গৃহবধূকে গাছে বেঁধে সেনা সদস্যের মধ্যযুগীয় নির্যাতন
পুলিশ সুপারের ঘটনাস্থল পরিদর্শন
আবদুস সাত্তার, নড়াইলঃ ববিতা নামের এক গৃহবধূকে গাছের সঙ্গে বেঁধে মধ্যযুগীয় কায়দায় অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে গৃহবধূর স্বামী সিলেট ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত সেনাসদস্য শফিকুল ও তার পরিবারের সদস্যরা।
গৃহবধূ ববিতা বর্তমানে নড়াইল সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনার পাঁচ দিন পর লোহাগড়া থানা পুলিশ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা গ্রহণ করেছে। সরেজমিন বুধবার সকালে অভিযুক্ত স্বামী শফিকুলের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা-মা ও পরিবারের কোনো সদস্যকে পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের শালবরাত গ্রামের ছালাম শেখের ছেলে সেনা সদস্য শফিকুল শেখের সঙ্গে পাশের এড়েন্দা গ্রামের ইসমাইল মোল্যার মেয়ে নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী (প্রাইভেট) ববিতার (২১) প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। ওই সম্পর্কের জের ধরে ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর ইসলামী শরিয়া মোতাবেক গোপনে তাদের বিয়ে হয় (রেজিস্ট্রি ২২ নভেম্বর)। বিয়ের কিছুদিন পর ববিতার স্বামী সিলেট সেনানিবাসের ৩৮ বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত সদস্য শফিকুল শেখ ও শাশুড়ি তাকে ঘরে তুলে নেবে না বলে টালবাহানা শুরু করে। শফিকুলও ববিতার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে ববিতা একপর্যায়ে হতাশ হয়ে পড়ে। পরে তিনি বাধ্য হয়ে আদালতের শরণাপন্ন হন। এতে শফিকুল ও তার পরিবারের সদস্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।
নির্যাতিত ববিতার মা খাদিজা বেগম জানান, ২৯ এপ্রিল ববিতার স্বামী শফিকুল বাড়িতে আসে এবং ববিতাকে স্বামীর বাড়িতে যাওয়া জন্য খবর দেয়। সব সমস্যার মীমাংসা করা হবে বলেও জানানো হয়। ববিতা খুশি হয়ে রাতেই স্বামীর বাড়িতে যান। পরের দিন (৩০ এপ্রিল) সকাল ৭টার দিকে ববিতার স্বামী শফিকুল, ভাসুর হাসান শেখ, শ্বশুর ছালাম শেখ, শাশুড়ি জিরিন আক্তার, চাচা শ্বশুর কালাম শেখ, প্রতিবেশী নান্নু শেখ এবং পাশের পদ্মবিলা গ্রামের আজিজুর রহমান আরজু মিলে ববিতাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক লাঠিপেটা করে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে পাশবিক নির্যাতন চালানোর একপর্যায়ে ববিতা অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তাকে বাজারে নিয়ে একটি দোকানে আটকে রাখা হয়। খবর পেয়ে লোহাগড়া থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।
তিনি আরও জানান, ববিতাকে প্রথমে লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে তাকে নড়াইল সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
তিনি অভিযোগ করেন, সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়ায় শফিকুলের বিরুদ্ধে এলাকায় কেউ কথা বলতে সাহস করে না। এ কারণে চরম নির্যাতনের পরও কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। পুলিশও প্রথম প্রথম বিষয়টি এড়িয়ে যায়। পরে নির্যাতনের ছবি ছড়িয়ে পড়লে সকলের টনক নড়ে। বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে শফিকুল তাদের হুমকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
নির্যাতনের ওই ঘটনার পাঁচ দিন পরও স্থানীয় থানা পুলিশের পক্ষে তেমন কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। একপর্যায়ে নির্যাতনের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশিত হলে সর্বত্র তোলপাড় শুরু হয়।
পুলিশ মঙ্গলবার (৫ মে) বাধ্য হয় মামলা গ্রহণ করতে। ববিতার মা খাদিজা বেগম বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলাটি করেন (মামলা নং-০৭)।
এদিকে, বুধবার সকালে সরেজমিন শফিকুলের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা-মা, ভাই, চাচাসহ পরিবারের তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। বাড়িতে থাকা ববিতার স্বামী শফিকুলের ভাবী রুনা খানম জানান, সবাই বেড়াতে গিয়েছে। নির্যাতনের বিষয়ে তিনি জানান, ববিতাকে সামান্য মারা হয়েছিল।
লোহাগড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. লুৎফর রহমান জানান, ওই ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা হয়েছে। এজাহারভুক্ত আসামি নির্যাতনকারী শফিকুলের ভাই হাসানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে।
বিভিন্ন পত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদনসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে খবরটি প্রকাশিত হওয়ায় নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন। খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠন ভুক্তভোগী গৃহবধূ ববিতার খোঁজখবর নেওয়া শুরু করে। নড়াইলের পুলিশ সুপার (এসপি) সরদার রকিবুল ইসলাম বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘটনাস্থল শালবরাত গ্রামের শফিকুল ইসলামের বাড়ি পরিদর্শন করেন।
এদিকে, নির্যাতিত ববিতা ১৬৪ ধারায় জেলার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আরিফুল ইসলামের কাছে বৃহস্পতিবার বিকেলে জবানবন্দী দিয়েছেন।