ইতিহাস বিকৃতকারীদের থাবায় ইতিহাসে নেই জকিগঞ্জ প্রথম মুক্তাঞ্চল

আজ জকিগঞ্জ মুক্তদিবস

Hasib Tafaderআল হাছিব তাপাদার: স্বাধীনতার ৪৪ বছর, ইতিহাস বিকৃতকারীরা ধরাছোয়ার বাইরে রয়ে গেল। বাংলাদেশ ডিজিটালের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর অনেক নতুন কিছু বই পত্রে সংযোজন করা হয়। কিন্তুু একুশে নভেম্বর জকিগঞ্জ বাংলার প্রথম মুক্তাঞ্চল সেটা ইতিহাসে সংযোজন করা হয়না। আজ ভয়াল ২১ নভেম্বর বাংলার পূর্ব দক্ষিন সীমান্তের উপজেলা জকিগঞ্জ শত্র“ মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালে পাকিস্থানি বাহীনির কাছে বিজয়ী হলেও ৭১ পরবর্ত্বী ইতিহাস বিকৃতকারীদের কাছে পরাজিত জকিগঞ্জবাসী। ইতিহাস বিকৃতকারীদের কালো থাবায় পড়ে ইতিহাস থেকে মুছে গেছে জকিগঞ্জ বাংলার প্রথম মুক্তাঞ্চল। জাতির সূর্য সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা আজ ইতিহাস বিকৃত করতে অংশ নিচ্ছে। তাঁরা যেভাবে ইতিহাস বিকৃতর মত জঘন্য কাজে ব্যস্ত তখনি মনে প্রশ্ন আসে তাদের কাছ থেকে নতুন প্রজন্ম কি আশা করতে পারে? নিশ্চয় ইতিহাস বিকৃত করার শিক্ষা! ৭১ সালে ঐ দিনে পাক বাহীনি সারাদেশে যখন রাজাকার, আল বদর, আল শামস, খনতি বাহীনি তৈরি করে তান্ডব অব্যাহত রেখেছিল তখন জকিগঞ্জ হানাদার বাহীনি মুক্ত ছিল। ২১ নভেম্বর জকিগঞ্জের ইতিহাসে এক স্মরণিয় দিন। একাত্তরের এই দিনে জকিগঞ্জ মৃত্যুর মিছিলগুনে হানাদারমুক্ত হয়। এই দিন যখন সারাদেশে পাকিস্থানি বর্বর রক্তপিপাসু বাহীনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছিল তখন সিলেটের জকিগঞ্জ থানায় ১২ ঘন্টা শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে দিয়ে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় অসংখ্য আহত নিহতদের মধ্যেদিয়ে জকিগঞ্জ থানা সদর সহ আশপাশ এলাকা হানাদার মুক্ত করা হয়। জকিগঞ্জকে হানাদার মুক্ত করার মিশন নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর মেজর চমন লাল জকিগঞ্জ কাস্টমঘাটের দিকে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় পাক বাহিনীর বুলেটে প্রান হারান। মুক্তিযুদ্ধে জকিগঞ্জ ছিল ৪ নং সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত। অধিনায়ক ছিলেন তৎকালীন মেজর চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সিআর দত্ত)। সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত দেওয়ান ফরিদ গাজী এমপি ছিলেন এই সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা। ৬টি সাব সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর চিত্ত রঞ্জন দত্ত (সিআর দত্ত)। মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী ৩ এপ্রিল ভারতের করিমগঞ্জে গিযে সেখানকার ডিসি, এসপিসহ আসাম সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশী শরনার্থীদের থাকা খাওয়া ও যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবস্থা করেন।

মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হাজী খলিল উদ্দিন ও আকরাম আলী জানান, একাত্তরে বিরাংঙ্গনের নেতৃবৃন্দ সিন্ধান্ত নেন ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই জকিগঞ্জকে মুক্ত করতে হবে। সে মতে একাত্তরের ২৭ মার্চ জকিগঞ্জ ডাক বাংলোয় এক গোপনীয় বৈঠকে থানার সকল ইপিআর ক্যাম্পের পাক সেনাদের খতমের সিদ্ধা›ত হয়। ২৮ মার্চ বীর মুক্তিযোদ্ধা মেকাই মিয়া, চুনু মিয়া, আসাইদ আলী, ওয়াতির মিয়া, তজমিল আলী, মশুর আলী, হাবিলদার খুরশিদ, করনিক আবদুল ওয়াহাব, সিগনালম্যান আবদুল মোতালেব প্রমুখ প্রথমে জকিগঞ্জ ও মানিকপুর ইপিআর ক্যাম্পে অপারেশন চালিয়ে পাক সেনাদের খতম করে জকিগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন।
সাবেক এমপি মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী, এমএলএ আবদুল লতিফ, এমএলএ আব্দুর রহিম, সেক্টর কমান্ডার চিত্ত রঞ্জন দত্ত, মিত্র বাহিনীর দায়িত্ব প্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার ওয়াটকে, কর্নেল বাগচি সহ ভারতের মাছিমপুর ক্যান্টলম্যান্টে জকিগঞ্জকে স্বাধীন করার এক পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়। ঐ পরিকল্পনা ছিল কিভাবে কুশিয়ারার ওপারে ভারতের করিমগঞ্জের মানুষকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে জকিগঞ্জ দখল করা যায় এবং এ পরিকল্পনা মতই জকিগঞ্জ মুক্ত হয়। আক্রমনের পূর্বে অন্য কেউ এমনকি অনেক মুক্তিযোদ্ধারাও এ ব্যাপারে জানতেন না। এর নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যে সাবেক এমপি দেওয়ান ফরিদ গাজী, তৎকালীন এমপি আব্দুল লতিফ, ইসমত চৌধুরী ও আব্দুল মুয়িদ চৌধুরী প্রমূখ।
জকিগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পরে প্রথম আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার ভারতের বিহার প্রদেশের চাকুলিয়ায় বিশেষ প্রশিক্ষন প্রাপ্ত জকিগঞ্জের কৃতি সন্তান সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ বলেন, সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জকে মুক্ত করার পরিকল্পনা অনুসারে ২০ নভেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে প্রথম দল লোহার মহলের দিকে ও দ্বিতীয় দল আমলসীদের দিকে অগ্রসর হয়। মূল দল জকিগঞ্জের কাষ্টমঘাট বরাবর করিমগঞ্জ কাষ্টম ঘাটে অবস্থান নেয়। প্রথম ও দ্বিতীয় দল নিজ নিজ অবস্থান থেকে কুশিয়ারা নদী অতিক্রম করে জকিগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। পাক বাহিনী খবর পেয়ে দিকবিধিক ছুটাছুটি শুরু করে বর্বর পাক বাহিনী। মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে ভেবে তারা আটগ্রাম-জকিগঞ্জ সড়ক দিয়ে পালাতে থাকে এরইমধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় দল ভারত থেকে জকিগঞ্জে পৌছে যায়। মুল দল কুশিয়ারা নদীতে সেতু তৈরী করে জকিগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। তখন জকিগঞ্জ কাস্টমঘাটের নদীরচরে পাক সেনাদের বুলেটে শহীদ হন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর মেজর চমন লাল ও তার দুই সহযোগী । এ সময় কয়েকজন পাক সেনাকে আটক করা হয়। এভাবেই মুক্ত হয় জকিগঞ্জ । ২০ নভেম্বর রাতে যৌথ বাহিনীর এক সাঁড়াশি অভিযানের ফলে ২১ নভেম্বর ভোরে মুক্ত হয় জকিগঞ্জ।
একুশে নভেম্বর ভোরে জকিগঞ্জের মাটিতেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। এসময় পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক আটকৃত বন্দীদের জকিগঞ্জ থানা থেকে মুক্ত করা হয়। পরদিন জেডফোর্সের অধিনায়ক সাবেক রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমান জকিগঞ্জে প্রবেশ করেন। ঐদিন জকিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে মনমুগ্ধকর অনুষ্টানের মাধ্যমে দাউদ হায়দার কে জকিগঞ্জের বেসামরিক প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। এবং শত্র“মুক্ত এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বীর মুক্তিযোদ্ধা এনাম চৌধুরী কে প্রধান করে ও মুক্তিযোদ্ধা স্পেশাল কামান্ডার মাসুক উদ্দিন আহমদ ও এনামুল মজিদ চৌধুরী কে উপপ্রধান করে ও মুক্তিযোদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে পাক বাহিনীর মর্ডারে আঘাতপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান জকিগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খলিল উদ্দিন কে সহকারি কামান্ডার নিয়োগ করে প্রশাসনিক কর্মকান্ড শুরু হয়। কিন্তু আজও ব্যথা ভরা মন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ২১ শে নভেম্বর পালন করছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ছাড়া। জকিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের বিরাট অর্জন ছিলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ২১শে নভেম্বরের সেই দিনে জীবনবাজি রেখে সহযোদ্ধাদের রক্তের উপর দিয়ে জকিগঞ্জ কে প্রথম হানাদার মুক্ত করা। ৪৪বছরে বাংলাদেশে অনেক সরকার ক্ষমতায় ছিলো বর্তমানেও আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আছে কিন্তু জকিগঞ্জবাসী জানেন না কেন এখনো তাদের এই অর্জনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেননা। আমরা জানতে চাই মুক্তিযোদ্ধা তথা জকিগঞ্জবাসীর এই ন্যায্য দাবী আজ কোন মাকড়শার জালে আটকে থাকলো। ৭১ রণাংঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা কি মরণের আগে দেখতে পারবেন না জকিগঞ্জ স্বাধীন বাংলার প্রথম মুক্তাঞ্চল বা মুক্তাঞ্চল হিসাবে সরকারি ভাবে ঘোষনা করা হয়েছে। আজ যদি সরকার বাংলার প্রকৃত ইতিহাস কে প্রশ্ন করেন ইতিহাস রাজসাক্ষ্য হয়ে সাক্ষ্যি দিবে জকিগঞ্জ ই এই বাংলার প্রথম মুক্তাঞ্চল। সরকার যদি বাংলার প্রকৃত ইতিহাস কে বিশ্বাস করেন তাহলে আমার বিশ্বাস জকিগঞ্জ কে দেশের প্রথম মুক্তাঞ্চল ঘোষনা করা হবে। বর্তমান সরকারের উচিত যুদ্ধের সময়ের মুক্তিযোদ্ধের স্মৃতিকথাগুলো সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করে উপস্থাপন করা। যদি সরকার সঠিকভাবে যুদ্ধের সময়ের স্মৃতিকথাগুলো লিপিবদ্ধ করেন তাহলে অবশ্যই আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাব। মাননীয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি জকিগঞ্জবাসীর দাবি ২০১৫ সালের পাঠ্য পুস্তকে জকিগঞ্জ প্রথম মুক্তাঞ্চল তা সংযোজন করার। জকিগঞ্জবাসীর প্রত্যাশা জকিগঞ্জই হবে স্বাধীন বাংলার প্রথম মুক্তাঞ্চল।
লেখকঃ সাংবাদিক

আল হাছিব তাপাদার
জকিগঞ্জ সিলেট
০১৬৭৬৩১৬৫৫৩