হাকালুকিতে শীতের অতিথিদের আগমন; মুখরিত হচ্ছে মাষ্টার বাড়ি
এমদাদুল হক, মৌলভীবাজারঃ শীত আসছে আসছে করে এসেই গেল। শীতের বুড়িটা কোনো কোনো এলাকায় জেঁকে বসার প্রস্তুতিও নিচ্ছে জোরে শোরে। শীতের আগমনের পদধ্বনিতে প্রকৃতি সেজে উঠেছে নতুন আমেজে। প্রকৃতির এ রূপটাকে বাড়িয়ে দিতে প্রতি বছর এই শীতে আসে অতিথিরা। এসে আমাদের মনকে আরো রাঙিয়ে তোলে নতুন ছন্দে। হ্যাঁ, এরা হলো আমাদের শীতের অতিথি। শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে দণি এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকিতে ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে অতিথি পাখির দল। হাওরের পাশা পাশি হাকালুকির হাল্লা গ্রামের মনোহর আলী মাস্টারের পতিত বাড়িও এখন মুখরিত অতিথি পাখির কলকাকলিতে। শীত মৌসুম ছাড়াও হাল্লা গ্রামের মনোহর আলী মাস্টারের পতিত বাড়িটি বছর জুড়েই পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে। তবে শীতের আগমনী বার্তার সাথে সাথে পাখির সমাগমও বৃদ্ধি পায়। হাজার হাজার পাখির আগমনে পুরো এলাকা পাখির রাজ্যে পরিনত হয়। সন্ধ্যা নামার সাথে হাকালুকি হাওরের বিভিন্ন বিল জলাশয় থেকে পাখিরা এসে আশ্রয় নেয় মনোহর আলীর পতিত বাড়ীর গাছ গাছালিতে। ভোর হলেই পুনরায় পাখিরা চলে যায় খাবারের সন্ধানে হাওরের বিভিন্ন বিল বাদাড়ে। এ পাখি বাড়ির অবস্থান বড়লেখা শহর থেকে প্রায় ১৫কিলোমিটার পশ্চিমে হাল্লা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় লাগোয়া। দেশের যে কয়টি স্থানে অতিথি পাখির সমাগম ঘটে তার মধ্যে হাকালুকি হাওর অন্যতম। অতিথি পাখির সর্ববৃহৎ এই সমাগমস্থলে প্রতি বছর পুরো শীত মৌসুম হাওরে বিচরণ করে পাখিরা আবার গরমের শুরুতেই তারা ফিরে যায় স্ব-স্ব আবাসস্থলে। প্রতি বছর শীতের শুরুতে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আমাদের এই সবুজ-সুন্দর দেশে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে রং বাহারি অতিথি পাখি। প্রচ- শীতের দেশ সুদূর সাইবেরিয়া। পাখিরা সেই সাইবেরিয়ায় শীতের হাত থেকে রেহাই পেতে অভয়াশ্রম হিসেবে বেছে নেয় আমাদের এই বাংলাদেশকে। এদেশের নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় এরা যেন খুব ভালোবাসে। এগুলো যেন সুদীর্ঘকাল ধরে পরিচিত তাদের। সাইবেরিয়াতে এই দিনে হিমবাহের তীব্রতা এতোই বেশি থাকে যে, সারা দিন বরফের আস্তরণে ঢাকা থাকে মাঠ-ঘাট, থাকে না এদের সামান্যতম আশ্রয়স্থল। তাই নিতান্তই জীবনের সন্ধানে ওরা কান্তিহীনভাবে দলে দলে উড়ে আসে আমাদের দেশে। যেসব অতিথি পাখি আমাদের দেশে আসে তাদের অনেকের নামই আমাদের জানা নেই।
জানা গেছে, পাখি বিজ্ঞানীরা একটা পরিসংখ্যান করে দেখেছেন, প্রায় ৪০ প্রজাতির পাখি প্রতি বছর আমাদের দেশে আসে। এদের পেয়ে আমাদের দেশের প্রকৃতিও যেন পায় নতুন বন্ধু। ওরা এলে এখানের হাওর-বাঁওড় হেসে ওঠে উৎসবের আনন্দে। হাজার হাজার পাখির নানা রকমের মধুর কলকাকলিতে আকাশ-বাতাস যেন ছন্দে দোলে। এসব পাখি বিচরণ করে মুক্ত জলাশয় গুলোতে। বেশিরভাগ পাখিই পানির উপর ভেসে বেড়ায়, কিছু কিছু আবার গাছ গাছালির ডালে ডালে উড়ে বেড়ায়। সেসব পাখি পানির উপর ভেসে বেড়ায় সেগুলো পানির ঢেউয়ের তালে তালে দুলতে থাকে। কী সুন্দর ও মনলোভা দৃশ্য দেখে মন হারিয়ে যায় একপলকে। শীতের প্রকোপ যতোই বাড়তে থাকে, অতিথি পাখি আসার সংখ্যাও বাড়তে থাকে সমানতালে। এরা এসে ডুব দেয় জলাশয় ও নদী-নালার স্বচ্ছ পানিতে। খাবার হিসেবে খুঁজে নেয় ছোট-বড় মাছ এবং কীটপতঙ্গ। পাখিরা আপন মনে চিউচিউ, কককক, টুকটুক বিচিত্র রকমের ছন্দের শব্দে ডেকে ছন্দমধুর পরিবেশ তৈরি করে। সব রকমের পাখির নাম জানা না থাকলেও বেশ ক’টি পাখি আমাদের বেশ পরিচিত। যেমন শড়ালি, চুটকি, ফুটকি ও লেঙ্গা ইত্যাদি। প্রতি বছর পাখি বিজ্ঞানীরাও এদের পেয়ে মেতে ওঠে পাখি গবেষণায়। প্রতি বছর আমাদের হাকালুকি হাওর থাকে অতিথি পাখির দখলে। পাখিপ্রেমীরা এ সময়কে হাতছাড়া করে না। অনেক শিকারীও আবার এদের পেয়ে মত্ত হয়ে ওঠে। এক শ্রেণীর অসাধু পাখি শিকারি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছিটানো বিষটোপ আর পাতানো ফাঁদে ধরা পড়ে হাজার হাজার অতিথি পাখি। ফলে প্রতি বছরই অতিথি পাখির সমাগম হ্রাস পাচ্ছে। বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির দেশি-বিদেশি পাখি। পাখি শিকারিচক্র আগ্নেআস্ত্র দিয়ে শিকার ছাড়াও ধানের সাথে বিষ মিশিয়ে বিলের পারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়ে ওৎপেতে বসে থাকে। আর এসব বিষাক্ত খাবার খেয়ে শত শত অতিথি পাখি চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলে। তখন শিকারিরা এ সকল পাখি ধরে বিভিন্ন হাট-বাজারের হোটেল-রেঁস্তোরা ও বাসা-বাড়িতে বিক্রি করে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়। হাওর এলাকার বিলগুলোতে অবাধে পাখি শিকার করা হলেও প্রশাসনের তেমন কোনো তৎপরতা ল্য করা যায় না। এমনকি প্রশাসনিক অনেক কর্মকর্তার বাসা-বাড়িতেও শীতের এসব মারা পাখি উপঢৌকন হিসেবে যায় বলেও সূত্র জানিয়েছে। স্থানীয় একটি সংঘবদ্ধ শিকারি চক্র প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে হাওরখাল, চাতলা, তুরল, নাগুয়া, ফুয়ালা, চিনাউরা, পলোভাঙ্গা, ধলিয়া, পিংলাসহ বিভিন্ন বিলে বিষটোপ দিয়ে পাখি শিকারে নেমে পড়ে। ভোররাতের দিকে পাখি নিয়ে ফেরার সময় অতিরিক্ত পাখি বয়ে আনতে না পারায় কাঁদামাটির নিচে চাপা দিয়ে রাখে যাতে কেউ না দেখে। এক শ্রেণীর অসাধু শিকারি বিষটোপে অতিথি পাখি নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে প্রতিদিনই। অভিযোগ রয়েছে, বিলের পাহারাদারের সাথে আঁতাত করে শিকারিরা অবাধে পাখি নিধন করছে। কিছু বিলে অতিথি পাখি নামলেও বিষটোপ দিয়ে নির্বিচারে চলছে পাখি শিকার। এসব দেখার যেনো কেউ নেই। যাদের দেখার কথা সেই প্রশাসনও নির্বিকার।
তারপরও বিলুপ্ত প্রায় পাখি থেকে শুরু করে দেশি জাতের অনেক পাখি সেখানে প্রতি শীতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যায়। সেগুলোকেও যদি রা না করা হয় তবে এ ব্যর্থতার দায় স্থানীয় প্রশাসনের। এরা আমাদের প্রকৃতির অতিথি, আমাদের প্রিয় অতিথি। আমরা যেন সবাই এদের সঙ্গে অতিথির মতো ব্যবহার করি।