেল পুলিশের অপেক্ষায় থাকতে হলে এই বৃদ্ধকে বাঁচানো যাবে না। তিনি তো মারা যাবেনই। সেই সঙ্গে হয়তো অসহায় হয়ে পড়বে একটি পরিবার।
তিনি তাই নিজেই ছুটে যান। ওই বৃদ্ধকে কোলে তোলেন। স্টেশনের লোক সবই দেখছিলেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেননি। এক সহযাত্রী বরং বিজয়কৃষ্ণের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে যান, ‘সরে যান। জানেন তো, পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা।’
বিজয়কৃষ্ণ বলেন, ‘কথাটা শুনে একবার যে একটু চিন্তা হয়নি তা নয়। আমি তো ভারতীয় নই। তাই কোনো কারণে আটকে গেলে দেশে ফিরতে দেরি হয়ে যেতে পারত।
কিন্তু তারপরেই ভাবলাম, আহতের কোনো দেশ হয় না। রাজনীতি আর ভূগোলিক সীমানা দিয়ে মানবিকতায় পাঁচিল তোলা উচিত নয়।’
যেমন ভাবা তেমন কাজ। ওই বৃদ্ধকে পাঁজাকোলা করে তুলে তিনি নিয়ে যাচ্ছিলেন স্টেশনের বাইরে। ইচ্ছা ছিল কোনো একটি যানবাহনে করে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাবেন তাকে। তবে ততক্ষণে চলে এসেছে রেলওয়ে পুলিশ। একটা স্ট্রেচার নিয়ে আসা হল।
কিন্তু তাতেও তো তুলতে হবে বৃদ্ধ লোকটি কে। বিজয়কৃষ্ণই এগিয়ে এলেন। ভিড়ের ভিতর থেকে এগিয়ে এলেন আরো একজন। দুজনে মিলে ধরাধরি করে বৃদ্ধকে তোলেন স্ট্রেচারে। তারপরে নিয়ে গেলেন স্টেশনের বাইরে। তোলা হল জিআরপি কর্মীদের আনা ভ্যানে। কিন্তু এ বার তৈরি হল নতুন সমস্যা।
ভ্যানে আর কেউই যে নেই। তার উপরে ওই বৃদ্ধ বিজয়কৃষ্ণের হাতটি চেপে ধরে রেখেছেন। বিজয়কৃষ্ণবাবু বলেন, ‘ওই প্রৌঢ় কথা বলতে পারছিলেন না। তার মধ্যেই কোনওমতে বললেন, “আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমি মরে গেলে সংসারটা ভেসে যাবে।” তাই তার সঙ্গেই ভ্যানে উঠে পড়ি।’ রানাঘাট হাসপাতালে পৌঁছে বিজয়কৃষ্ণই ওই বৃদ্ধকে ভর্তি করান। তার বাড়িতেও খবর পাঠান।
ওই বৃদ্ধের নাম পদ্মভূষণ ভট্টাচার্য। বাড়ি কৃষ্ণনগরের মল্লিকপাড়ায়। আগে একটি বেকারিতে কাজ করতেন। এখন ধারদেনা করে বিস্কুটের ব্যবসা শুরু করেছেন। ছেলে মাধ্যমিক দেবে। মেয়ে কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী।
তার স্ত্রী সান্ত্বনাদেবী বলেন, ‘বিজয়কৃষ্ণবাবু না থাকলে কী যে হত, ভেবে শিউরে উঠছি। উনি আমাদের পুরো সংসারটাকেই বাঁচিয়ে দিলেন।’
মঙ্গলবার রানাঘাট স্টেশনে এই ঘটনার পরে পদ্মভূষণবাবুকে কলকাতায় নীলরতন সরকার হাসপাতালে রেফার করে দেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, পদ্মভূষণবাবুর বাঁ পায়ে অস্ত্রোপচার করতে হবে।
বিজয়কৃষ্ণ বুধবার সেখানেও গিয়েছিলেন। তার বাংলাদেশ ফিরে যাওয়ার কথা ছিল বুধবারেই। তিনি জানান, চাচা অসুস্থ। তাকে কলকাতায় চিকিৎসা করাতে এনেছেন। উঠেছেন বাদকুল্লাতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। বিজয়কৃষ্ণবাবুর কথায়, ‘ভিসার মেয়াদ রয়েছে। তাই পদ্মভূষণবাবুর অস্ত্রোপচার পর্যন্ত থেকেই যাব। চাচাকেও ভাল করে ডাক্তার দেখানো হয়ে যাবে।’
বিজয়কৃষ্ণের বাড়ি বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার উলুকান্দা গ্রামে। এই বছরই মাগুরা আদর্শ কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছেন। মঙ্গলবার বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে ভারতে আসেন। বনগাঁ থেকে ট্রেনে রানাঘাট স্টেশনে জ্যাঠামশায়কে পৌঁছে দিয়ে কলকাতায় যাওয়ার কথা ছিল একটা জরুরি কাজ মেটাতে। তখনই এই ঘটনার সামনে পড়ে যান।
রানাঘাট জিআরপি থানার আইসি সুভাষ রায়ের কথায়, ‘ওই যুবক সত্যিই খুব ভাল কাজ করেছেন। তিনিই প্রথম এগিয়ে এসেছিলেন। তার পরপরই আমরাও চলে যাই।’
সুভাষবাবু বলেন, ‘ওই যুবকের দৃষ্টান্ত থেকেই মানুষ এ বার বুঝবেন যে, কোনো আহতের পাশে দাঁড়ালে তাকে হয়রানির মধ্যে পড়তে হয় না।’
রানাঘাট স্টেশনের ব্যবসায়ীদের অবশ্য দাবি, আগেও এমন দুর্ঘটনা হয়েছে, তারাও তখন এগিয়ে গিয়েছিলেন।
রেলের এই শাখায় নিত্যযাত্রী ইন্দ্রজিৎ সরকারের বক্তব্য, ‘যে কোনো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষই আগে এগিয়ে যান। সে দিন স্টেশনে যা হয়েছে তা ব্যতিক্রম।
তবে ওই যুবককে ধন্যবাদ।
তিনি বিদেশে এসেও যে ভাবে এক জনকে বাঁচালেন, তাতে বাঙালিরই নাম উজ্জ্বল হল।’
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা