বাঘের থাবায় ক্ষত-বিক্ষত ভারত
সুরমা টাইমস ডেস্কঃ ছেলেটার বাড়ী একেবারে সুন্দরবনের কোলঘেঁষা। অতীতে পূর্বপুরুষের কেউ সুন্দরবনের পাকা শিকারী ছিল কি না জানা নেই; কিন্তু মিরপুরের শেরে-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সত্যিকারের ‘শের’ হয়ে যে হুঙ্কার ছেড়েছেন মুস্তাফিজুর রহমান, তাতেই প্রকম্পিত পুরো ‘মহাভারত’।
রনাঙ্গনে মুস্তাফিজ নতুন হতে পারেন, কিন্তু মহেন্দ্র সিং ধোনি অ্যান্ড কোংকে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি পাকা খেলোয়াড়। যে ব্যাটিং নিয়ে গর্বের অন্ত নেই ভারতীয়দের, সেটাকে কিভাবে এক ফুৎকারে তাসের ঘরের মত উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, অভিষেকের দুই ম্যাচে ১১ উইকেট তুলে নিয়ে সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন সদ্য কৈশোর পেরুনো সাতক্ষীরার ছেলেটি।
প্রথম ম্যাচে ৭৯ রানে ভারতীয়দের বিধ্বস্ত করার পর বাংলাদেশের এক ইংরেজি দৈনিকের শিরোনাম, ‘ওয়েলকাম টু দ্য জাঙ্গল।’ একেবারেই যথার্থ। বাংলাদেশ যেন এখন পুরোপুরি বাঘের ডেরা। এখানে প্রবেশ করার অর্থই হলো ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ফিরে যেতে হবে। পাকিস্তান গিয়েছে, এবার একইভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ফেরার জন্য প্রস্তুত ধোনি বাহিনী।
প্রথম ওয়ানডেতে মহেন্দ্র সিং ধোনি চেয়েছিলেন কাঁধের ধাক্কায় মুস্তাফিজ ছেলেটাকে শেষ করে দিতে। যেমনি তার দেশের বোর্ড কর্তারা শেষ করে দিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের সুনিল নারিন, পাকিস্তানের সাঈদ আজমলের মত স্পিনারকে। ওখানে কুট কৌশলে। আর এখানে শারীরিক শক্তি দিয়ে। কিন্তু; সেই মুস্তাফিজ ওই ম্যাচেই মাঠে ফিরেই এক ধাক্কায় বের করে দিলেন ধোনির দলকে।
দ্বিতীয় ম্যাচে টস জিতে ধোনি চেয়েছিলেন বিরাট ব্যাটিং লাইনআপ দিয়ে রান বন্যায় ভাসাবেন বাংলাদেশকে। প্রথম ম্যাচে পরাজয়ের প্রতিশোধ কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে নেবেন। কিন্তু মুস্তাফিজ তো আর এমনি এমনি দলে সুযোগ করে নেয়নি! যোগ্যতা দিয়েই এসেছে। ভারতকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই এসেছে। যে কারণে বাঁ-হাতি এই পেসারের গতির আগুনে থর থর করে কাঁপা শুরু হলো তথাকথিত বিশ্বখ্যাত ব্যাটিং লাইনআপের।
দ্বিতীয় বলেই তার স্লোয়ারে বিভ্রান্ত হয়ে ক্যাচ দিলেন পয়েন্টে। ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা তালুবন্দী করলেন সাব্বির। বিরাট কোহলি নাসিসের ঘূর্ণি বুঝতে না পেরে আউট হলেন। এরপর ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন এনে মাঠে নামলেন ধোনি।
সেই ধোনিই যখন বিপজ্জনক হয়ে উঠছিলেন, তখন তরুণ মুস্তাফিজের স্লোয়ারে বোকা বনে গেলেন। ক্যাচ তুলে দিলেন কাভার অঞ্চলে, সৌম্য সরকারের হাতে।
মুস্তাফিজ থেমে থাকলেন না। একে একে মিরপুরের বাইশ গজে রচনা করে গেলেন নতুন ইতিহাস, নতুন মাইলফলক। মাত্র ৪৩ রান দিয়ে তুলে নিলেন ৬ ভারতীয় ব্যাটসম্যানের প্রান।
বিস্ময়কর এই প্রতিভা দেখে তো অবাক পুরো ভারতবর্ষ। যারা দাদাগিরি করতে বেশি ভালবাসে। যাদের মোড়লিপনায় বন্দী পুরো ক্রিকেট বিশ্ব, তাদের মাত্র ১৯ বছর বয়সী এক তরুণের হাতে এভাবে নাকানি-চুবানি খেতে হবে- তা কষ্মিনকালেও কী তারা ভাবতে পেরেছিল!
প্রথম ম্যাচে হারের পর ধোনিদের মধ্যে হতাশার মাত্রা এতটাই ঝেঁেক বসেছিল যে, তারা রাতের খাবার না খেয়েই হোটেলে ফিরে গিয়েছিল। পরের দুই দিন করেছে কঠোর অনুশীলন। টিম ডিরেক্টর রবি শাস্ত্রী সরাসরি ক্রিকেটারদের ডেকে বলে দিয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশকে আর সমীহ করা চলবে না। সমীহ করে করে তাদের মাথায় তুলে নেওয়া হয়েছে। আক্রমণাত্মক খেলতে হবে এবং যে করেই হোক ভারতকে সিরিজে ফিরিয়ে আনতে হবে।’
সিরিজে ঘুরে দাঁড়ানোর যাবতীয় প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা করেই রোববার মিরপুরে মাশরাফির সাথে টস করতে নেমেছিলেন অধিনায়ক ধোনি। টস জিতে ব্যাটও নিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ যে সত্যি সত্যি পরিবর্তণ হয়ে গেছে, তা বুঝতে এই ম্যাচেও হারা প্রয়োজন ছিল ধোনির।
সেই পরিবর্তিত বাংলাদেশকেই প্রতিটি বল আর প্রতি ক্ষণে অবলোকন করলো ধোনি-কোহলিরা। মুস্তাফিজের সঙ্গে তাসকিন, রুবেল এমনকি অধিনায়ক মাশরাফি যেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের সামনে মুর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হলেন। এই চার পেসারের সঙ্গে রয়েছেন সাকিব আল হাসানও। ৪৫ ওভারেই মাত্র ২০০ রানে যাদের অলআউট হতে হয়েছিল।
জবাবে ব্যাট করতে নেমে তামিম আর সৌম্যের স্পিরিটে ভর করেই মূলতঃ জয়ের ভিত রচনা করে বাংলাদেশ। সাকিব ছাড়া খুব বড় ইনিংস হয়তো কেই খেলতে পারেননি। সাকিব অপরাজিত থাকেন ৫১ রানে। এছাড়া সৌম্য, লিটন, মুশফিক, নাসিররাও কম করেননি। একেকটা যেন ক্যমিও ইনিংস। শেষ পর্যন্ত ৫৪ বল হাতে রেখেই জয় পেয়ে যায় বাংলাদেশ।
ভারতের ক্রিকেটীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্কাররা হয়তো ইতিমধ্যে হিসেব-নিকেশ করতে বসে গেছেন। কোন যাদুর স্পর্শে এমন পরিবর্তিত বাংলাদেশ! বাংলাদেশের কাছে অপ্রত্যাশিত এবং অভাবনীয়ভাবে ভারতকে হেরে যেতে হলো।