জঙ্গী-জঙ্গী খেলা !
ছোট্ট বেলায় পাঠ্যক্রমে কিংবা দাদী-নানীদের মুখে মিথ্যুক রাখাল বালক এবং বাঘের গল্প আমরা প্রত্যেকেই পড়েছি কিংবা শুনেছি । তবুও গল্পের সারাংশ আরেকবার স্মরণ করে নিই । দুষ্ট রাখাল বালক বাঘ এসেছে বলে চিৎকার করে প্রতিদিন গ্রামবাসীকে হয়রান করত অথচ সে সময় বাস্তবে বাঘ আসেনি । এভাবে মিথ্যুক বালক প্রতিদিন চিৎকার করত এবং গ্রামবাসী হন্যে হয়ে দা-লাঠি নিয়ে রাখাল বালককে রক্ষা করতে ছুটে যেত । রাখল বালকের প্রত্যহ মিথ্যাচারে এক সময় গ্রামবাসী অতিষ্ঠ হয়ে গেল এবং তার কথা অবিশ্বাস করতে শুরু করল । যথারীতি, অতীতের মত সেদিনও রাখাল বালক বাঘ বাঘ বলে চিৎকার করে তাকে বাঁচাতে গ্রামবাসীকে আহ্বান করলেও গ্রামবাসী তার চিৎকারকে মিথ্যা-বানোয়াট মনে করে সেদিন আর কেউ তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে যায়নি । অথচ সেদিন বাঘ এসেছিল এবং রাখালের প্রাণ বধ করে তার রক্ত-মাংস ভক্ষণ করে বাধাহীনভাবে বাঘ আবার তার গন্তব্যেও ফিরে গিয়েছিল ।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে জঙ্গি-জঙ্গি খেলা চলছে । প্রশাসনের একপক্ষ থেকে প্রতিদিন সংবাদ সম্মেলন করে দেশে জঙ্গিদের উপস্থিতির কথা জানানো হয়েছে । কোথাও একটি পটকা বিস্ফোরিত হলেও সেটা জঙ্গীদের কাজ বলে দেশবাসীকে ভীতসন্ত্রস্থ করে রাখা হয়েছে । সমালোচকদের অনেকে মনে করেন, আন্তর্জাতিক বিশ্বের সহায়তা পেতে জঙ্গি ইস্যু দাঁড় করানো হয়েছে । বিরোধী দল-মতকে দমিয়ে রাখার জন্য আগুন সন্ত্রাস, জঙ্গী নেত্রীসহ অনেক উপমা তাদেরকে দেয়া হয়ে । জামাআ’ত-শিবিরকে জঙ্গীদের দোসর বলে বিদেশের বহু জার্নালে একাধিক নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে । আল কায়েদার নামে ফায়েদা খুঁজতে একপক্ষ সর্বদা ব্যস্তই ছিল । তালেবানের দোসরদের পাকড়াও করার জন্য দেশব্যাপী সাড়াশী অভিযান চালানো হয়েছে । আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর সর্বশেষ সংযোজন আইএস এর সদস্যরা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে বলে সর্বত্র সতর্ক সংকেত দেয়া হয়েছে । এসকল দাবীর কতটুকু সত্য কিংবা অসত্য ছিল তা স্বার্থ হাসিলের উর্ধ্বে উঠে দেশবাসী হয়ত কোনদিন নির্ধারণ করতে পারবে না তবে আন্তর্বজাতিক বিশ্বে দেশের যে সর্বনাশের ঘন্টা বেজেছে তাতে আদৌ সন্দেহ নাই ।
জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় অষ্ট্রেলিয় ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফরকে প্রায় বাতিল করেছে । তাদের পক্ষ থেকে যে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বাংলাদেশে এসেছিলেন তারা সফরের বিষয়ে স্পষ্ট কোন ইঙ্গিত না দিয়েই দেশে ফিরে গেছেন । সফর স্থগিতে এ সিদ্ধান্ত যদিও অষ্ট্রলিয় ক্রিকেট বোর্ডের নয় বরং খোদ অস্ট্রেলিয় সরকারের সতর্কতায় তারাও সতর্ক হয়েছে । সেদেশের ক্রিকেটারদের রাজ্য দলে ফিরে যাওয়ার নির্দেশের মাধ্যমেই বোঝা যায় যে তাদের বাংলাদেশ সফর স্থগিত । তবে আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু সমাধান হওয়া অসম্ভব নয় । তাই ক্রিকেট পাগল জাতির একজন সদস্য হিসেবে আমি এখনো মনে-প্রাণে আশা করি অষ্ট্রেলিয় দল বাংলাদেশ সফরে আসবে । সর্বশেষ গুলসানে ইতালীয় নাগরিককে গুলি করে হত্যার ঘটনা দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে । দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বেষ্টনীতে যে অঞ্চলটি ঢাকা থাকে সেই স্থানে একজন বিদেশী নাগরিককে গুলি করে সন্ত্রাসীরা কিংবা জঙ্গীরা অপ্রতিরোধ্যভাবে পালিয়ে যেতে পারে এটা প্রায় অবিশ্বাস্য । অথচ অবিশ্বাস্য ঘটনাই আজ সমগ্র সত্ত্বা দিয়ে বিশ্বাস করতে হচ্ছে । দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়-ই মানুষ খুন হয় কিন্তু যখনই কোন ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগার খুন হয় তখন দেশময় হই চই সৃষ্টি হয় এবং যথারীতি আল কায়েদা, তালেবান কিংবা আইএস এ হত্যার দায় স্বীকার করে ! তাদের এ দায় স্বীকার কতটুকু সত্য কিংবা এর পেছনে কোন ষড়যন্ত্র আছে কিনা তার সুষ্ঠু তদন্ত হয়ে প্রকৃত অপরাধীরা খুবই কমই গ্রেফতার হয় এবং শাস্তি পায় ।
যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের স্বার্থে সৃষ্ট আইএস এর জঙ্গীরা যেহেতু ভারতকে টার্গেট করে বিভিন্ন সময় বিবৃতি দিচ্ছে কাজেই বাংলাদেশও হুমকির বাইরে নয় । জঙ্গীদের কবল থেকে এদেশকে রক্ষা করতে হলে সর্বাগ্রে দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা আবশ্যক । আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দলগুলো যদি জঙ্গিবাদ নিয়ে পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকে তবে বিদেশী জঙ্গীরা আমাদের দেশের অভ্যন্তরে শক্ত ঘাঁটি সৃষ্টির সুযোগ পেয়ে যাবে । কোন রাজনৈতিক দল যদি মনে করে, তারা বিছ্ন্নিভাবে জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দেশকে জঙ্গীমুক্ত করবে এবং বিদশী পরাশক্তির করুণা পাবে, তবে তাদের ধারণা সঠিক কিনা সেটা নতুন করে বিবেচনা করা উচিত । এক কালের নাম সর্বস্ব আল কায়েদা পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিধর আমেরিকাকে কম ঝাঁকুনি দেয়নি । বিশ্বের প্রায় প্রতিটি শক্তিধর রাষ্ট্র উগ্রপন্থীদের আচমকা আক্রমনের ভয়ে সর্বসময় তটস্থ থাকে । সেখানে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে বিদেশীদের দয়া ও আমাদের বিচ্ছিন্ন অবস্থান কতটা ফলপ্রসু হবে তা ভেবে দেখা দরকার ।
পাকিস্তানের শোষণ থেকে আমরা বড় মূখ করে স্বাধীন হয়ে একটি সোনার দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে স্বপ্ন বুনেছি । সেই স্বপ্ন যাওয়ার পূর্বে আমাদের মরণও তার চেয়ে উত্তম হবে । পাকিস্তান কার্যত এখন ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় শীর্ষের দিকে অবস্থান করে । এ দেশের দেশপ্রেমিক কোন মানুষ কামনা করেনা, জঙ্গিবাদ কিংবা অন্যকোন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কবলে পড়ে সোনার দেশটা ধ্বংস হয়ে যাক । কাজেই দেশ রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ জরুরী । আমাদের নিজেদের দূরত্বের সুযোগ নিয়ে কোন অমঙ্গলীয় গোষ্ঠী যদি একবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ পায় তবে তাদের দমনের সামর্থ্য রাষ্ট্রের কতটুকু রয়েছে তাও ভাবনায় রাখা উচিত । রাখাল বালকের পরিণতি যদি আমাদেরও বরণ করতে হয় তবে সেটা আমাদের ব্যর্থতার ইতিহাস হিসেবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানবে এবং আমাদের প্রতি থুতু নিক্ষেপ করে তাদের ঘৃণার জানান দিবে । রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব শক্তির সুরক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার চেয়ে সাধারণ মানুষের কাতারে দাঁড়ানো অনেক ভালো । বর্তমান সংকট কাটাতে ঐক্যের বিপরীত কিছু আছে বলে মনে হয়না । আমাদের দেশে যখন বিদেশী নাগরিকরা প্রাণের নিরাপত্তা নিয়ে বিচরণ করতে না পারে তখন আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত । কান বধির হয়ে যাওয়া উচিত যখন বিদেশীদের মুখে শুনতে হয় বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে এবং তারা এ আশঙ্কার কথা জানিয়ে এ দেশে অবস্থানরত তাদের নাগরিকদের এদেশে সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশ দেয় । স্বার্থ হাসিলের জঙ্গি-জঙ্গি খেলা বন্ধ হয়ে যেন প্রকৃত জঙ্গিদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয় এবং তাদের আশ্রয়দাতা ও মদদদাতাদের মুখোশ জাতির সামনে উম্মোচন করে দেয়া হয় । সকল ক্ষেত্রের উগ্রপন্থীদের কিভাবে দমন করা যায় তার ব্যবস্থা গ্রহন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তবে তা হতে হবে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে ও নিরপেক্ষভাবে । কারো জিঘাংসা হাসিলের জন্য জঙ্গি ইস্যু ব্যবহারের মানসিকতা ত্যাগ করে এবার রাষ্ট্রের স্বার্থে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহন করা সময়ের সবচেয়ে বড় দাবী ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
facebook.com/rajucolumnist/